ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরাঞ্চলে কৃষির বহুমুখীকরণ

ফুল ও ফলের যুগপৎ আবাদ, চাঙ্গাভাব অর্থনীতিতে

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ০০:১৯, ১৪ মার্চ ২০২৪; আপডেট: ১০:৫৩, ১৪ মার্চ ২০২৪

ফুল ও ফলের যুগপৎ আবাদ, চাঙ্গাভাব অর্থনীতিতে

উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীতে চাষ হচ্ছে বিভিন্ন জাতের ফল ও ফুল

দিনবদলের অংশ হিসেবে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি বদলে গেছে। ধান পাট, গম, ভুট্টা ফসলের পাশাপাশি সবজি, মাছ, মুরগি, গবাদি পশুর উৎপাদন বেড়েছে। অনেক বেশি এগিয়ে গেছে ফুল-ফল উৎপাদন। এতে অনেক শিক্ষিত উদ্যমী তরুণ উদ্যোক্তা যুক্ত হচ্ছেন। তাদের কারণেই কৃষি আজ উদ্যমী উদ্যোক্তাদের কাছে সবচেয়ে আশা-জাগানিয়া এক ভরসার খাত হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের নয়া কৃষির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এই খাতে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বলা যেতে পারে স্মার্ট বাংলাদেশের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার লক্ষ্যে যান্ত্রিকীকরণ, পেমেন্ট পদ্ধতি এবং সরবরাহ চ্যানেল ডিজিটাল করার জন্য নানামুখী নীতি-সমর্থন দিয়ে চলেছেন। 
এক সময় বৃহত্তম রংপুর অঞ্চলে অভাব অনটন লেগে থাকত। ফসলের বহুমুখী রূপরেখার প্রচলন না থাকায় বিস্তৃত এলাকার ফসলি জমি পতিত হিসেবে পড়ে থাকত। ফলে ঘরে ঘরে দেখা দিতো মঙ্গা বা অভাব। এতে রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম,  লালমনিরহাটের  অধিকাংশ মানুষ কর্মের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে ছুটে যেতে বাধ্য হতো। এখন বদলে গেছে দৃশ্যপট। কৃষির বহুমুখীকরণের সুবাদে এখন বিভিন্ন জাতের ফল, ফুল, সবজি ও ডাল শস্যের বাণিজ্যিক আবাদে ঝুঁকছেন কৃষক ও শিক্ষিক তরুণ যুবকরা। 
পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বর্তমানে আবাদ প্রবৃদ্ধির দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ফল ও ফুল। একইসঙ্গে সবজি, ধান ছাড়া অন্যান্য খাদ্যশস্য, তেলবীজ, মসলাপণ্য ও ডাল শস্যের আবাদ ও মাছ চাষ সম্প্রসারণ হয়েছে ব্যাপক হারে। বলতে গেলে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ ও বহুমুখীকরণে জোর দিয়ে সরকার ও ব্যক্তি খাতের পক্ষ থেকে নেয়া বেশকিছু উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় অন্যান্য শস্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদনের দিকেও এখন আগ্রহী হয়ে উঠেছেন অনেকেই। 
সাম্প্রতিক সময়ে দেশেই কুল, তরমুজ ও বাঙ্গিসহ বিভিন্ন ফলের উৎপাদন বেড়েছে। পাশাপাশি আবাদ বাড়ছে নতুন জাতের আম, মাল্টা, কমলা, ড্রাগন, স্ট্রবেরি ফলসহ বিভিন্ন বিদেশী জাতের ফলের। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলে ফুলের বাণিজ্যিক চাষও বেড়েছে।  সব মিলিয়ে গত এক দশকে দেশে ফুল ফলের আবাদ এলাকার সম্প্রসারণ হয়েছে প্রায় ১০২ শতাংশ।

ফলের বাণিজ্যিক আবাদ বৃদ্ধিতে কৃষকরা যেমন লাভবান হয়েছেন, তেমনি ভোক্তা পরিম-লেও এখন ফলের প্রাপ্যতা আগের চেয়ে অনেক বেশি। বর্তমানে গোটা বছরজুড়েই মৌসুমি দেশী ফলের পাশাপাশি বারোমাসি ও বিদেশী ফলেরও আবাদ করছেন কৃষকরা। অন্যদিকে  বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল চাষ শুরু হয়। বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার কৃষক ফুল চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। 
দেশে ধান ছাড়া অন্য যেসব খাদ্যশস্যের উৎপাদন এখন বাড়তির দিকে সেগুলোর মধ্যে এখন ভুট্টাই সবচেয়ে এগিয়ে। যদিও ভুট্টার সবচেয়ে বেশি প্রচলন গোখাদ্য ও মৎস্য খাদ্য হিসেবে। গত এক দশকে শস্যটির আবাদ বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। অন্যদিকে উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। ভুট্টা সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, লালমনিরহাট,  ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারীতে।

উপযোগী আবহাওয়া, মাটি ও উচ্চফলনশীল জাত কাজে লাগিয়ে দেশে এখন আলুর আবাদও বাড়ছে ব্যাপক হারে। দেশে আলুর উৎপাদন এখন প্রায় এক কোটি টন। গত এক দশকে দেশে পণ্যটির আবাদ সম্প্রসারণ হয়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ। উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের তালুক কালোয়া গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার গ্লাডিওলাস ফুল চাষ করছেন কৃষক মো. নুরবখত আলী। গ্লাডিওলাস ফুলের পাশাপাশি তার জমিতে গাঁদা ফুল, সূর্যমুখী ফুল চাষ হচ্ছে। ৫০ শতক জমিতে  ফুল চাষি মো. নুর বখত বলেন, গ্লাডিওলাস ফুল চাষ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামার বাড়ি থেকে ২০১৮-১৯ সালে প্রদর্শনী প্লট করি।

ওই প্রর্দশনী প্লটে ফুলের সমাহার দেখে পরের বছর ফুল চাষে উদ্বুদ্ধ হই। এখন প্রায় তিন একর জমিতে প্রচলিত কৃষি আবাদ না করে তেল বীজ ও ফুল জাতীয় চাষ করছি। বিশেষ করে কম সময়ের মধ্যে খেত থেকে গ্লাডিওলাস ফুল বাজারজাত করা সম্ভব। বাজারে সারাবছর ফুলের চাহিদা থাকে। প্রতি স্টিক ৫-২৫ টাকা দরে বিক্রি করছি। এ ফুল চাষে বাড়তি খরচ ও পরিচর্যার ঝামেলা নেই। সামান্য সেচ, সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে এই ফুল চাষ করা সম্ভব।
নুরবখতের ছেলে মো. শাহাজাহান আলী বলেন, গ্লাডিওলাস ফুল চাষ করে লাভবান হচ্ছি। অন্যান্য  আবাদের চেয়ে এই ফুল চাষে খরচ কম লাভ বেশি। সঠিক সময়ে খেত থেকে ফুল তুলতে পারলে ভালো দাম পাওয়া যায়। এ ছাড়া নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুরে ব্যাপক হারে কুল পেয়ারা স্ট্রবেরির বাগান তৈরি করা হয়েছে।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক ওবায়দুর রহমান ম-ল বলেন, কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। প্রচলিত কৃষি কাজের বাইরে অর্থাৎ ধান-পাট এসব চাষের বাইরে কৃষির বিভিন্ন উপখাত যেমন- মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগির খামার, পশু পালন, দুগ্ধ খামার ছাড়াও বছরব্যাপী সবজি ও ফলের চাষ ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এর ফলে যেমন বহু বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে, তেমনি চাঙ্গা হয়েছে উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতি।

×