ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

অনাথ মেয়েদের আশ্রয়স্থল চাঁদমনি

প্রকাশিত: ০৪:২০, ২৭ অক্টোবর ২০১৮

অনাথ মেয়েদের আশ্রয়স্থল চাঁদমনি

রিতিনা আক্তার রিতা মেয়েটি লালনগীতি গাইছিল ‘জাত গেল জাত গেল বলে- আসবার কালে কি জাত ছিলে- এসে তুমি কি জাত নিলে কি-জাত হবা যাবার কালে-এ কথা ভেবে বল নাজাত গেল- জাত গেল বলে, এ কি আজব কারখান! রিতা অর্থনীতিতে এমএসএস করেছে রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে। এরপর মিম গাইল মমতাজের গান ‘আগে যদি জানতাম রে বন্ধু তুমি হইবা পর ছাড়িতাম কি বাড়ি আমার ছাড়িতাম না ঘর।’ রিতা মিমের মতো আরও কয়েক শিল্পী রয়েছে চাঁদমনি সাংস্কৃতিক দলে। তারা নাটকও করে নিজ প্রতিষ্ঠানের পরিসরে। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ায় সময় রিতা আশ্রয় পায় চাঁদমনিতে। মিমেরাও একই অবস্থা। সে এসএসসি পাস করেছে। চাঁদমনি একটি অনাথ বালিকা আশ্রম ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। শুরু থেকেই বাল্যবিয়ে রোধে, সমাজের কুপ্রথা, যৌতুকের বিরুদ্ধে কাজ করে চাঁদমনি। সামাজিক ও ব্যক্তিসচেতনতা সৃষ্টি করাই প্রতিষ্ঠানটির মূল কাজ। এ কারণে উপজেলায় বাল্যবিয়ে ও যৌতুক প্রথা অনেকটাই কমে গেছে। আবাসিক ছাড়াও অনেক অনাবাসিক হিন্দু ও হরিজন পল্লীর দরিদ্র মেয়েদের পড়াশোনায় সহযোগিতা দিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলায় হতভাগ্য কন্যা শিশুদের শিক্ষার প্রসার, স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলাসহ সমাজ সচেতনতায় অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন আলহাজ পিজিরুল আলম দুলাল। উপজেলার চাওড়াডাঙ্গী গ্রামের স্কুলশিক্ষক মোসলেম উদ্দিন আহমেদ ও পিয়ারা আহমেদের সন্তান তিনি। পিজিরুল আলম দুলাল এলাকায় দুলাল হাজী বা ‘চাঁদমামা’ নামে পরিচিত। তিনি অর্থনীতিতে অনার্স এবং এমএ পাস করেন। কর্মময় জীবনে সফল ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। উত্তরা ব্যাংকের এজিএম পদ থেকে ১৯৯৬ সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। সংসার জীবনে তার স্ত্রী সৈয়দা মোতাহারা বানু নিঃসন্তান জীবনে জটিল রোগে সম্প্রতি পৃথিবী ছাড়েন। স্ত্রীর জীবদশায় এই নিঃসন্তান এই দম্পতি অবহেলিত পিতৃ-মাতৃহারা কন্যা শিশুদের জন্য নিজ বাসায় ১৯৯৯ সালে একটি আশ্রম খুলে বসেন। ভুপেন হাজারিকার কণ্ঠে গাওয়া সেই বিখ্যাত গান ‘মানুষ মানুষের জন্য- জীবন জীবনের জন্য একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু’ গানের এই কথাগুলো নিয়ে একটি সাইন বোর্ড চলার পথে দেখতে পাওয়া যায় উক্ত চাওড়াডাঙ্গী গ্রামের এক বাড়ির সামনে। সেই বাড়িটি হলো চাঁদমনি নামে দরিদ্র অসহায় মেয়েশিশুদের আশ্রম। সেখানেই গিয়ে জানা গেল চাঁদমনি প্রতিষ্ঠার এক বিরাট ইতিহাস। দরিদ্র অসহায় মেয়েশিশুদের আলোর পথ দেখাচ্ছে চাঁদমনি। এ সময় স্থানীয় বালাগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুল ওহাব বলেন, বৃদ্ধ বয়সেও বাবার মতো যত্ন নিয়ে পিজিরুল আলম দুলাল মেয়েশিশুদের শিক্ষিত করে তুলছেন। এটি হয়ত আগামী দিনে আমাদের সবার কাছে আদর্শ ও অনুপ্রেরণা জোগাবে। