ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

বানিয়াচং রাজবাড়ি

প্রকাশিত: ২০:২৪, ৭ মে ২০২২

বানিয়াচং রাজবাড়ি

ঐতিহ্যবাহী এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং। হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তর এবং কিশোরগঞ্জ জেলার পূর্ব প্রান্ত থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে প্রায় ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬ কিলোমিটার প্রস্থের বিরাট স্থলভাগ বিশিষ্ট এই গ্রামটি ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। বানিয়াচং রাজ্যটি গোবিন্দ সিংহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গোবিন্দ সিংহ পরে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ নিয়ে রয়েছে এক উল্লেখযোগ্য কাহিনী। জানা যায়, জগন্নাথপুরকে বানিয়াচংয়ের সঙ্গে একত্রিত করতে চাইলে গোবিন্দ সিংহের জগন্নাথপুরের রাজা বিজয় সিংহের বিবাদ সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে বিজয় সিংহের সঙ্গে গোবিন্দ সিংহের তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বিজয় সিংহ পরাজিত হয়ে দিল্লীর সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে বিচার প্রার্থী হন। গোবিন্দ সিংহকে ধরে নেয়ার জন্য দূত প্রেরণ করা হলে তিনি দূতকে পদাঘাত করেন। পরে গোবিন্দ সিংহ নিজের সাম্রাজ্যকে সুরক্ষিত করার জন্য তার লাউড় রাজ্যের রাজধানী বানিয়াচংয়ের চারদিকে নদীসম গড় খাই খনন করেন। এ খবরে চাতুর্যের পন্থা অবলম্বন করে দিল্লী থেকে মণি বিক্রেতা হিসেবে একদল লোক নৌকাযোগে বানিয়াচং রাজ্যে প্রবেশ করে। মণি ক্রয়ের উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণে গোবিন্দ সিংহ নৌকায় আরোহণ করলে তাকে ধৃত করে রাজদরবারে নীত করা হয়। রাজ্য দখল ও দূত হত্যার জন্য তার প্রতি মৃত্যুদ-ের আদেশ হয়। আদেশ রক্ষা করে গোবিন্দ সিংহ তার প-িতের সঙ্গে কথা বলার আরজ পেশ করেন। প-িতকে বানিয়াচং থেকে নেয়া হয়। প-িতের কথামতো গোবিন্দ প্রাণ ভিক্ষা ও পুনরায় ধর্মীয় মতে বিচার করার আকূল আবেদন পেশ করেন। প-িতের শেখানো কথায় গোবিন্দ সিংহ বলেন, আমি ইতোমধ্যেই হিন্দু থেকে মুসলমান হয়ে গেছি। কালেমা পড়ানো হলো। গোবিন্দ সিংহ বললেন, হিন্দুশাস্ত্র মতে মুসলমান হওয়া মৃত্যুর সমতুল্য। তখন দিল্লীর সম্রাট হেসে বললেন, ‘বিনায়ে জঙ্গ আস্ত আজা আয় হাবিবে মন।’ ইসলাম ধর্মে নবদীক্ষিত গোবিন্দ সিংহ হবিব খাঁ নাম ধারণ করেন। সেই সঙ্গে শাহী দরবার থেকে রাজ্যের সনদসহ শেখ, সৈয়দ, মোগল, পাঠান, তাঁতি, জেলে, কামার, কুমারসহ প্রায় তিন শ’ পরিবার নিয়ে বানিয়াচংয়ে প্রত্যাবর্তন করেন আনুমানিক ১৫৫৬ সালে। তখন তিনি রাজবাড়ি পুননির্মাণ করেন। এই বাড়ির ইতিহাস আইন-ই-আকবরী, বাহারি স্থান-ই-গায়েবী, সিলেটের ইতিবৃত্ত এবং ঐতিহাসিক বানিয়াচং ও কিংবদন্তি, জালালাবাদের কথা, বানিয়াচং দর্পণসহ অনেক গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। অপর মতে জানা গেছে, বানিয়াচং যে লাউড় রাজ্যের রাজধানী ছিল- এটি অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। গ্রামের অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শনই