
সারাদিনের ক্লান্তি কাটিয়ে ৫ টাকা দিয়ে এই পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে গোসল করেন এলাকাবাসী
বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির শহর পুরান ঢাকা। মানুষের কোলাহলের এই শহরে পুকুরে ডুব দিয়ে স্বস্তির গোসল করতে মরিয়া হয়ে থাকেন খান্দানি ঢাকাবাসী। সেই স্বস্তির গোসল করতে মানুষের চাহিদা পূরণ করে আসছে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে নবাবদের এই পুকুর। সারাদিনের ক্লান্তি কাটিয়ে ৫ টাকা দিয়ে এই পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে গোসল ও সাঁতার কাটেন এলাকাবাসী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গোল আকৃতির এই পুকুরটির চারপাশ ওয়াল দিয়ে ঘেরা। পুকুরের চারদিকে রয়েছে বিশাল আকৃতির নারিকেল গাছ। পুকুরের ঘাটে ৫ টাকা জমা দিয়ে গোসল করছেন মানুষ। যুবক বয়সী ছেলেরা দল বেঁধে সাঁতার কাটছেন। গোসল ছাড়াও পুকুরটি দেখার জন্য দর্শনার্থীদেরও আসতে দেখা যায়। এ ছাড়াও পুকুরের পাড়ে রুমের ভেতর রয়েছে ওয়াসার পানিতে জামা-কাপড় ধোয়া ও গোসলের ব্যবস্থা। যাদের পুকুরে পানিতে নামতে ভয়, তারা পুকুরপাড়েই ওয়াসার পানিতে গোসল করছেন।
তবে এই পুকুরে সাধারণ মানুষ এখন গোছল করলেও এটি এক সময় ছিল নবাব পরিবারের। নওয়াব আলিমুল্লাহ সাহেব জায়গা কিনে এখানে পুকুর বানিয়েছেন। উনি এখানে মাছ ধরতেন। এই পুকুরের অবস্থান পুরান ঢাকার ইসলামপুরের নবাববাড়ি মার্কেট রোড-সংলগ্ন ও আহসান মঞ্জিলের পেছনে।
‘নবাববাড়ি’ পুকুরের ইতিহাস সম্পর্কে নবাববাড়ি ট্যাঙ্ক কমিটির সভাপতি মো. কাইয়ুম একটি গণমাধ্যমকে জানান, ‘এই পুকুরের ইতিহাস অনেক আগের। বিতর্কও রয়েছে অনেক। এই পুকুর নিয়ে নবাব পরিবারের বংশধরদের মধ্যে মামলাও চলে, পরে সর্বশেষ ২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশে মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট পুকুরটির বৈধ মালিকানা পায়। এই ট্রাস্ট আবার নবাববাড়ি ট্যাঙ্ক কমিটি করেন। এই ট্যাঙ্ক কমিটিই বর্তমানে পুকুরটি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকে।’
মো. কাইয়ুম বলেন, আমাদের ট্রাস্টে ১১ জনের একটা কমিটি আছে। সেখান থেকে নির্বাচন দিয়ে নবাববাড়ি ট্যাঙ্ক কমিটির সভাপতি-সেক্রেটারি নির্বাচিত করা হয়। আগে এখানে গোসল করার জন্য ২ টাকা করে নেওয়া হতো, গত চার বছর যাবৎ আমরা পুকুরের পরিচর্যার জন্য ৫ টাকা করে নেই। আমাদের পুকুর রক্ষণাবেক্ষণে ৪ জন স্টাফ আছে, চারদিকে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে।
তিনি বলেন, এখানে গোসল করতে বাইর থেকেও দর্শনার্থীরা আসে। বেশিরভাগ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাপড় নিতে এসে এখানে গোসল করে যায়। এখানে গোসল করতে মহিলারাও আসে, তাদের জন্য আলাদা কাপড় চেঞ্জ করার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়াও এখানে হিন্দুদের বিয়ের হলুদ হয়। তারা ব্যান্ড পার্টি নিয়ে এসে কলস দিয়ে পানি নিয়ে যায়। বিয়ের হলুদের জন্য কোনো চার্জ নেওয়া হয় না।
কাইয়ুম আরও বলেন, এখানে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার খেলা হয়। যারা ইচ্ছে করে এখানে মাছ ধরতে আসতে পারে। মাছ ধরার জন্য আলাদা চার্জ দিতে হয়। কারণ আমরা মাছের জন্য এখানে আলাদা খরচ করি। এই পুকুরের সঙ্গে ঢাকার কোনো ড্রেনের বা ডাস্টবিন লাইনের সংযোগ নেই। পানি সব সময় পরিষ্কার রাখা হয়। বৃষ্টিতে পানি বেশি হলে নিষ্কাশন করা হয়। মাঝে মাঝে পানির সংকট থাকলে ওয়াসার পানি দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে পুকুরের চারপাশে পার্কের সুবিধা করা হবে যাতে মানুষ হাঁটতে পারে, এসে আড্ডা দিতে পারে।
পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা এরশাদ মিয়া বলেন, এই পুকুর ছিল নবাবী আমলের পুকুর। আমাদের বাপ-চাচারা এখানে গোসল করতেন। এলাকায় এই একটি মাত্র পুকুর। পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটা, ডুব দিয়ে গোসল করার মজাই অন্যরকম।
পুকুর পরিচালনা কমিটি সূত্রে জানা যায়, এই পুকুরে বেশিরভাগ ইসলামপুর, বাংলাবাজার, বাদামতলী, বাবুবাজার, শাঁখারীবাজার, পাটুয়াটুলী, তাঁতীবাজার, নয়াবাজার এলাকার বিভিন্ন দোকান বা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লোকজন বেশি গোসল করেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬১০ সালে নবাব আব্দুল বারি প্রথম এই পুকুরটি খনন করান। এরপর এখান থেকে পুরান ঢাকার কামার, কুমার ও মৃৎশিল্পীরা মাটি নিয়ে এটাকে আরও গভীর করে। তাদের থেকে ১৮৩০ সালে নবাব খাজা আলিম উল্লাহ কুঠিসহ জলাশয়টি কিনে নেন। এরপর জলাশয়টি সংস্কার করে পুকুরে পরিণত করা হয়। বৃত্তাকারে প্রায় সাড়ে ছয় বিঘা জমির ওপর তৈরি হয় পুকুর। স্বাধীনতার পর পর পুকুরের সৌন্দর্য হ্রাস পায় এবং এটি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া পুকুরের মালিকানাকে কেন্দ্র করে নবাব পরিবারের বংশধরদের মধ্যে মামলা-আপোসের কারণেও পুকুরটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। সর্বশেষ ২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট পুকুরটির বৈধ মালিকানা পায়।
আগে একে ‘গোল তালাব’ নামে ডাকা হতো। তালাব উর্দু শব্দ, যার অর্থ জলাধার। পরে এটি নবাববাড়ির পুকুর নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিতি পায়। আর সরকারি গেজেটে এর নাম ‘ইসলামপুরের গোল তালাব’। তবে স্থানীয়রা এই পুকুরটিকে ‘নবাববাড়ি পুশকুনি’ নামে সম্বোধন করেন। বর্তমানে ‘মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ পুকুরটির দেখাশোনা করছে।
শত ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে উনিশ শতকে খনন করা পুকুরটি আজও টিকে আছে গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে।