স্টাফ রিপোর্টার ॥ আজ পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী। রবিউল আউয়াল মাসের এই দিনে পবিত্র মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন ইসলাম ধর্মের প্রচারক, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদ (সা)। শুধু জন্ম নয়, একই দিনে তিনি দুনিয়া থেকেও বিদায় নেন। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলেও তাঁর রেখে যাওয়া বিধানই আজ বিশ্ব মানবতার মুক্তির একমাত্র পথ। তাই তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিনটি বিশ্ব মুসলমানরা অত্যন্ত পবিত্রজ্ঞান করে মর্যাদার সঙ্গে পালন করে। তাই পারস্যের বিখ্যাত কবি তাঁর চারিত্রিক গুণাবলী, সদাচার, মধুর ও নিষ্পাপ জীবন এবং আদর্শ শিক্ষা সম্বন্ধে লেখেন- ‘বালাগালউলা বেকামালিহি/ কাশাফাদ্দুজা বেজামালিহি/ হাসানাত জামিউ খেসালিহি/ সাল্লুআলাইহে ওয়াআলিহি।
শুধু পারস্যের শেখ সাদী নন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম উল্লেখ করেন, তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে, মধু পূর্ণিমারই চাঁদ সেথা দোলে, যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে। আরব মরুর বুকে জন্ম নিলেও তিনি ছিলেন সমগ্র মানবজাতির মুক্তির দূত। মানুষে মানুষে অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে, বাদশাহ, ফকিরকে এককাতারে শামিল করে আল্লাহ্র একত্ববাদ প্রচার করে গেছেন। পবিত্র কোরান শরীফে আল্লাহ্ যাঁকে সমগ্র মানবজাতির রহমতস্বরূপ ঘোষণা করেছেন, তিনি হলেন আল আমিন বা বিশ্বাসী। তাঁর জীবনের মাহাত্ম্য ও নিষ্কলুষতা দ্বারা এমনভাবে জীবন পরিচালিত করেছেন যে, তাঁকে বিশ্বাসী উপাধি প্রদান করা হয়।
কিন্তু ছোটকাল থেকে বিশাসী বলে পরিচিতি লাভ করলেও তাঁর জীবন নিষ্কণ্টক ছিল না। পাহাড়সমান বাধা পেরিয়ে তিনি তাঁর ওপর প্রেরিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হন। এক সময়ে যারা তাঁকে বিশ্বাসী বলে ডাকত, আল্লাহ্র একত্ববাদ প্রচারের জন্য সেই তিনি কি-না হয়ে পড়লেন নিজ গোত্রের কাছে উদ্ভট, কল্পনাবিলাসী ও উৎকট সংস্কারবাদী। তিনি আরবদের প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করে, পূর্বপুরুষের সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামো ভেঙ্গে দিয়ে, প্রাক-ইসলামী যুগের সুযোগ-সুবিধা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান ভেঙ্গে দিয়ে নতুন ধর্মমত প্রচার করেন, যা আজকের দুনিয়ায় ইসলাম ধর্ম হিসেবে পরিচিত।
ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মতে, পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের কাছে একই সঙ্গে আনন্দ-বেদনার দিন। তাই এদিনে বিশ্বের ১শ’ ৬০ কোটি মুসলমান পরম শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে তাদের প্রিয়নবীকে স্মরণ করবে। তাদের কণ্ঠে আরও ধ্বনিত হবেÑ ‘ইয়া নবী সালাম আ’লায়কা, ইয়া রাসূল সালাম আ’লায়কা। পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন। বানীতে তারা মিলাদুন্নবী উপলক্ষে দেশবাসীর প্রতি শুভেচ্ছা ও মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা করেন। এছাড়া দিনটি উদ্যাপনের জন্য বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারি রেডিও, টেলিভিশন এ উপলক্ষে বিশেষ কর্মসূচী নিয়েছে। সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। দিনটি উপলক্ষে আজ সংবাদপত্র অফিস ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
মরুর এই দুলাল আজ থেকে দেড় হাজার বছরেরও বেশি আগে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আজকের এই দিনে মক্কা নগরীর পবিত্র ভূমিতে মা আমিনার কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের কিছুদিন আগেই পিতা আব্দুল্লাহ মক্কা থেকে ইয়াসরিবে (বর্তমান মদিনা) বাণিজ্যিক কাফেলায় যাওয়ার পথে ইন্তেকাল করেন। তিনি যে বছর জন্মগ্রহণ করেছিলেন ওই বছরের ২৯ আগস্ট ইয়েমেনে আবিসিনিয়ার প্রতিনিধি আবরাহা বিশাল এক হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কার কাবা শরীফ ধ্বংস করার চেষ্টা করেন। তাই তাঁর জন্মের বছরকে অনেকে হস্তি বছরও উল্লেখ করে থাকে।
প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী শিশু মুহম্মদ (সা)-কে হাওয়াজীন গোত্রের শাখা বানু সাদের এক বেদুইন মহিলার নিকট লালন-পালনের জন্য দেয়া হয়, যিনি বিবি হালিমা নামে পরিচিত ছিলেন। বালক মুহম্মদ (সা) দাইমা বিবি হালিমার কাছে ছয় বছর ছিলেন। কিন্তু ছয় বছর বয়সে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হলে ওই বছরই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। পিতা-মাতা হারিয়ে তিনি কার্যত অনাথ হয়ে পড়েন। এর ফলে অনাথ বালকের লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন দাদা আবদুল মুত্তালিব। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর তিন থেকে চার বছরের মধ্যেই দাদাও মৃত্যুবরণ করেন। দাদা আবদুল মুত্তালিব মৃত্যুশয্যায় বালক মুহম্মদের লালন-পালনের দায়িত্বভার অর্পণ করেন পুত্র আবু তালেবের ওপর। তাঁর পরিবারে থেকেই তিনি বড় হতে থাকেন। এ সময় থেকেই তাঁর চলাচলে যথেষ্ট শালীনতা দেখা দেয়। নিরহঙ্কার ও বিনয়ী ছিল তাঁর চারিত্রিক গুণ। এ সময় তিনি মরুভূমিতে চাচার পশু চারণ করতেন। পঁচিশ বছর বয়সে নিজ গোত্রীয় বোন মক্কার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী খাদিজার ব্যবসায়িক প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সিরিয়ায় গমন করেন। নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে খাদিজা তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের বিবাহ ছিল দু’জনের জন্য আশীর্বাদ। বিবাহবন্ধনটি ছিল অত্যন্ত সুখের। যদিও দু’জনের মধ্যে বয়সের যথেষ্ট ব্যবধান ছিল।
হজরত মুহম্মদ (সা)-এর জন্ম হয় কুরাইশ বংশের বনি হাশিম গোত্রে। তাঁর জন্মের সময় হাশিম গোত্র নেতৃত্বসহ বিভিন্ন দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। যদিও মক্কার কাবা শরীফের সম্মানজনক দায়িত্ব ছিল এই গোত্রের ওপর, যার নেতৃত্বে ছিলেন নবীর আপন চাচা আবু তালিব। কিশোর বয়স থেকেই মুহম্মদ (সা) প্রত্যক্ষ করেন আরব হেজাজের লোকেরা যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারামারিতে ব্যস্ত থেকেছে। গোত্রে গোত্রে মারামারি-কাটাকাটি ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। এছাড়া কন্যাশিশু জন্মগ্রহণ করলে তাকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। আরব বিশ্ব ছিল পৌত্তলিকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। খুব ছোটকাল থেকে এসব দৃশ্য তাঁর মনে রেখাপাত করেছিল। আরবের ভয়াবহ এসব যুদ্ধের হাত থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন গোত্রের সমন্বয়ে গঠন করা হয় শান্তি সংঘ বা হিলফুলফুজুল। কম বয়য়েই তিনি এ সংগঠনের অন্যতম সদস্য হিসেবে আরবের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করেন।
শিশু বয়সে পিতা-মাতা ও আশ্রয়হীন হওয়ার পরও ৪০ বছর পর্যন্ত তাঁর জীবন অতিবাহিত হয় অনেকটা নির্বিঘেœই। কিন্তু নব্যুয়তপ্রাপ্তির পর থেকেই আরবের কুরাইশদের হাতে অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার হন ইসলাম প্রচারের অপরাধে। এ সময় তিনি মূর্তিপূজায় নিমগ্ন কুরাইশ বংশের লোকদের পৌত্তলিকতা ছেড়ে আল্লাহ্র একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়ার আহ্বান জানান। এরপর থেকে হেজাজের সব গোত্রের লোক জোটবেঁধে তাঁর বিরোধিতা শুরু করে। তাঁর জীবনের ওপর নেমে আসে অত্যাচার। ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ আর হাসি, ঠাট্টা, কটূক্তি করতে থাকে তাঁর প্রবর্তিত নতুন ধর্ম নিয়ে। জীবনকে করে তোলে দুর্বিষহ।
৬০৫ সালে ৩৫ বছর বয়সে তাঁর জীবনে এক আধ্যাত্মিক পরিবর্তন সূচিত হয়। তিনি হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন। কখনও কখনও সারারাত ধ্যান করেই গুহায় কাটিয়ে দিতেন সেখানে। পাঁচ বছর ধ্যান সাধনার পর ৪০ বছর বয়সে প্রথম তাঁর কাছে ওহি নিয়ে হাজির হন ফেরেস্তা জিবরাইল (আ)। জিব্রাইলের মাধ্যমে নব্যুয়তপ্রাপ্তির সুসংবাদ পান। ধ্যানমগ্নকালে ফেরেস্তার মাধ্যমে তিনি প্রথম বাণী শ্রবণ করেছিলেন : হে নবী পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন এক ফোঁটা রক্তবিন্দু থেকে। আর এভাবেই তাঁর ওপর অবতীর্ণ হয় সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ কোরান মজিদ। তাঁর প্রচারিত ধর্ম কুরাইশদের পৌত্তলিকতার মূলে কুঠারঘাত করে। তিনিই প্রথম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ ধর্ম এবং আল্লাহ্র দৃষ্টিতে সকল সৃষ্ট জীব সমান, উঁচু-নিচু কোন ভেদাভেদ নেই প্রচার করতে থাকেন। তাঁর প্রচারিত এ ধর্মে কৌলিন্য ও আভিজাত্যের কোন স্থান নেই। তিনিই প্রথম শিশুকন্যা হত্যা বন্ধের কথা বলেন। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে এবং তাদের প্রতি কটূক্তি না করতে বলেন। তিনি সকল প্রকার অলৌকিক এবং পরাবাস্তব ঘটনাবলীর উর্ধে থেকে ইসলামের মহান বাণীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, যার উৎস আল্লাহ্ প্রেরিত। এ বাণী প্রচারে তিনি কখনই অলৌকিক ঘটনার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন না। আল্লাহ্র প্রতি নবীজীর একত্ববাদের এ অনমনীয় মনোভাবের কারণে কুরাইশরা তাঁর প্রতি স্টিমরোলার চালাতে থাকে।
মাত্র ২৩ বছরের মাথায় তিনি আরব হেজাজের আমূল সংস্কার আনতে সক্ষম হন। যুগ যুগ ধরে লালিত পৌত্তলিকতার মূলে কুঠারাঘাত করেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি ছোট-বড় অসংখ্য যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যার মধ্যে বদরের যুদ্ধ, ওহুদের যুদ্ধ এবং খন্দকের যুদ্ধে সরাসরি নেতৃত্বে ছিলেন। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি এক লাখ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে বিনা বাধায় মক্কা জয় করেন। এ জয়ের মাধ্যমে কুরাইশদের যুগ যুগ ধরে লালিত প্রথা তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে। মক্কা বিজয়ের পর তিনি সর্বশেষ মক্কায় বিদায় হজের ভাষণ দেন। তাঁর বিদায় হজের ভাষণে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, তোমাদের মাঝে আমি রেখে যাচ্ছি দুটি মূল্যবান জিনিস, ‘কোরান ও সুন্নাহ’। এ দুটিকে তোমরা যতদিন আঁকড়ে থাকবে ততদিন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। ৬৩২ সালে দীর্ঘ ৬২ বছর বয়সে আজকের এই দিনে তিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।
হজরত মুহম্মদ (সা)-কে প্রেরণ করা হয়েছিল সমগ্র মানবজাতির রহমতস্বরূপ। পবিত্র কোরান শরীফে আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন, মুহম্মদকে সৃষ্টি না করলে আমি পৃথিবী সৃষ্টি করতাম না। তাঁর আগমনে মানবজাতি লাভ করেছে কল্যাণময় পথের পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা, মানবিক মূল্যবোধ ও মর্যাদার গভীরতম চেতনা। কোরানে অন্যত্র ইরশাদ করা হয়েছে, ‘আমি আপনার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি।’ আল্লাহ্ আরও ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেস্তাগণ নবীর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করে থাকে। অতএব হে ইমানদারগণ; তোমরাও নবীর শানে দরুদ ও সালাম পেশ কর।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: