ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

নীলফামারী ও গাইবান্ধা

খননে বের হয়ে আসছে বৈদিক যুগের পাণ্ডবদের প্রাসাদ

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী ও আবু কায়সার শিপলু, গাইবান্ধা

প্রকাশিত: ০০:২৫, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

খননে বের হয়ে আসছে বৈদিক যুগের পাণ্ডবদের প্রাসাদ

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মাটি খনন করে বৈদিক যুগের পাণ্ডবদের প্রাসাদ ও মন্দিরের অংশ বিশেষ চিহ্নিত করেছে

উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীর গোড়গ্রাম থেকে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় দুইশ’ কিলোমিটার জুড়ে বিরাটরাজার পদচারণা ছিল। ফলে অনেক মাটির ঢিবি দেখা যায়। ঢিবিগুলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খনন করছে দেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। খননে মিলছে মাটিতে দেবে যাওয়া বিরাট রাজা তথা বৈদিক যুগের পাণ্ডবদের প্রাসাদ ও মন্দির। পুরাণ ইতিহাসে গোড় থেকে গাই; যেন একে অপরের নামের সঙ্গে বিরাট রাজার সন্ধি। এ জন্য অনেকে মনে করেন  বিরাট রাজার গোশালা থেকে এসেছে  গোড়গ্রাম ও গাইবান্ধার নামকরণ।
ইতিহাস বলছে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের কারণে নদী তলদেশের উত্থান ঘটলে দেশের উত্তরাঞ্চল স্থলভূমিতে পরিণত হয়। এর পর তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদীবাহিত পলিমাটি দিয়েই গড়ে ওঠে বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া অঞ্চল। সে সময় উত্তরাঞ্চলে একটা সময় বৌদ্ধ, হিন্দু, মোগল, পাঠান আমলসহ ইংরেজ শাসনামলের অসংখ্য ইতিহাস রয়েছে। বিভিন্ন শাসনামলে অনেক সংগ্রাম-বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল।

বিরাটরাজার সেই মাটির নিচে তলিয়ে যাওয়া ঢিবি খননে বের হচ্ছে সেসব স্থাপনা ও  প্রাসাদ। খনন কাজে যুক্ত আছেন রংপুর জাদুঘরের (তাজহাট জমিদার বাড়ি) কাস্টোডিয়ান হাবিবুর রহমান, মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান রাজিয়া সুলতানা, রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের নকশা অঙ্কনকারী উম্মে সালমা ইসা, প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক ড. আহমেদ আবদুল্লাহসহ শ্রমিক-কর্মচারী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতিহাস ঘেটে নীলফামারীর গোড়গ্রামের খনন কাজ শেষে এখন খনন চলছে গাইবান্ধা এলাকায়। পাওয়া যাচ্ছে অনেক কিছুই। হিন্দু শাস্ত্রমতে, খ্রিস্টপূর্ব নবম হতে অষ্টম শতকে পা-বরা কৌরবদের চক্রান্তের শিকার হয়ে ১২ বছরের বনবাস ও ১ বছরের অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য হন। মৎস্য দেশের রাজা বিরাটের রাজধানী ছিল তৎকালীন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকাজুড়ে। সেই স্থানগুলোতে ছদ্মবেশে বসবাস শুরু করেছিলেন  তারা। 
মহাভারতের কাহিনীতে বলা হয়েছে, এই রাজা বিরাটের রাজসভায় পঞ্চপা-বের দ্রৌপদীসহ ছদ্মবেশে তাদের ১২ বছর নির্বাসনের পরবর্তী ১ বছর অজ্ঞাত বাস করেছে। অজ্ঞাত বাসকালে যুধিষ্ঠির কঙক নামে বিরাটরাজার পাশা খেলার সাথী হয়েছিলেন। আর ভীমের দায়িত্ব ছিল পাঁচকের কাজ করা এবং তার ছদ্মনাম ছিল বল্লভ। বিরাটরাজার মেয়ে বিন্যাবতী হলো রাজকন্যা। উত্তরার নাচ, গান ও বাদ্যযন্ত্র শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অর্জুন বৃহ্ণলা ছদ্মনামে।

গোশালার দায়িত্বে ছিলেন সহদেব তন্তীপাল  এবং অশ্বশালার দায়িত্বে ছিলেন নকূল, তার ছন্দনাম ছিল গ্রন্থিক। আর বিরাটরাজার রানী সুদেষ্ণার গৃহপরিচারিকা হয়েছিলেন সৌরিনদ্রী(সৌরেন্ধ্রী) নামে দ্রৌপদী। বলা হয়ে থাকে, এই বিরাটরাজার গোধনের কোনো তুলনা ছিল না।
তার গাভীর সংখ্যা ছিল ষাট হাজার। মাঝে মাঝে ডাকাতরা এসে বিরাটরাজার গাভী লুণ্ঠন করে নিয়ে যেত। সেজন্য বিরাটরাজা একটি বিশাল পতিত প্রান্তরে গোশালা স্থাপন করেন। গোশালাটি সুরক্ষিত এবং গাভীর খাদ্য ও পানির সংস্থান নিশ্চিত করতে নদী তীরবর্তী ঘেসো জমিতে স্থাপন করা হয়। সেই নির্দিষ্ট স্থানে গাভীগুলোকে বেঁধে রাখা হতো। প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে এই গাভী বেঁধে রাখার স্থান থেকে এতদঞ্চলের কথ্য ভাষা অনুসারে এলাকার নাম হয়েছে গাইবাঁধা এবং কালক্রমে তা গাইবান্ধা নামে পরিচিতি লাভ করে। গাইবান্ধা নামকরণ স¤পর্কে ভিন্ন মতও রয়েছে। 
মনে করা হয়, তখনকার দিনে নির্বাসিত পা-বদের তৃষ্ণা মেটাতে বৈদিক রাজা বিরাট  ৯৯৯টি দীঘি খনন করেছিলেন। কারও কারও মতে, রাজা বিরাট তার  প্রায় ৬০ হাজার  গরু পালের জন্য পানির সংস্থান করতেই দীঘিগুলো খনন করেছিলেন। দীঘিগুলোর মধ্যে নীলফামারী শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার অদূরে গোড়গ্রাম ইউনিয়নে রয়েছে বিন্যাদীঘি (নীলসাগর)। যে দীঘির আয়তন ৫৩ দশমিক ৯০ একর। গভীরতা ২৮ ফুট থেকে ৩২ ফুট পর্যন্ত।

এ ছাড়া নীলফামারীর পাশাপাশি বিরাট রাজার হাজার হাজার গরুর গোশালা ছিল গাইবান্ধায়। গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে গোবিন্দগঞ্জের রাজাহার ইউনিয়নে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর থেকে খনন কাজ শুরু হয়। 
বিশাল এই কর্মযজ্ঞের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মোছা. নাহিদ সুলতানা। তিনি জানান, সরকারি গেজেটে এই এলাকার ১.৪৩ শতক বা এক একর ৫৩ শতাংশ জমি সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। দেড় মাস খনন কাজ শেষে বেশ কিছু প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে। এখনো খনন কাজ অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, বর্তমান খননে ধারণার চেয়ে অধিক বড় আকারের অবকাঠামো পাওয়া গেছে।

এখন পর্যন্ত এখানে পোড়ামাটির ভগ্নাংশ, পোড়ামাটির ফলক, অলঙ্কৃত ইট (সাধারণত ধর্মীয় উপাসনালয়ের সাজসজ্জায় ব্যবহৃত হয়), ভিত্তিপ্রস্তর পিলার পাওয়া গেছে; যা প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য বহন করে। বর্তমানে ঢিবিটির আকার ৫০ মিটার, প্রস্থ ৩৫ মিটার এবং উচ্চতা ৪ মিটার। সূত্রমতে, প্রত্নস্থলটি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এই স্থানকে গুরুত্ব দিয়ে বৃহৎ আকারে খনন কাজ পরিচালনা করে জায়গাটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে এবং সেই সঙ্গে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বলেও জানান এই আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা।
কাস্টোডিয়ান হাবিবুর রহমান জানালেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খনন করা হচ্ছে। সেই কারণে কাজের গতি ধীর। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এটিকে প্রাচীন কোনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ বলেই মনে হচ্ছে। তবে এটি হিন্দু না বৌদ্ধ মন্দির এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে চাননি।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষক অধ্যক্ষ জহুরুল কাইয়ুম বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর ঢিবিটির প্রাচীনত্ব ও গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ১৯৮৭ সালের ১৯ মার্চ সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করে। তবে সেই সময় শুধু একটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়। এখন প্রতœতত্ত্ব বিভাগের তরুণ কর্মকর্তারা যতেœর সঙ্গে কাজ করছেন। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও লোকবল বাড়ানো হলে হাজার বছরের অজানা ইতিহাস প্রামাণিকভাবে আমাদের সামনে আসবে।
এদিকে প্রায় হাজার বছরের পুরনো বৈদিক যুগের বিরাট রাজার প্রাসাদ ও মন্দিরের সন্ধান মিলেছে। এটি পাওয়া গেছে নীলফামারী জেলা সদরের গোড়গ্রাম ইউনিয়নের বিন্যাদীঘি তথা নীলসাগর পাড়ের ঢিবিতে। পরীক্ষামূলক অনুসন্ধানের সময় প্রতœতত্ত্ববিদরা এটি আবিষ্কার করেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই স্থানের খনন কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর পর এখনো চলছে। চলমান খনন কাজে এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে দীঘির চারদিকে ঢিবি। চারদিক ঘিরে বিরাট রাজার কন্যা বিন্যাবতীর রাজপ্রাসাদ ও পূজার জন্য মন্দির, যা কালের আর্বতে মাটির নিচে তলিয়ে যায়।
এখন সেগুলোই খননের মাধ্যমে সন্ধ্যান করা হচ্ছে। নীলফামারী সদর উপজেলার জিরোপয়েন্ট চৌরঙ্গী মোড় থেকে উত্তর-পশ্চিম কোণে ১৪ কিলোমিটার দূরে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা মৌজায় ৫৩.৯০ একর জমির ওপর নীলসাগরের এই বিন্যাদীঘির অবস্থান। এর জলভাগ ৩২.৭০ একর এবং চারদিকের ঢিবিপাড়ের জমির পরিমাণ ২১ একরের মতো। দীঘির গভীরতা গড়ে ৩০ ফুট।

সারাবছর দীঘি ভরে পানি থাকে। ১৯৮৩ সালে নীলফামারীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক এম এ জব্বার এই দীঘিকে পর্যটন ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং নীলফামারীর নামানুসারে বিন্যাদীঘির পরিবর্তে এর নামকরণ করা হয় নীলসাগর। 
জানা যায়, ১৮০৭-১৮০৮ সালে ব্রিটিশ প্রতœতত্ত্ববিদ ড. ফ্রান্সিস এ অঞ্চল ভ্রমণ করেছিলেন। সূত্রমতে, রাজা বিরাট আজও স্বনামধন্য এবং রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের এই এলাকাটি বার্ষিক তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। নীলফামারীর এই স্থানে ঐতিহাসিক মৎস্য দেশের রাজধানী ও সনাতন (হিন্দু) সম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থক্ষেত্র রাজা বিরাট। কিংবদন্তি আছে, হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যান মহাভারতের বর্ণনায় রাজা বিরাটের নাম উল্লেখ রয়েছে।

পৌরাণিক কাহিনী মতে, রাজা বিরাট নেপাল রাজ্যের বৈরাট নগরাধিপতি মহারাজ উত্তরের একমাত্র পুত্র ছিলেন। তিনি মৃগয়ার্থে বৈরাটনগর হতে আলোচ্য বিরাটে আগমন করেন। এই বিরাট বনের এক উচ্চভূমিতে রাজবাড়ি ও নগর স্থাপন করেন। মহাভারতে বিরাট রাজাকে বিরাট নামেই অভিহিত করা হয়। তিনি তার রাজ্যে হাজার হাজার দীঘি-পুষ্করিণী খনন করে মৎস্য চাষ করে মৎস্যরাজ বিরাট নামে খ্যাত হয়েছিলেন।

×