ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

আরবের খেজুর বরেন্দ্রভূমিতে

প্রকাশিত: ১৭:৪০, ১৫ জুন ২০২১

আরবের খেজুর বরেন্দ্রভূমিতে

সংবাদদাতা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্রভূমিতে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে মধ্যপ্রাচ্যের খেজুর চাষ। উৎপাদন, বাজারজাত ও মুনাফাসহ সবদিক দিয়ে এটি আশাব্যঞ্জক। গবেষকদের মতে, আমদানি করা খেজুরের চেয়ে এই ফল সুস্বাদু। দেশে উৎপাদিত খেজুরের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন তারা। তাই বরেন্দ্র এলাকার উঁচু জমিতে বাণিজ্যিকভাবে বাড়ছে এর বাগান। সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া, বরেন্দ্রর উষ্ণ আবহাওয়া ও রুক্ষ মাটিতে ধান ও আমের পাশাপাশি অর্থকরী ফসল হিসেবে চাষ হচ্ছে মরুর খেজুর। অন্যান্য ফলের চেয়ে এর সংরক্ষণকাল, চাহিদা ও বাজারমূল্য বেশি। তাই বাণিজ্যিকভাবে খেজুর বাগান গড়তে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন স্থানীয় চাষিরা। গেল ২০১৭ সালে নাচোল উপজেলার ভেরেন্ডি এলাকায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সৌদি খেজুরের বাগান করে সফলতা পেয়েছেন চাষি ওবায়দুল ইসলাম রুবেল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- বরেন্দ্রর উষ্ণ আবহাওয়া ও রুক্ষ মাটিতে ধান ও আমের পাশাপাশি অর্থকরী ফসল হিসেবে চাষ হচ্ছে মরুর খেজুর। অন্যান্য ফলের চেয়ে এর সংরক্ষণকাল, চাহিদা ও বাজারমূল্য বেশি। বাণিজ্যিকভাবে খেজুর বাগান করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন স্থানীয় চাষিরা। ইতোমধ্যে বাণিজ্যিকভাবে সৌদি খেজুরের বাগান করে সফলতা পান রুবেল। এর মধ্যে গত বছর দুই একটা গাছে খেজুর এসেছিল। চলতি মৌসুমে তার বাগানে খেজুর ধরেছে প্রচুর। এগুলো আকার ও স্বাদে সৌদি খেজুরের মতো হওয়ায় বাজারে চাহিদা বেশি। সরজমিনে রুবেলের বাগানে গিয়ে দেখা গেছে- সবুজ ও লালচে খেজুর সুবাস ছড়াচ্ছে। গাছের থোকায় থোকায় দুলছে সুককারি, বারোহি, আম্বার ও মরিয়মসহ বিভিন্ন জাতের খেজুর। চাষি রুবেল জানান, ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারেন, এ দেশেই মধ্যপ্রাচ্যের খেজুর চাষ হচ্ছে। এ জন্য বরেন্দ্রভূমিতে এই ফল চাষে আগ্রহী হন তিনি। ২০১৭ সালে সৌদি আরব থেকে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে অর্ধশত জাতের বীজ সংগ্রহ করে বাড়ির পাশেই তিন বিঘা জমিতে খেজুরের বাগান গড়ে তোলেন। সঠিক পরিচর্যা, তদারকি ও অক্লান্ত পরিশ্রমে এসেছে কাক্সিক্ষত ফল। ৬শ' চারা নিয়ে চাষ শুরু করা তার বাগানে এখন গাছের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। আর বীজ থেকে চারা উৎপাদন করেছেন আরও ৬ থেকে ৭ হাজারের মতো। তিনি আরও জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে ধান ও আম ছাড়া অন্য কোনও ফসল তেমন হয় না। যদিও সম্প্রতি পেয়ারা, মাল্টা ও ড্রাগনসহ বিভিন্ন ফলের চাষ বেড়েছে। কিন্তু সবজি চাষ করে এই অঞ্চলের কৃষকরা তেমন লাভবান হতে পারেন না। উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে অন্যান্য ফল ও সবজি চাষে খরচ অনেক। সেই তুলনায় লাভ অনেক কম। অন্যান্য ফসলের সংরক্ষণকাল অনেক কম। খেজুর চাষের জন্য এখানকার আবহাওয়া উপযোগি ও সংরক্ষণকাল, চাহিদা এবং বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে খেঁজুর বাগান করতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সফলতা পেয়েছেন তিনি। বাগানে এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ১১ লাখ টাকা। যদিও বিনিয়োগের বেশিরভাগ টাকায় চারা বিক্রি থেকে ফিরে এসেছে। চাষিরা বাণিজ্যিকভাবে এই খেজুর চাষ করে লাভবান হতে পারেন। একটি খেজুর গাছ থেকে প্রতিবছর আড়াই থেকে তিন মন খেজুর পাওয়া যায়। একটি খেজুর গাছ বহু বছর ফল দেয়। বাগানের খেজুর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকায়। আর বীজ থেকে পাওয়া চারা সর্বনিম্ন আড়াই’শ থেকে ৫ হাজার টাকা এবং মাতৃগাছের শাখা চারা ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তার এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে স্থানীয় অনেকেই গড়ে তুলছেন খেজুর বাগান। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তার বাগান থেকে খেজুর গাছের চারা কিনে নেয়া হচ্ছে। এবার তার তিন বিঘা জমিতে মোট খরচ হয়েছে প্রায় তিন লাখ টাকা। সব মিলিয়ে খেজুর বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরছেন ২৫-৩০ মণ। টাকার পরিমাণ প্রায় দুই লাখ ১০ হাজার টাকা। এছাড়া বিপুল পরিমাণ গাছের চারাও বিক্রি করছেন তিনি। রুবেলের কাছ থেকে ২৫০টি চারা সংগ্রহ করে নিজে একটি বাগান গড়ে তোলেন ভেরেন্ডি গ্রামের কৃষক মো. তোফাজ্জল হোসেন। একই উপজেলার চাষি আফজাল হোসেন। তিনিও রুবেলের কাছ থেকে ২শ’টি চারা কিনে গড়ে তুলেছেন খেজুর বাগান। এছাড়া জেলার জামতালা, কল্যাণপুর ও গোবরাতলায় চাষ হচ্ছে মরুর খেজুর। চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের জার্ম প্লাজম কর্মকর্তা মো. জহুরুল ইসলাম জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে খেজুর চাষের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। চাষিদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের খেজুর নতুন অর্থকরী ফসল হিসেবে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি-আবহাওয়া ও জলবায়ু খেজুর চাষের জন্য উপযোগী এবং উৎপাদন খরচ ও রোগবালাই কম। বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির প্রাপ্যতা অনেক কম। খেজুর চাষে পানি কম লাগে। বর্তমানে বাগানগুলোতে ফল দেখা যাচ্ছে। এখানকার উৎপাদিত খেজুরের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ আমদানিকৃত খেঁজুরের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং এ ফলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং চাষিরা খেঁজুর চাষ করে লাভবান হবে। এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম জানান, উৎপাদিত খেজুর বাগান সার্বিক পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করছে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা। দেশে আগামীতে খেজুরের আমদানি নির্ভরতা কমাতে বরেন্দ্র অঞ্চলে খেজুর চাষ সম্প্রসারণ হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের আবহাওয়া অনেকটা মধ্যপ্রাচ্যের মতো। ফলে বাণিজ্যিকভাবে খেঁজুর চাষে কৃষকরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এছাড়া সারাদেশে এটি কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
×