ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

‘বিরাট রাজবাড়ি’র প্রাচীন নিদর্শন

প্রকাশিত: ০২:০৪, ২২ মার্চ ২০২৪

‘বিরাট রাজবাড়ি’র প্রাচীন নিদর্শন

‘বিরাট রাজার ঢিবি’ নামে বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শন হাজারো দর্শক প্রতিদিন দেখতে আসে

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজাবিরাট এলাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ‘বিরাট রাজার ঢিবি’ নামে বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শন। এলাকার মানুষসহ অনেক দূর-দূরান্তের লোকজনও তা জানতেন। তাদের দীর্ঘদিনের দাবিও ছিল প্রতœতাত্ত্বিক খনন করে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো উদ্ধার ও সংরক্ষণ করার। অবশেষে এ দাবি পূরণ হয়েছে। শুরু হয়েছে রাজাবিরাটের ‘বিরাট রাজার ঢিবি’ নামের সবচাইতে বড় ঢিবিটির প্রতœতাত্ত্বিক খননের কাজ।

গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে বিরাট রাজার ঢিবির খনন কাজ শুরু করেছে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানার নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি খনন দল। খনন কাজ শুরুর পর বেরিয়ে এসেছে পোড়া ইটের চওড়া দেওয়াল, ইটের অবকাঠামোসহ নানা নিদর্শন। খননে প্রতিদিন দৃশ্যমান হচ্ছে কালো পাথরের তৈরি পিলারের ভিত্তিভাগ, নক্সা করা পোড়ামাটির ফলকে পাখির নিদর্শন, অলঙ্কৃত ইট ও পোড়ামাটির পাত্রের ভাঙা অংশসহ বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শন।
প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন, এখানকার প্রতœস্থাপনা এবং নিদর্শনগুলো অন্তত ১ হাজার ৩০০ বছর আগের।

তবে ঢিবিতে প্রাপ্ত স্থাপনা উপাসনালয় নাকি আবাসস্থল সে বিষয়ে এখনই স্পষ্ট কিছু জানাননি খনন কাজে অংশ নেওয়া দায়িত্বশীল কেউ। তবে তারা জানিয়েছেন, এ স্থাপনায় ইটের তৈরি দেওয়ালের গাঁথুনিতে বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বেষ্টনী দেওয়ালগুলো তৈরি করা হয়েছে কুচি ফর্মে যা দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয়। তারা বলছেন, খনন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ সম্পর্কে জানার জন্য আরও খনন করা প্রয়োজন। খনন কাজ শেষ হলে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।
খননকারী দলের প্রধান ড. নাহিদ সুলতানা জনকণ্ঠকে জানান, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজাবিরাট এলাকার এই প্রতœতাত্ত্বিক স্থাপনায় প্রথমবারের মতো খনন কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। খননে বেরিয়ে আসছে প্রাচীন ও মধ্যযুগের কিছু অবকাঠামো। গত ডিসেম্বর খনন কাজ শুরুর পর থেকে বেশকিছু প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে। এখনো এ খনন কাজ অব্যাহত আছে। 
তিনি জানান, এ অবকাঠামো কত বছর আগে তৈরি হয়েছে, তা সঠিকভাবে এখন বলা সম্ভব নয়। তবে অবকাঠামোর ধরন দেখে অনুমান করা হচ্ছে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম এবং একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে দুটি পর্যায়ে ব্যবহার করা হয়েছে। এ নির্মাণ সম্পর্কে সঠিক সময় নির্ধারণ করার জন্য আরও খনন ও গবেষণা প্রয়োজন। এমনকি কার্বন ডেটিং প্রয়োজন হতে পারে। ড. নাহিদ আরও জানান, খনন পুরোপুরি শেষ হলে দর্শকদের জন্য এটি সংরক্ষণ করা হবে।
স্থানীয়রা বলছেন, এখানে প্রাচীন একটি দুর্গনগরী ছিল। এর নিরাপত্তার জন্য ছিল সু-উচ্চ প্রাচীর এবং প্রাচীরের বাইরে প্রশস্ত ও সুগভীর পরিখা। সনাতন ধর্মে যে বিরাট রাজার ইতিহাস রচিত হয়েছে সেই বিরাট রাজার বসতি ছিল এখানে। তিনি এখানে বসে বিচার কাজ চালাতেন। 
তারা বলছেন, বিরাট রাজার গো-শালা বা গো-চারণভূমি ছিল গাইবান্ধা এলাকায় এবং সে থেকেই সদর উপজেলা ও জেলার নাম হয়েছে গাইবান্ধা। ইতোপূর্বে রাজার গো-চারণভূমির সন্ধান পাওয়া গেলেও ‘বিরাট রাজার রাজ্য বা বাসস্থানের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নাই। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজাহার ইউনিয়নের রাজাবিরাট বাজার সংলগ্ন ‘বিরাট’ নামের এই গ্রামটিতে অবস্থিত উত্তরাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতœতাত্ত্বিক স্থান ‘বিরাট রাজার ঢিবি’-তে সম্প্রতি প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর জরিপ ও অনুসন্ধান পরবর্তী খনন কাজ শুরু করলে মাটির নিচে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় প্রতœ-স্থাপনার সন্ধান পান, এই প্রতœ-স্থাপনাটিকেই তারা বিরাট রাজার প্রাসাদ বলে মনে করছেন। 
অন্যদিকে প্রতœতাত্ত্বিকরা বলছেন, বর্তমানে ঢিবিটির আকার ৫০ মিটার এবং প্রস্থ ৩৫ মিটার এবং উচ্চতা ৪ মিটার। এর আশপাশে আরও ৪টি ঢিবি রয়েছে। বর্তমান খননে ধারণার চেয়ে অধিক বড় আকারের অবকাঠামো পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত এখানে পোড়ামাটির ভগ্নাংশ, পোড়ামাটির ফলক, অলঙ্কৃত ইট (সাধারণত ধর্মীয় উপাসনালয়ের সাজ-সজ্জায় ব্যবহৃত হয়), ভিত্তিপ্রস্তর পিলার পাওয়া গেছে। যা প্রাচীনতত্ত্বের সাক্ষ্য বহন করে। তারা বলছেন, এ স্থাপনায় ইটের তৈরি দেওয়ালের গাঁথুনিতে বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বেষ্টনী দেওয়ালগুলো তৈরি করা হয়েছে কুচি ফর্মে যা দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয়। তবে নিদর্শনগুলো ঠিক কোন আমলের এবং কারা এখানে বাস করতেন বা কাদের রাজ্য ছিল- বৃহৎ আকারে খনন কার্য সম্পূর্ণ না হলে তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। খননকারী দল এখন পর্যন্ত প্রাচীন দুর্গনগরীর কোনো চিহ্ন খুঁজে পাননি। তবে ধারণা করা হচ্ছে মূল অবকাঠামোর সঙ্গে আরও দুই-তিনটি মন্দিরের সংযোগ সড়ক ছিল যা বর্তমানে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক রাখালরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় এই স্থান সম্পর্কে লিখেছেন যে, ১৯১০ সালের দিকে বিরাটনগর এলাকা থেকে ব্রোঞ্জ নির্মিত অত্যন্ত চমৎকার পাঁচটি বিষ্ণুমূর্তি পাওয়া যায়। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ নাগরিক মেজর শেরউইলের মানচিত্রে বিরাটনগরকে ‘ব্রাদ রাজার গড়’ বলে চিহ্নিত করা হয়। এ বিরাটনগরকে কেন্দ্র করে অসংখ্য প্রাচীন অবকাঠামোর ধ্বংসাবশেষ এখনো ছড়িয়ে আছে। তবে এগুলোর কোনো অনুসন্ধান ও জরিপ এখনো করা হয়নি বলে জানান প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। 
খাজা এম.এ কাইয়ুম নামের স্থানীয় গবেষক দীর্ঘ ৪০ বছর বিরাট রাজার ঢিবি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার নোটবুকের তথ্যানুসারে, বিরাট রাজা পুরো ভারতবর্ষে মৎস্যরাজ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই অঞ্চলে মাছ চাষের জন্য তিনি ৯৯৯টি পুকুর খনন করেন। রাখাল রাজ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২৫-২৬ সালে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ১৯০৫ সালের দিকেও এ স্থানটি জঙ্গলে ঘেরা ছিল। কয়েক দশক আগে সাঁওতালরা জায়গাটি পরিষ্কার করে ঘরবাড়ি তৈরি করেন।
প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত খনন দলের ৮ সদস্য হলেন- ড. নাহিদ সুলতানা, ড. আহমেদ আবদুল্লাহ, রাজিয়া সুলতানা, হাবিবুর রহমান, এস.এম হাসানাত বিন ইসলাম, মো. আবুল কালাম আজাদ, তারিকুল ইসলাম ও উম্মে সালমা ইসা। এছাড়া আরও ২০ জন শ্রমিক খনন কাজে নিয়োজিত আছেন। রাজাবিরাট এলাকায় আরও বেশ কিছুদিন খনন করা হবে বলে জানান খনন দলের প্রধান ড. নাহিদ সুলতানা। খনন করার পর আরও আকর্ষণীয় অবকাঠামো এবং পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়া যেতে পারে, যা থেকে প্রতিটি যুগ পৃথকভাবে উপস্থাপন করা যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।     
    মনজুর হাবীব মনজু, গোবিন্দগঞ্জ,গাইবান্ধা

×