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ আবাসিক ও শতাধিক হিন্দু-হরিজন পল্লীর অনাথ-দুস্থ মেয়েশিশুর লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মেয়েশিশুদের জন্য পিজিরুলের নিজ বাড়ি অর্থাৎ চাঁদমনিতে আছে বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা। বর্তমানে এখানে আছে ৫০ শিশু-কিশোরী। তারা এই আশ্রমের সার্বিক সহযোগিতায় স্কুল-কলেজে পড়ছে। এখানে দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে কলেজপড়ুয়া মেয়েদের নেয়া হয়। বিধবা মায়েরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে রেখে যান তাদের আদরের মেয়েদের। এখানে থাকার শর্ত আছে, বাল্যবিয়ে দেয়া চলবে না, কমপক্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াতে হবে, নিজ ধর্ম ঠিকমতো পালন করবে আর ধর্মান্ধতা-কুসংস্কার প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। লেখাপড়ার জন্য চাঁদমনিতে নিরিবিলি পরিবেশ, হলরুম, লাইব্রেরি, নামাজের ঘর ও টিভি রুম আছে। নিজ নিজ ঘরে আছে টেবিল, চেয়ার। ক্লাসের ছাড়াও বাইরের বই পড়ার সুযোগ আছে। ২০ বছর ধরে একই নিয়মে চলছে চাঁদমনি।সমাজকে আলোকিত করতে অবিরত ছুটছেন পিজিরুল আলম দুলাল। তিনি হজ পালন করেন ১৯৯৫ সালে। পিজিরুল আলম দুলাল তার পেনশনের সব টাকা চাঁদমনির কাজেই ব্যয় করেছেন। এ ছাড়া তার পৈত্রিক ও নিজের প্রায় সবটুকু জমি চাঁদমনি প্রতিষ্ঠানের কাজে দিয়ে দিয়েছেন। চাঁদমনির বর্তমান বার্ষিক ব্যয় প্রায় আট লাখ টাকা। বোন মাসুদ বেগম, ভগ্নিপতি আব্দুল কাদের বন্ধুবান্ধব, ব্যাংকের সাবেক সহকর্মী, বিদেশে অবস্থানরত আত্মীয় , তাকে প্রতিবছর কিছু সহযোগিতা করেন। তিনি নারী শিক্ষার অগ্রদূত মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া, মাদার তেরেসার আদর্শে অনুপ্রাণিত বলে জানান। তাকে চাঁদমামা বলে শিশুরা ডাকে। ডাকটি মধুর হলেও ব্যক্তিগত জীবনে একেবারেই আশ্রয়হীন, দা¤পত্য জীবনে তারা চাঁদমনির চাঁদমাখা মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে সন্তানহীন অনুভূতিগুলো কখনও দাগ কাটে না। চাঁদমনির আশ্রমে প্রবেশ করলে দেখা যায় চিরায়ত বাংলার হারিয়ে যাওয়া কিছু উপকরণের নমুনা। গরুর গাড়ি, পালকি, ঢেকিসহ ১৯৭১ সালের গণহত্যার জলঢাকা কালীগঞ্জ বধ্যভূমির শহীদদের তালিকা। বিনোদনের জন্য আশ্রমটির ভেতরে খেলার ব্যবস্থা কবিতা আবৃতি ও সঙ্গীতের জন্য রয়েছে বাদ্যযন্ত্র। এখানে একটি গোলঘর রয়েছে। এখানে উঠে এসব শিশু গান, কবিতা, নৃত্য পরিবেশন করে। পিজুরুল আলম দুলালের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেল, জেসমিন বানু নিপা, অঞ্জুুয়ারা নিশা, প্রীতি, স্মৃতি ও নীলাসহ ৫ জনকে দিয়ে দিয়েই চঁাঁদমনি শুরু হয়। তারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। তবে তারা ভোলেননি তাদের ধর্মপিতা ও জীবনসিঁড়ি চাঁদমনিকে। তাদের পরে আসে