ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সিয়াম সাধনা ও বদলে যাওয়া দিন

তারাবি নামাজের সেকাল-একাল

সাজেদুর রহমান শিলু

প্রকাশিত: ০১:১৩, ২৯ মার্চ ২০২৪

তারাবি নামাজের সেকাল-একাল

তারাবির নামাজে ব্যাস্ত মুসল্লিরা

প্রায় তিন দশক ধরে বিভিন্ন মসজিদে তারাবি নামাজ পড়াচ্ছেন মাওলানা মো. সফিকুল ইসলাম। তারাবির মধুর ও বেদনাবিধুর অভিজ্ঞতায় পূর্ণ তার জীবনের ঝাঁপি। একান্ত আলাপচারিতায় তিনি জানান, তারাবির সেকাল-একালের নানা প্রসঙ্গ। তিনি তুলে ধরেন তখনকার তারাবি আর এখনকার তারাবির দৃশ্যপটের বেশকিছু পরিবর্তন। পরিবর্তন বিষয়ে তিনি বলেন, দেশে হাফেজের সংখ্যা বেড়েছে, মসজিদের সংখ্যা বেড়েছে।

মানসম্পন্ন তেলাওয়াতের প্রতি মুসল্লিদের আগ্রহ জেগেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে মক্কা-মদিনাসহ বিশ্বের বড় বড় মসজিদের তারাবি সম্পর্কে আমরা ধারণা পাচ্ছি। আমরাও সেরকম তারাবি পড়তে ও পড়াতে তাগিদ দিচ্ছি। এটা একটা ইতিবাচক পরিবর্তন।
তিনি বলেন, একটা সময় ছিল, যখন রমজান শেষেও বছরের বিভিন্ন সময় মুসল্লি ও মসজিদ কমিটির লোকজন হাফেজদের খোঁজ-খবর রাখতেন। চিঠি পাঠাতেন।

টেলিফোন করতেন। বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসতেন। এখন এ চর্চাগুলোও দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো মসজিদ কমিটি ও মুসল্লির ব্যবহার দেখলে মনে হয়, টাকা দিয়ে চাকর রেখেছেন তারা। আসলে হাফেজরা কারও চাকর নন। তারা টাকার জন্যও তারাবি পড়ান না। তারাবি হলো কুরআন মুখস্থ রাখার একটা সুযোগ। হাফেজরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কুরআন হেফাজতের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাই হাফেজদের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করা, তাদের প্রতি মহব্বত রাখা কুরআনপ্রেমীদের সহজাত বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত বলে মনে করি।
মাওলানা মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, আগে আমরা একজনই ২০ রাকাত তারাবি নামাজ পড়াতাম। ধীরে ধীরে কুরআন তেলাওয়াত করতাম। বর্তমানে প্রায় সব মসজিদে ২ থেকে ৩ জন পর্যন্ত হাফেজ দিয়ে ২০ রাকাত তারাবি পড়ানো হচ্ছে। এখন অনেক মসজিদে ঝড়ের গতিতে তেলাওয়াতের মাধ্যমে তারাবি পড়ায়, কি পড়ে সে ইমাম ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। এই সংস্কৃতি দূর করতে হবে। কারণ বেশিরভাগ মুসল্লি এখনো তারাবি তাড়াতাড়ি শেষ হলে বাঁচে, এমন মনে করে। তাদের এ ধারণা দূর করার দায়িত্ব ইমামদেরই। অথচ তারাই এভাবে পড়িয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, তারাবি বা কিয়ামুল লাইল হলো রাতের একটি বিশেষ সুন্নত নামাজ, যেটি মুসলিমগণ রমজান মাসব্যাপী প্রতি রাতে এশার ফরজ নামাজের পর দীর্ঘ তেলাওয়াতসহকারে পড়ে থাকেন। তারাবি সালাত জোড়া জোড়া রাকাত করে যেকোনো জোড়সংখ্যক রাকআত পড়ানো হয়। তারাবি সালাতের পর বেতের সালাত পড়া হয়। তারাবির নামাজের রাকআত নির্দিষ্ট করা হয়নি। হানাফি, শাফিয়ি ও হাম্বলি ফিকহের অনুসারীরা ২০ রাকাত, মালিকি ফিকহের অনুসারীরা ৩৬ রাকাত এবং আহলে হাদিসরা ৮ রাকাত তারাবির নামাজ পড়েন। আবার অনেক হানাফিরাও ৮ রাকাত তারাবি পড়ে থাকেন। 
দিনাজপুর শহরের পশ্চিম বালুয়াডাঙ্গা ‘বায়তুল আমান’ জামে মসজিদের বর্তমান ইমাম মাওলানা মো. সফিকুল ইসলাম ২৯ বছর ধরে বিভিন্ন মসজিদে তারাবির নামাজ পড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, অতীত ও বর্তমানে তারাবি নামাজের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন রকম। তিনি বলেন, মূলত মাহে রমজানে এশার ফরজ ও সুন্নত নামাজের পর বেতের নামাজের আগে তারাবির নামাজ আদায় করতে হয়। সাধারণ নফল ও সুন্নতের চেয়ে অধিকতর মর্যাদাবান, গুরুত্বের দিক থেকে তারাবির নামাজ সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ, যা ওয়াজিবের কাছাকাছি।
তারাবি আরবি শব্দ, যা তারাবিাতুন শব্দের বহুবচন; যার অর্থ হলো- আরাম, প্রশান্তি অর্জন, বিরতি দেওয়া, বিশ্রাম নেওয়া ইত্যাদি। যেহেতু ২০ রাকাত তারাবির নামাজ প্রতি চার রাকাত অন্তর, চার রাকাত নামাজের সমপরিমাণ সময় বিরতি দিয়ে আরামের সঙ্গে আদায় করা হয়, সে জন্য এ নামাজকে তারাবির নামাজ বলা হয়। 
মাওলানা মো. সফিকুল ইসলাম আরও বলেন, আমাদের দেশে দুই ধরনের তারাবি প্রচলিত। একটি হলো- সুরা তারাবি এবং অন্যটি হলো- খতম তারাবি। সুরা তারাবি হলো- পবিত্র কুরআনের যে কোনো সুরা দিয়ে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা। আগে অধিকাংশ মসজিদে পবিত্র রমজান মাসে সুরা তারাবি পড়া হতো। খতম তারাবি হলো- রমজান মাসে সম্পূর্ণ কুরআনসহকারে তারাবি আদায় করা।

