গ্রামে এখনও বসে গাজীর গানের আসর বসে
ইন্টারনেট ও ফেসবুকের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার ঐহিত্য। গ্রাম-বাংলার উৎসব। হারিয়ে যাচ্ছে লোকসংগীত জারি-সারি গান। হাতের মুঠোয় মোবাইল। ইন্টারনেট ও ফেসবুকজুড়ে আছে ছোট-বড় নারী-পুরুষের চোখ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে ফেসবুকে। এই ইন্টারনেট ও ফেসবুকের ভিড়ে এখনো বাজে লোকসংস্কৃতি জারি-সারি। বাজে গাজীর গান। বাজে ঘুম পাড়ানি গান। গ্রামে এখনো গাজীর গানের আসর বসে।
আবেগ-অনুভূতি, দুঃখ-সুখ, জীবনের অংশ নিয়ে তত্ত্বকথায় উঠে আসে যে সংস্কৃতি। গাজীর গান, গাজী যাত্রা এমনি একটি গ্রামীণ উৎসব। দেশের বিভিন্ন জেলার, বিভিন্ন স্থানে গাজীর গান এখনো বাজে। প্রাণের টানে ছুটে আসে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ।
রাজবাড়ী জেলার বিভিন্ন গ্রামে এখনো প্রতিনিয়ত গাজীর গানের আসর বসে। এই গানের আসরে হারমোনিয়াম মাস্টার, ঢুলি মাস্টার, জুড়ি মাস্টার হিসেবে ৫-৭ জনের একটি টিম থাকে। গাজীর গান লোকজ গাজী পীরের বন্দনা গীতি। রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে এই গানের চল ছিল বেশি। গাজীর গান বেশি হয় মানতের কারণে। অনেক নারী-পুরুষ বিশেষ কাজের জন্য গাজীর গানের মানত করে থাকে। সেই উপলক্ষে বাড়ির আঙিনায় বসে গাজীর গানের আসর।
আসরে থাকত গাজীর পট, একটি টুল। টুলের ওপর আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আসর সাজিয়ে দলনেতা বিশেষ একটি পোশাকে নিজেকে উপস্থিত করেন। সঙ্গে থাকেন ৫-৭ জনের একটি টিম। দলনেতা গায়ে এক রংয়ের একটি জামা, মাথায় পাগড়ি পরেন। গাজীর গানের চারপাশে সম্মানের সঙ্গে শত শত নারী-পুরুষ বসে থাকেন। দলনেতা চারদিকে ঘুরে ঘুরে গাজীর গান পরিবেশন করেন। প্রথাগত গাজীর গীতে প্রথমে ‘বন্দনা’ এবং এরপর গাজীর জন্মবৃত্তান্ত, দৈত্য-রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ, রোগ-মহামারি এবং নানা বিপদ-আপদে দুষ্ট আত্মার সঙ্গে যুদ্ধ, অকূল সমুদ্রে ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে পুণ্যবান ভক্ত সওদাগরের নৌকা রক্ষা পাওয়ার এসব বর্ণনা করা হতো। ধর্মীয় ও বৈষয়িক ভাবনা একাকার হয়ে যেত গাজীর গানে। গাজী পীর ধর্মে মুসলমান হলেও অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু-মুসলমান সবাই তার ভক্ত।
রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দের দেবগ্রাম ইউনিয়নের জামাল গাজীর গানের বয়াতী। তিনি ছোটবেলা থেকে ইসমাইল বয়াতীর সঙ্গে গান করতেন। প্রাথমিক স্কুলের গ-ি পার হতে পারলেও সংসারের অভাবের কারণে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করতে পারেন নাই। ছোটবেলা থেকে গানের প্রতি ছিল টান। বিভিন্ন গানের আসরে যেতেন কৈশোরে।
প্রথম যৌবনে ইসমাইল বয়াতির হাত ধরে প্রবেশ করেন গাজীর গানের আসরে। ওস্তাদ মারা যাওয়ার পর নিজেই গঠন করেন পালাগানের দল। সেই থেকে গাজীর গান পরিবেশন করে চলে তার সংসার। এই দলে একজন হারমোনিয়াম বাদ্য, একজন ঢুলি, বাঁশি, খুজরিসহ মোট ৫-৭ জন থাকেন।
শত বছর বয়সী ফজল বেপারী বলেন, সত্তর-আশি-নব্বই দশকে রাজবাড়ী জেলার বিভিন্ন এলাকায় মূলত শীতের রাতে বাড়ির উঠানে গাজীর গানের আসর বসত। ছেলে সন্তানের খতনার মতো অনুষ্ঠান বা মানত হিসেবে গাজীর গানের আসর বসত বেশি। বর্তমান এ অঞ্চলে ‘গাজী-কালুর পালাগান’ অনেক কমে গেছে। তিনি বলেন, গ্রাম-বাংলার এই ঐহিত্য ধরে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
এ সময় হাবিবুর রহমান নামের এক বয়স্ক ব্যক্তি বলেন, কালের বিবর্তনে গাজীর গীত হারিয়ে যেতে বসায় এর শিল্পীরাও হারিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে এখন অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছেন। তারপরও তারা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ব্যান্ডসংগীতের রমরমার যুগেও এখনো মাঝে মাঝে গ্রামগঞ্জে গাজীর গানসহ বিভিন্ন প্রকার লোকসংস্কৃতিক গানের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
শফিকুল ইসলাম শামীম, রাজবাড়ী