রিতা, মিম, রুবী, দীপা, হেলালিসহ অনেকে। বর্তমানে এখানে ৫০ জন মেয়ে আবাসিকভাবে আছে। তারা পড়ালেখা করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। চাঁদমনি থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনকে সাজাতে সক্ষম হয়েছেন জেসমিন নিপা। তিনি বিএসসি পাস করেছেন। বর্তমানে চাকরি করছেন সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগে। মনতেজা বানু ও মফেজা বানু সরকারি নার্স (সেবিকা) হিসেবে কর্মরত। রিতিনা বানু রিতা, লিপছি আক্তার রুবি ও আফরিন নাহার শোভা চাঁদমনির সহায়তায় অর্থনীতিতে এমএ করছেন কারমাইকেল কলেজে। চাঁদমনিতে থেকে এসএসসি পাস করেছে ৮০ জন। দেশে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের পথিকৃৎ অধ্যাপক আবু সায়ীদের অনুপ্রেরণায় চাঁদমনির আছে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। রিক্সাভ্যানগাড়ির ওপর সাজানো হয়েছে এ পাঠাগার। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে ভ্যানগাড়ি দাঁড় করিয়ে শিক্ষার্থী ও পথচারীদের বই পড়তে উৎসাহ দেয়া হয়। চাঁদমনিতে দ্বিবার্ষিক একটি হস্তশিল্প প্রদর্শনী মেলা হয়। স্থানীয়সহ দূর-দূরান্ত থেকে প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম হয় সেখানে। মেলায় নারী দর্শনার্থীদের প্রচুর উপস্থিতি মেলে। পাঠপুস্তক ও লাইব্রেরিতে বই পড়া ছাড়াও কোরান শিক্ষার জন্য চাঁদমনিতে আছে মাদ্রাসা। সপ্তাহে চার দিন অভিজ্ঞ আলেম দিয়ে কোরান শিক্ষা দেয়া হয়। ছবি আঁকার ক্লাস হয় সপ্তাহে এক দিন। এ ছাড়া অনাবাসিক কিছু ছাত্রীকে ছবি আঁকা শেখার সুযোগ দেয়া হয়। মাসে দু-এক দিন গানের আসর বসে। গান শেখারও ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া কিছু মেয়ে উপজেলার গানের প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে গান শেখার সুযোগ পায়। চাঁদমনিতে আবাসিক মেয়েদের হস্তশিল্প ও সেলাই প্রশিক্ষণ নিতে হয়। অনেক কথার মাঝে চাঁদমনির প্রতিষ্ঠাতা পিজিরুল আলম দুলাল বলেন, সমাজের অবহেলিত কন্যাশিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম শোনার আগেই যাদের ভবিষ্যত মরে যায়, তাদের মণিকোঠায় চাঁদের মতো শিক্ষার আলো বিলিয়ে দেয়াই চাঁদমনি প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য। অভাব-অনটন থেকে বের হয়ে কোন মেয়ে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হলে তার মাধ্যমে সমাজের অমঙ্গল হবে না। সেই আশা এবং লক্ষ্য নিয়ে চাঁদমনি তৈরি করা। তিনি জানান অনেক সহৃদয় ব্যক্তি চাঁদমনিতে এসে তাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করে যান। চাঁদমনি হতে ফিরে আসার সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া একটি গান মনে পড়ছি- পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা কোলে তবো মাগো বলো তবে ... কত দূর আর কত দূর বলো মা...। কারণ পিজুরুল আলমের বয়স বাড়ছে, তার এমন মহৎ কাজে সবারই উচিত তার পাশে থেকে উৎসাহ ও সহযোগিতা দেয়া। -তাহমিন হক ববী, নীলফামারী থেকে
×