ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইনে ব্যবস্থা

বিটকয়েন লেনদেন নিষিদ্ধ

প্রকাশিত: ১১:০৩, ৩ মার্চ ২০২০

বিটকয়েন লেনদেন নিষিদ্ধ

রহিম শেখ ॥ বিটকয়েন। পশ্চিমা বিশ্বে যাকে ডিজিটাল কারেন্সি বলা হয় । যদিও পৃথিবীর কোন দেশের স্বীকৃত বা বৈধ মুদ্রা নয় এই বিটকয়েন। বাংলাদেশেও এই মুদ্রা অবৈধ। কিন্তু তারপরও হচ্ছে লেনদেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেজের মাধ্যমে এ ধরনের লেনদেন চলছে। বেশ কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র অর্থ লেনদেন করছে দেশে কার্যরত বিভিন্ন ব্যাংকের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড এবং মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, রকেট ও নগদের মাধ্যমে। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশে বিটকয়েন লেনদেন পুরোপুরি নিষিদ্ধ। তারপরও এই ভার্চুয়াল মুদ্রা লেনদেন চলছে, আর এতে বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা করছেন বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তিবিদরা। তারা বলছেন, সাবধান, লেনদেনে সতর্ক হতে হবে। ইতোমধ্যে কয়েক দফায় বিটকয়েন লেনদেন নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বলছে, এ ধরনের মুদ্রায় লেনদেন ঝুঁকিপূর্ণ। এটি পুরোপুরি অবৈধ। এই মুদ্রার লেনদেন নিষিদ্ধ এবং মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন উল্লেখ করে ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ’ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। অনুসন্ধানে বাংলাদেশে বিটকয়েন লেনদেনের অন্তত অর্ধশতাধিক ওয়েবসাইটের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্যাক্সফুল ডটকম নামে একটি ওয়েবসাইট ঘেটে দেখা গেছে, বাংলাদেশে এরই মধ্যে ৪০ হাজার বিটকয়েন বিক্রি করেছে প্যাক্সফুল ডটকম। ৫৫ হাজার ক্রেতা এই বিটকয়েন কিনেছেন। লোকাল বিটকয়েনস ডটকম নামে অন্য একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বিকাশ, রকেটসহ মোবাইল ব্যাংকিং এবং সাধারণ ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিটকয়েন কেনাবেচা করা যায়। ইতোমধ্যে বেশ কিছু ওয়েবসাইট বিটকয়েন লেনদেনে টোকেন বিক্রি শুরু করেছে। ‘বিটকয়েন বাংলাদেশ’, বিটকয়েন ফোরাম বাংলাদেশ, ‘বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ : বিটকয়েন বাই এ্যান্ড সেল বাংলাদেশ’ নামে বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজ খুঁজে পাওয়া যায়। এসব পেজেও বলা হয়েছে, বিকাশ, রকেটসহ মোবাইল ব্যাংকিং ও সাধারণ ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিটকয়েন কেনাবেচা করা যাবে। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ বিটকয়েন লেনদেন করাটা অন্তত ঝুঁকিপূর্ণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতারণার শিকার হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তারপরও কেউ যদি এই লেনদেনে খুব বেশি আগ্রহী হন তাহলে সঠিক ওয়েবসাইট খুলে ডাউনলোড করতে হবে সফটওয়্যার। তারপর ওয়ালেট তৈরি করে সংগ্রহ করতে হবে বিটকয়েন। জানা গেছে, বিট কয়েনের বৈধতা পেতে ২০১৪ সালে উদ্যোগ নেয় এদেশের আগ্রহী কিছু ফ্রিল্যান্সার। এর অংশ হিসেবে ওই সময় তারা বেশকিছু ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিষয়টি অবগত হওয়ার পর একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর একটি সতর্কতামূলক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিটকয়েন কোন দেশের ইস্যুকৃত বৈধ মুদ্রা নয়। বিটকয়েন বা বিট কয়েনের মতো কিংবা অন্যকোন কৃত্রিম মুদ্রায় লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক বা বাংলাদেশ সরকারের কোন সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্যকোন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন বহির্ভূত এসব লেনদেন বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭ ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বিজ্ঞপ্তির পর দেশে বিটকয়েন চালুর উদ্যোগ স্তিমিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে বিটকয়েন নিষিদ্ধ হলেও বাইরের অনেক প্রতিষ্ঠান এই ভার্চুয়াল মুদ্রায় পেমেন্ট নিয়ে থাকে। দেশে অবৈধ হলেও বিট কয়েনের লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত তারেক জামান (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, বিটকয়েন ডলার কিংবা টাকায় রূপান্তর করা হচ্ছে। অনলাইনে যোগাযোগ করে যে কেউ তাদের কাছ থেকে বিটকয়েন বিনিময় করতে পারেন। এক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে কমিশন নেন তারা। আর বিক্রেতার কাছ থেকে নেয়া বিটকয়েন পরবর্তীতে অনলাইনেই বিদেশী মার্কেট প্লেসগুলোয় বিক্রি করা হয়। দেশে বিট কয়েনে লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত এ ধরনের কয়েকটি চক্রের সন্ধানও পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া অনলাইনভিত্তিক একাধিক সন্দেহভাজন প্রতিষ্ঠানকে নজরদারির মধ্যে রেখেছে তারা। এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, বিটকয়েন মূলত ইন্টারনেট সিস্টেমে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কে প্রোগ্রামিং করা আছে, যা চাইলে কেনা যায়। তবে এটি কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা কোন দেশের জারি করা মুদ্রা নয়। ইন্টারনেট সিস্টেমকে ব্যবহার করে কিছু ব্যক্তি এই সিস্টেমকে ডেভেলপ করেছে। এটাকে এক ধরনের জুয়া খেলা বলা যেতে পারে। তিনি বলেন, এই মুদ্রার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে, এর কোন কর্তৃপক্ষ নেই। এ কারণে এটা অবৈধ। তবে জুয়াড়িদের কাছে এটা জনপ্রিয়। এক সময় এর দাম ছিল এক শ’ ডলার। এক বছরের মধ্যে তা বেড়ে হয় এক হাজার ডলার। এখন এর দাম ১৯ হাজার ডলারে উঠে গেছে। যে কারণে লোভে পড়ে অনেকেই এই মুদ্রায় বিনিয়োগ করছে। কিন্তু হঠাৎ করে এর পেছনের লোকেরা বাজার থেকে সরে গেলে বিপদে পড়বেন অনেকেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কতা জারি বিটকয়েন নিয়ে একাধিকবার সতর্কতা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দেশে বিট কয়েনের লেনদেন হচ্ছে, যা কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত নয়। ফলে মানুষের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এ ধরনের অবৈধ মুদ্রার লেনদেন না করতে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে আরও বলা হয়েছে, অনলাইনভিত্তিক ভার্চুয়াল মুদ্রা বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, রিপ্পেল ও লিটকয়েনসহ বিভিন্ন বিনিময় প্ল্যাটফর্মে লেনদেন হচ্ছে। এসব ভার্চুয়াল মুদ্রা কোন দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষের ইস্যু করা বৈধ মুদ্রা নয়। ফলে এর বিপরীতে কোন আর্থিক দাবির স্বীকৃতিও নেই। ভার্চুয়াল এসব মুদ্রার লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদিত না হওয়ায় তা আইন দ্বারা সমর্থিত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নামবিহীন বা ছদ্মনামে অনলাইনে ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেনের দ্বারা মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সম্পর্কিত আইনের লঙ্ঘন হতে পারে। এছাড়া অনলাইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেনকারী গ্রাহকরা ভার্চুয়াল মুদ্রার সম্ভাব্য আর্থিক ও আইনগত ঝুঁকিসহ বিভিন্ন ঝুঁঁকির সম্মুখীন হতে পারেন। সম্ভাব্য আর্থিক ও আইনগত ঝুঁকি এড়াতে বিট কয়েনের মতো ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেন বা এসব লেনদেনের প্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ’ আইনে বিটকয়েন লেনদেন নিষিদ্ধ জালনোট চোরাকারবারিসহ বিটকয়েন লেনদেনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ’ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। নতুন আইনটি পাস হলে এটি হবে দেশে জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে প্রথম আইন। আইনটি বাস্তবায়নে ‘জাতীয় এবং জেলা’ পর্যায়ে কমিটি থাকবে। কমিটির সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে আইনের আওতায় গঠন করা হবে ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সেল’। জাল নোট সংক্রান্ত খবর দেয়া হলে পুরস্কার দেয়া হবে সংবাদদাতাকে- এ বিধানও থাকছে নতুন আইনে। জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইনের খসড়ায় অপরাধীদের জন্য পরপর তিন দফা শাস্তি আরোপের বিধান রাখা হয়েছে। প্রথমবার অপরাধ করে শাস্তি ভোগ করে দ্বিতীয়বার একই অপরাধে শাস্তি হবে প্রথমবারের তুলনায় দ্বিগুণ। ফের একই ব্যক্তি এ অপরাধ তৃতীয়বার করলে দ-ের পরিমাণ দ্বিগুণ ও সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদ- হবে। জানা গেছে, জাল নোটের কার্যক্রম প্রতিরোধ এবং সংঘটিত এ সংক্রান্ত বিচারের জন্য পৃথক কোন আইন দেশে কার্যকর নেই। ফলে দ-বিধি ১৮৬০-এর ৪৮৯(ক)-(ঘ) ধারা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এর ২৫(ক) ধারা অনুযায়ী জাল নোট সংক্রান্ত অপরাধের বিচার চলছে। কিন্তু এসব আইনে বিচার করতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশেষ করে বিচারকালে শুনানির নির্ধারিত দিনে প্রায়সই সাক্ষী উপস্থিত না থাকায় মামলার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। নতুন আইনে জাল মুদ্রা প্রস্তুত, ক্রয়-বিক্রয়, খাঁটি বলে ব্যবহার ও লেনদেন, প্রতারণার উদ্দেশে নিজের দখলে রাখা, দেশ থেকে বিদেশ বা বিদেশ থেকে সরবরাহ, পরিবহন ও পাচার, অসৎ উদ্দেশে ইচ্ছাকৃত বিতরণ অপরাধ বলে গণ্য হবে। জাল মুদ্রা তৈরির জন্য যন্ত্রপাতি বা উৎপাদন বা দ্রব্যাদি প্রস্তুত, সরবরাহ, আমদানি, মেরামত, বহন ও ক্রয়-বিক্রয় ও ভার্চুয়াল লেনদেন গুরুতর অপরাধ। মুদ্রা তৈরি সংক্রান্ত পদ্ধতি, তথ্য আদান-প্রদান, ফাইল ক্লিপ, হার্ডডিস্ক, এ সংক্রান্ত কোন গুজব ছড়ানো এ আইনের আওতায় অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
×