ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

তিনশ বছরের পুরনো বাড়ি, অযত্ন- অবহেলায় আজ ভুতুড়ে

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল

প্রকাশিত: ১২:৪৬, ১৩ জানুয়ারি ২০২৪; আপডেট: ১৩:১৯, ১৩ জানুয়ারি ২০২৪

তিনশ বছরের পুরনো বাড়ি, অযত্ন- অবহেলায় আজ ভুতুড়ে

কলসকাঠী জমিদার বাড়ি। ছবি: জনকণ্ঠ

বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠী বাজার সংলগ্ন ঝোপঝার আর লতাপাতায় ঘিরে আছে জানকী বল্লভ রায় চৌধুরী পরিবারের কলসকাঠী জমিদার বাড়ি। ছম ছমে সুনসান নীরবতায় বাড়িগুলো দেখে মনে হবে ভুতুড়ে বাড়ি। প্রায় তিনশত বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত লাগেনি সংস্কারের ছোঁয়া। ইট, সুরকি আর পোড়া মাটির কারুকার্যে ঘেরা প্রায় দুই বিঘা জমি জুড়ে এই জমিদার বাড়ি। অযত্ন আর অবহেলায় আজ ভুতুড়ে রূপ নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জমিদারদের বাড়ি। 

প্রায় তিনশ বছর আগে ১৭শ শতকের শেষের দিকে জানকী বল্লভ রায় চৌধুরী কলসকাঠী জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন গারুড়িয়ার জমিদার রামাকান্তের পুত্র। রামাকান্তের জানকী বল্লভ রায় চৌধুরী ছাড়াও আরো একজন পুত্র ছিল। জানকী বল্লভ রায় চৌধুরী ছিলেন ছোট। আর তার বড় ভাই ছিলেন রাম বল্লভ। বিভিন্ন কারণে রামাকান্ত তার বড় পুত্রকে বাদ দিয়ে ছোট পুত্র জানকী বল্লভ রায় চৌধুরীকে জমিদারি দেন। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে রাম বল্লভ ছোট ভাই জানকী বল্লভ রায়কে হত্যার পরিকল্পনা করেন। মূলত জমিদারি পাবার জন্যই এই হত্যার পরিকল্পনা করেন রাম বল্লভ। 

তবে জানকী বল্লভ রায় চৌধুরী তার বৌদির মাধ্যমে এই ব্যাপারটি জানতে পারেন। পরে রাতের আঁধারে তিনি মুর্শিদাবাদে চলে যান এবং সেখানে নবাবের কাছে এই বিষয়ে জানান। তখন মুর্শিদাবাদের নবাব তাকে রংপুর পরগনার জমিদার হিসেবে নিযুক্ত করেন। তৎকালীন সময়ে কলসকাঠীতে ১৩ জন জমিদারের বাস ছিল। তাদের আলাদা আলাদা জমিদার বাড়িও ছিল। তারা মূলত এই জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তনকারী জানকী বল্লভ রায় চৌধুরীর বংশধর ছিলেন। তারা সবাই এলাকার প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন।

কলসকাঠীকে একটি পৃথক জমিদার বাড়ি না বলে বলা যায় একটি প্রাচীন শহর। অনেকটা সোনারগাঁওয়ের পানাম নগরের আদলে তৈরি প্রতিটি স্থাপনা ও প্রাচীরের নকশা। এই জমিদার বাড়িটি তৈরিতে ইট, সুরকির পাশাপাশি পোড়া মাটির কারুকার্য করা হয়েছে। যা সেই তৎকালীন সময়ের আভিজাত্য প্রকাশ করে। জমিদারবাড়ির পাশেই অবস্থিত শিব মন্দির। প্রায় শত বছরের পুরনো এই মন্দিরটি কষ্টি পাথরের মূর্তি ও অন্যান্য ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ। 

এই মন্দিরে এখনো শত বছরের পুরনো মূল্যবান কোষ্ঠীপাথরের মূর্তি আছে। চুরির ভয়ে মন্দিরের ভেতরে দেবীর মূর্তিকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। মন্দিরের সামনে ছোট একটি বেদী রয়েছে। যেখানে পূজার সময় প্রাণী বলি দেয়া হয়। প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এখানে উদযাপিত হয় ঐতিহাসিক জগদ্ধাত্রী পূজা। 

কলসকাঠীর জমিদারদের মধ্যে সর্বশেষ জমিদার ছিলেন রাজেস্বর রায় চৌধুরী। যিনি ৪৭'এর দেশভাগের পর সবাইকে নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। এরপর সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। জমিদার বাড়ির সঙ্গেই ১৮৮২ সালে তৎকালীন জমিদার বরদাকান্ত রায় চৌধুরী নিজের ও তার স্ত্রী মুক্তা কেশীর নামে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয় কে.বি.এম একাডেমী (কলসকাঠী বরদাকান্ত-মুক্তাকেশী একাডেমী) প্রতিষ্ঠা করেন। 

এখন তদারকির অভাবে কলসকাঠী জমিদারদের অনেক সম্পত্তি বিলীন ও বেদখল হয়ে গেছে। শুধু বাড়িগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যুগ যুগ ধরে এই জমিদার বাড়িগুলো মেরামত ও সংস্কার না করায় তা ধ্বংস হতে চলছে। এগুলো সংস্কারের মাধ্যমে প্রত্নত্তাত্বিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করার দাবি উপজেলা বাসির। 
 
অনুসন্ধানে জানা যায়, সর্বশেষ জমিদার রাজেশ্বর রায় চৌধুরী মারা গেলে ওয়ারিশ হিসেবে তার বোন মিনা দেবী চৌধুরী মালিক হন। তিনি মারা যাওয়ার পরে তার পুত্র বাবু চৌধুরী ওয়ারিশ সূত্রে মালিক হন। তিনি মারা গেলে তার স্ত্রী ববিতা মুখার্জি ও তার তিন পুত্র প্রীতম মুখার্জী, অপু মুখার্জি, তপু মুখার্জী  মালিকানা দাবি করেন। প্রীতম মুখার্জী, অপু মুখার্জি, তপু মুখার্জী একটি লিখিত চুক্তিপত্রের মাধ্যমে জমিদার বাড়িটি ভেঙে ফেলার জন্য গত বছর ঠিকাদার মোবারককে দায়িত্ব দেন।

এ বিষয়ে প্রীতম মুখার্জী জনকণ্ঠকে জানান, জমিদার বাড়িটি আমাদের পূর্বপুরুষের। বাড়ি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আদালতে মামলা চলমান। 

এ বিষয়ে কলসকাঠী মুক্তিযুদ্ধা কমান্ডার বাদশা জানান, পুরনো জমিদার বাড়িটি যাতে ভেঙে ফেলা না হয় এবং এটি সংস্কার ও সংরক্ষণ করে পর্যাটক কেন্দ্র করা হয় সেজন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

এলাকাবাসী জানায়, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এলাকা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাচনী প্রচারের সেই জনসভাস্থল বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠী এলাকার তেরো জমিদারবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রশাসনের উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।

 এসআর

×