ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়েলিংটন টেস্টে রেকর্ডের ছড়াছড়ি ;###;সাকিব ২১৭, মুশফিক ১৫৯ ;###;দ্বিতীয় দিনে ৭ উইকেটে ৫৪২ রান

ইতিহাস গড়ল সাকিব মুশফিক

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

ইতিহাস গড়ল সাকিব মুশফিক

মিথুন আশরাফ ॥ সাকিব আউট হয়ে মাঠ ছাড়ছেন। এক এক করে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটাররা এসে তার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। এ দৃশ্য দেখলেইতো গর্বে বুক ভরে যায়। তাতে বোঝাও যায়, বিশেষ কোন কীর্তি গড়েছেন এ অলরাউন্ডার। সেই রকমই কিছু হয়েছে। দ্বিশতক করেছেন সাকিব। ২১৭ রানের ইনিংস খেলেছেন। যা টেস্টে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর। তার সঙ্গে মুশফিকও ১৫৯ রানের ইনিংস উপহার দিয়েছেন। দুইজনের অসাধারণ ব্যাটিংয়ে পঞ্চম উইকেটে ৩৫৯ রানের জুটির দেখাও মিলেছে। যে রেকর্ড জুটিতে বাংলাদেশ ইতিহাসও গড়েছে। বিদেশের মাটিতে ম্যাচের প্রথম ইনিংসে খেলতে নেমে সর্বোচ্চ স্কোর গড়ার ইতিহাস গড়েছে। প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেটে ৫৪২ রান করে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের দ্বিতীয়দিন শেষ করেছে বাংলাদেশ। আজ ম্যাচের তৃতীয়দিন। ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভ স্টেডিয়ামে প্রথমদিনটি খুব কষ্টে কাটিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা। বৃষ্টি আর তীব্র বাতাসে ব্যাটিং করতে খুব সমস্যা হয়েছে। এরপরও দিনটি শেষ করে ভালভাবে। ৩ উইকেটে ১৫৪ রান করে প্রথমদিন শেষ করেছে। মুমিনুল হক ৬৪ রানে অপরাজিত ছিলেন। আর সাকিব ৫ রান করে দ্বিতীয় দিনে ব্যাট করতে নামার অপেক্ষায় ছিলেন। তখনই মনে হয়েছিল, দ্বিতীয়দিনেও বাংলাদেশ ভাল কিছু করবে। এদিন বাতাসও ছিল না, বৃষ্টিও ব্যাঘাত ঘটায়নি। তাই বলে এত ভাল হবে। এমন আশা কারোরই ছিল না। সাকিব ও মুশফিকের জুটিতে সুন্দর, স্বপ্নময় একটি দিনেরই দেখা মিলল। বিদেশের মাটিতে আনন্দের একটি দিনই কাটাল বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট দল। আগেরদিনের সঙ্গে আরও ৩৮৮ রান যোগ করল বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে একদিনে যেটি আবার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোরও। মুমিনুল আর একটি রানও স্কোরবোর্ডে যোগ করতে পারেননি। আউট হয়ে গেছেন। তখন কেমন যেন মনে হচ্ছিল, ছন্নছাড়া হয়ে পড়বে নাতো বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা? মনে প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দেয়। কিন্তু সাকিব ও মুশফিক মিলে কি দুর্দান্ত ব্যাটিংই না করলেন। সাকিব ধুন্ধুমার ব্যাটিং করে গেলেন। মুশফিক উইকেট আঁকড়ে থাকলেন। সুযোগ পেলেই বাউন্ডারি হাঁকালেন। আর সাকিব একের পর এক বাউন্ডারি হাঁকাতে থাকলেন। সাকিব অর্ধশতক করলেন। ক্যারিয়ারের চতুর্থ শতক করলেন। মুশফিকও অর্ধশতক করলেন। ক্যারিয়ারের চতুর্থ শতক হাঁকালেন। দুইজন মিলে দলকে ৩০০, ৪০০ রানে নিয়ে গেলেন। একটা সময় দুইজন ১৫০ রানও করলেন। দলও ৫০০ রানে চলে গেল। নিউজিল্যান্ড বোলাররা কিছুই করতে পারলেন না। শুধু দুইজনের কীর্তি গড়া দেখে গেলেন। ৫১৯ রানে যেতেই মুশফিক আউট হয়ে গেলেন। ২৬০ বলে ২৩ চার ও ১ ছক্কায় ১৫৯ রান করে বোল্টের বলে উইকেটরক্ষক ওয়াটলিংয়ের হাতে ধরা পড়লেন। তখন গিয়ে দুইজনের জুটি ভাঙ্গল। যে জুটি রেকর্ডও গড়ল। বাংলাদেশের পক্ষে যে কোন উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটির রেকর্ড হলো। এর আগে দুই ওপেনার তামিম ও ইমরুল মিলে যে কোন উইকেটে বাংলাদেশের পক্ষে ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩১২ রানের সর্বোচ্চ জুটি গড়েছিলেন। সাকিব ও মুশফিক এ জুটিকেও ছাপিয়ে গেলেন। নিউজিল্যান্ডের মাটিতেও রেকর্ড হয়েছে। বিদেশী দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড গড়েছেন এ দুই ব্যাটসম্যান। প্রায় ৪৪ বছর