এর অকাট্য প্রমাণ বহন করে। উল্লেখযোগ্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে গড় খাল নির্মাণ। তৎকালীন রাজারা তাদের রাজধানী শহর রক্ষার্থে গ্রামের চারদিকে প্রতিরক্ষা পরিখা হিসেবে তৈরি করেছিলেন এ আয়তক্ষেত্র। এ খাল খনন করার সময় পাওয়া যায় রাজা আনোয়ার খাঁয়ের সময়ের একটি ঐতিহাসিক কামান, যা বর্তমানে সিলেট পুলিশ লাইনে রক্ষিত আছে। বর্তমানে গড়ের খাল প্রায় ভরাট হয়ে গেলেও এর রেশ আজও রয়ে গেছে। বানিয়াচংয়ের দর্শনীয় স্থান হচ্ছে- রাজা হবিব খাঁর নির্মিত রাজবাড়ি। দৃষ্টি নন্দন রাজবাড়ির সেই জৌলুস এখন উপস্থিত না থাকলেও এর ধ্বংসাবশেষ প্রমাণ করে একদিন এখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল এক বিশাল রাজবাড়ি। বানিয়াচং গেলে বর্তমান এল আর হাইস্কুলের কাছে দালানের ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান। এক সময় এ রাজবাড়িতে শ’দুয়েক চাকর-চাকরানি কাজ করত। বাড়ির চারদিকে ছিল বাহারি ফুলের বাগান। বাড়ির সামনে কারুকার্যখচিত মসজিদ আজও টিকে রয়েছে। রাজপ্রাসাদের পাশেই আছে কয়েকটি মসৃণ পাথরের স্তম্ভ। লোকজন এগুলোকে ‘হব্যা’ ‘গোমা’র দাড়াগুটি বলে আখ্যায়িত করে। জনশ্রুতি আছে, হব্যা ও গোমা দু’ভাই দীঘির পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে দাঁড়িয়ে স্তম্ভগুলো নিয়ে খেলা করত। বর্তমানে রাজবাড়ির দেখভাল : দেয়ান আহমদ রাজা জুলকারনাইন রাজবাড়ির বংশধর হলেও স্থায়ীভাবে বসবাস করেন সিলেট শহরে। তবে বর্তমানে তিনি রাজবাড়ি দেখভাল করছেন। প্রায় সময়ই তিনি এখানে এসে রাজবাড়ির কার্যক্রম সচল রাখছেন। স্থানীয়দের কাছে তিনি রাজবংশীয় প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে আছেন। রাজাদের খনন করা দেওয়ানদীঘি : বর্তমান রাজবাড়ির সামনে বিশাল জলাশয়। এটি দীঘি। এ দীঘির নাম দেওয়ানদীঘি। দীঘির একপাড়ে রয়েছে রাজাদের নির্মিত ঘাটলা। এ ঘাটলা এখনও সবার দৃষ্টি কাড়ে। রাজাদের তলোয়ার : প্রাচীন রাজারা নেই, নেই তাদের শাসন, তবে এখনও রয়েছে তাদের শাসনকালের তলোয়ার। এ তলোয়ার নিয়ে তারা ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে ভ্রমণে যেতেন। এখনও রাজাদের এ তলোয়ার রাজবাড়িতে সংরক্ষিত রয়েছে। এটি দেখলে রাজ আমলের কথা মনে হয়। এ তলোয়ার দেখার জন্য বহু লোকের আগমন হয়ে থাকে রাজবাড়িতে। এখনও দাঁড়িয়ে রাজবাড়ি : রাজারা তাদের রাজ্য শাসন করে গেছেন, তারা আজ নেই, রয়েছে তাদের বংশধর, আর রয়েছে রাজবাড়ি। এ বাড়িতে বসে লাউড় রাজ্য শাসন করতেন ঐ সব রাজারা। এ বাড়িটি এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাজবাড়িতে রাজাদের চেয়ার ও ফিল্টার : রাজারা একে একে চলে গেলেও তাদের কিছু স্মৃতি রয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি চেয়ার ও কয়েকটি পানির ফিল্টার অন্যতম। এগুলো এখনও এ বাড়ির মধ্যে সংরক্ষণে রাখা হয়েছে। এসব স্মৃতি দেখতে এখনও নতুনের মতো। এ রাজবাড়ি থেকে বহু জমিদারের উৎপত্তি : এ বাড়ির রাজাদের বিশাল সাম্রাজ্যে বহু জমিদার হয়েছেন। এখানকার সনদ নিয়ে জমিদাররা প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা একত্রে করে রাজদরবারে এনে হাজির করেছেন।
×