উভয় পদ্ধতিই ইসলাম অনুমোদন করে। তবে খতম তারাবিতে সওয়াব বেশি। রমজান মাস কুরআন নাজিলের মাস। তারাবির নামাজের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য কুরআন তেলাওয়াত করা ও শোনা। এ নামাজে পূর্ণ কুরআন শরিফ একবার পাঠ করা সুন্নাত। একে খতম তারাবি বলা হয়। সুরা তারাবির মাধ্যমে নামাজ আদায় করলেও নামাজ আদায় হবে।
তিনি বলেন, জামাতের সঙ্গে সালাতুত তারাবির বর্তমান নিয়মটি চালু হয়েছে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর সময় থেকে। এর আগে অর্থাৎ রাসুলে পাক (সা.) ও হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর সময়ে এমনকি হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর খেলাফতকালের প্রথম ভাগেও মুসলমানরা রমজানের রাতগুলোয় এশার নামাজের পর অতিরিক্ত যে সালাত আদায় করতেন, তা একাকী করতেন। এ জন্য জামাত বা সম্মিলিত কিছুর আয়োজন ছিল না। তবে নবী করিম (সা.) রমজানে কিয়ামুল লাইল বা রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগির বিশেষ উৎসাহ দিয়েছেন এবং এ জন্য অশেষ পুরস্কারের সুসংবাদ দিয়েছেন।
একই মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মো. ফারুক সিদ্দিকী বলেন, কুরআন মাজিদের বড় বড় সুরা সবার মুখস্থ থাকে না। এসব দিক বিবেচনা করে সবার জন্য যা সহজ হয়, তারই ব্যবস্থা করলেন হজরত ওমর ফারুক (রা.)। ২০ রাকাত নামাজ আদায় করতে গিয়ে প্রতি চার রাকাতের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার রীতি ছিল। কেননা এই সালাত আদায় করা হয় দীর্ঘ সময় ধরে। আরবিতে তারাবিা অর্থ বিশ্রাম।

আর তারাবি শব্দের বহুবচন তারাবি। তারাবি নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায়ের কারণে রোজাদার মুসলমানদের মধ্যে গড়ে উঠতে পারে ঐক্য ও সম্প্রীতির দৃঢ় বন্ধন। এ জন্য হজরত ওমর (রা.)-এর সময় থেকে এ পর্যন্ত সারা বিশে^ মুসলমানদের মধ্যে রমজানুল মুবারকে সিয়াম সাধনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গেছে তারাবি সালাতের জামাত।

বাংলাদেশের শহর এলাকার বেশিরভাগ মসজিদে এখন খতম তারাবি হয়ে থাকে। ফলে যারা নিয়মিত তারাবি নামাজে অংশ নেন, তাদের পক্ষে পুরো কুরআন মাজিদ একবার শোনার সুযোগ হয়। অতএব বিশেষ কোনো অসুবিধা না থাকলে রমজান মাসে সিয়াম পালনের পাশাপাশি সালাতুত তারাবিতে নিয়মিত যোগদানে সচেষ্ট থাকা উচিত।

সাজেদুর রহমান শিলু, দিনাজপুর

×