আগে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের আসিফ ইকবাল ও মুসতাক মোহাম্মদ চতুর্থ উইকেটে ৩৫০ রানের জুটি গড়েছিলেন। সেটিই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বিদেশী কোন দলের সর্বোচ্চ জুটি ছিল। এবার সেটিকেও ছাড়িয়ে গেল সাকিব-মুশফিকের জুটি। শুধু তাই নয়, নিউজিল্যান্ডের মাটিতে পঞ্চম উইকেট জুটিতে সর্বোচ্চ রানের জুটির রেকর্ডটি সাকিব-মুশফিকই গড়েছেন। এত দুর্দান্ত কিছু হওয়ার পর কি আর বাংলাদেশের দিন না হয়ে পারে। দ্বিতীয়দিনটি তাই পুরোপুরি বাংলাদেশেরই হয়ে রইল। মুশফিক যখন আউট হন, তখন সাকিবের স্কোরবোর্ডে ২০৫ রান জমা ছিল। দেশের হয়ে প্রথম ডাবল শতক করা মুশফিকের ২০০ রান এরই মধ্যে অতিক্রম করে ফেলেন। তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ডাবল শতক করেন সাকিব। আর ২ রান করলেই দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান করা তামিম ইকবালের ২০৬ রান অতিক্রম করে সেরার আসনে বসবেন সাকিব। এমন পরিস্থিতিতে তাও করে দেখালেন সাকিব। প্রথমবার ডাবল শতক করলেন। সেটি আবার রেকর্ডময় হয়ে থাকল। শেষ পর্যন্ত ২৭৬ বলে ৩১ চারে ২১৭ রানে গিয়ে যখন থামেন সাকিব, তখন দলের স্কোরবোর্ডে ৫৩৬ রান জমা হয়ে যায়। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ এর আগে একবারই ৫০০ রানের বেশি করতে পেরেছে। সেটি ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গলে। ৬৩৮ রান করেছিল দল। তবে সেটি ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ছিল। সেই সঙ্গে একদিনে (তৃতীয়দিনে) ৩০৩ রান যোগ করতে পেরেছিল। এবারতো দুইজন মিলে দ্বিতীয়দিনে বাংলাদেশ ৩৮৮ রান করে। এখন ব্যাট হাতে আছেন সাব্বির রহমান রুম্মন (১০*)। মুশফিক, সাকিবের পর মেহেদী হাসান মিরাজও আউট হয়ে যান। ব্যাট হাতে নামার মধ্যে তাসকিন, শুভাশীষ, রাব্বি আছেন। শেষের তিনজনকে নিয়ে এখন সাব্বির কিছুটা এগিয়ে যেতে পারলেই হয়। তাহলেই নিউজিল্যান্ডকে আরও চাপে ফেলা যাবে। তখন ফল বাংলাদেশের হাতেও ধরা দিতে পারে। ওয়ানডে ও টি২০’র পর মনে হচ্ছিল টেস্টেও বাজে অবস্থা হবে বাংলাদেশের। অথচ কি সুন্দরভাবে ঘুরে দাঁড়াল দল। নির্ধারিত ওভারে বেহাল দশার কোন ছোয়াই নেই ব্যাটিংয়ে। তামিম ও মুমিনুল মিলে আগেরদিন যে ভিত গড়ে দিয়েছেন, তাতে চড়ে বড় ধরনের সাফল্যই মিলল। আর তা হলো, সাকিব-মুশফিকের রেকর্ড জুটিতেই। এ জুটিতে বিদেশের মাটিতে চমক জাগালো বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে ম্যাচের প্রথম ইনিংসে খেলতে নেমে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান করার ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ। দেশের জন্য কিছু করতে পেরে সাকিব নিজেও গর্বিত। সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার ও ওপেনার তামিম ইকবালের পর তিন হাজার রান করা সাকিব বলেছেন, ‘আমরা ওয়ানডে ও টি২০তে ভাল করতে পারিনি। অন্তত কাগজে-কলমে সে রকমই মনে হবে। টেস্টে ভাল কিছু করা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তো অবশ্যই। দেশের জন্যও। আমার এই ইনিংস দলকে ভাল জায়গায় নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে, সেই তৃপ্তি আছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি এমন একটা ইনিংস খেলতে পেরেছি।’ মুশফিকও আনন্দিত। তবে এখনই তা প্রকাশ করতে নারাজ। বলেছেন, ‘মাত্র দুইদিনের খেলা শেষ হলো। এখনও তিনদিন আর তিন ইনিংস বাকি। আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, তাতে অনেক তৃপ্তি তো আছেই। উইকেট অনেক ভাল আচরণ করছে। তবে এই উইকেটে নিয়ন্ত্রিত বোলিং করলে নিউজিল্যান্ডের জন্য কাজটা অনেক কঠিন হয়ে যাবে।’ বাংলাদেশের বোলাররা নিয়ন্ত্রিত বোলিং করে নিউজিল্যান্ডের কাজটা এখন কঠিন করে তুললেই হয়। তাতে বাজিমাতও হতে পারে। দ্বিতীয়দিনে বিশাল স্কোর গড়ে ইতিহাস গড়া হয়েছে। যদি শেষ পর্যন্ত জয় মিলে যায়, তাহলে আগের সব সাফল্যকেইতো পেছনে ফেলা হয়ে যাবে।
×