ফলাফল লাশ
হাবীবুল্লাহ সিরাজী
মেয়েটি যে খুন হবে জানার পূর্বেই
চোখে সর্বনাশ
জীবন-মেলানো সারে তর্কযুক্তি বৃথা
অমাবস্যা ফাঁস
যদিবা ডোমের হাতে মুগ্ধ ছুরিকাঁচি
সুপ্ত বারোমাস
তবু রক্ত তবু মাংস অন্ধকার স্রোত
গুপ্ত দীর্ঘশ্বাস
ও প্রান্তের গিঁট খুলে টোকা পেলে দেহ
ত্বকলব্ধ আঁশ
উস্কে দেয় ফলাফল মাটি ও ময়াল
কিছু বা নির্যাস
মেয়েটি তো খুন হলো বোধের শর্তেই
ফলাফল লাশ
*
অভিশপ্ত তুমি
নাসির আহমেদ
তুমি প্রত্যাখ্যান করেছে সত্য এবং ভেদরেখা সৃষ্টি করেছ।
সেই মহান সত্যের যা অবিনশ্বর আত্মা ও শরীরের মতো। তুমি আমার গৌরবের ইতিহাস কি করেছো কলঙ্কিত অতএব- অভিশপ্ত তুমি তোমার প্রাপ্য চরমতম শান্তি।
তুমি সত্যকে খন্ডিত করেছ মিথ্যার করাতে এবং জালেমের পক্ষ নিয়ে হত্যা করেছো আমার স্বদেশের মহিমাকে।
মহত্তম অর্জনকে করেছ গোপন। তোমার জন্য লানত ইহকাল আর পরকালে নিক্ষিপ্ত হবে জাহান্নামে।
তুমি কোন স্পর্ধায় ‘গনিমতের মাল’ বানিয়েছ কোটি মানুষের সম্পদ আর কুক্ষিগত করেছে মানুষের হক! তোমার জন্য বর্ষিত হচ্ছে রক্তেভেজা স্বাধীন দেশের বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস- তোমার জন্যই অপেক্ষমাণ প্রজ্ব¡লিত অগ্নিকুন্ড!
রাজদ- হাতে তুমি আস্ফালন করেছ অনেক,
আজ দেখো বিধির বিধান মাথা নত করে আছো করুণার আশায়।
*
বাস্তুহারা ফাল্গুনের আট
কাজী রিয়াজুল হক
ফেব্রুয়ারির একুশ ফাল্গুনের আট
কলসে জল ভরনে ভিন্ন নয় ঘাট।
হাজার বছর ধরে শ্বাস ফেলে যায়
সাদা কালো সবুজের ছায়ায় ছায়ায়।
পাখা মেলে উড়ে এলো ফেব্রুয়ারি ভাই
বঙ্গদেশে কমে গেল ফাল্গুনের ঠাঁই।
রক্তমাখা পথঘাটে জাগিল ফাল্গুন
আট তারিখের দিনে জ্বলিল আগুন।
আজ আট তারিখ নেই বড় দেখা
একুশের ছায়াতলে মিলে গেল রেখা।
ভাষা দিবস চিহ্নিত একুশের তরে
স্মরণীয় বরণীয় দেশ দেশান্তরে।
নিজ দেশে ঘরছাড়া বাস্তুহারা আট
বটতলায় বসে না জাগরণী হাট।
বাঙালী সন্তান হয়ে কেন আজ হাবা
ভাঙাঘর ছেঁড়া চটে শুয়ে শুয়ে ভাবা।
একুশের পরে নেই হিংসা বিদ্বেষ
মনের সুখ শান্তিতে পরিপাটি কেশ।
মনের ব্যথা বেদনা জাগে ঠোঁট মুখে
একুশের পাশাপাশি আট হোক সুখে।
আপন কারণে নষ্ট আপনার ভাল
এভাবে দিন কাটবে আর কত কাল।
*
আমার ভাষাপত্র : ৪
সোহরাব পাশা
তোমাকে ভুল শব্দে অনুবাদ করেছি
গত বসন্তে ছিলো ছেঁড়া ফুল পাতার
মৃদু কোলাহল
মাক্সপরা ধূসর দুপুর
ধুলো আর কুয়াশা-রোদের ডানায় উড়ছিলো
পুরনো স্মৃতিকাতর বিহ্বল পাখিরা
প্রভাত ফেরির করুণ শব্দ-ধ্বনি
রাত্রিভেজা শহীদ মিনার ঘিরে উজ্জ্বল চোখের
ভালোবাসা
বিনয়ের অসমাপ্ত ভোরের সংস্কৃতি
সন্ধ্যের মাইকে পাঠছিলো স্বপ্নজয়ের-
রাজনীতিমুখর মধুর বিজ্ঞাপন
তোমার জানালায় তখন নক্ষত্রের তীব্র ভিড়
বর্ণীল মেঘের করতালির ভেতর
খুঁজে ফিরছিলে প্রিয় ছায়া
তোমার উষ্ণ নিঃশ্বাসের নিবিড় গল্প
*
প্রত্যাখ্যান
মারুফ রায়হান
তার অপারগতাও ভালোবাসো
যদি হও প্রকৃত প্রেমিক
একবার মুঠোয় পাওয়ার পর প্রেম গেলে উবে
ভেবো না পূর্ণিমা গেছে চিরতরে ডুবে
অমাবস্যা সাময়িক, আর জোছনারা জায়মান
প্রেম প্রত্যাখ্যানে খানখান হলে নিঃসঙ্গ নিসর্গ
কোথাও রচিত হতে থাকে ঠিক খন্ড স্বর্গ
এখনও কাজল-ধুয়ে আসা জল করেনি প্রত্যাখ্যান
এখনও আহত বৃক্ষ নিবেদন করে পুষ্পঘ্রাণ
এখনও দোয়েল ধরে আছে স্বতন্ত্র অভ্যাস
এখনও পাঁজরের ভাঁজে কবিতারই বাস
দখিন-জানালা খোলাহাওয়া করেছে কি প্রত্যাখ্যান?
এখনও নদীর ঢেউয়ে ইলিশ-রূপালী গান
এখনও নবজাতকের হাসি
বলছে : ভালোবাসি, ভালোবাসি।
*
পাঠ্য পুস্তক
সুজন হাজারী
জন্মেই যে পুস্তক পড়েছি নাম তার ‘মা’
অশিক্ষিত মা দশ বছরে বাবার ইস্কুলে
প্রথম ছাত্রী একই স্কুলে আমিও পড়েছি
শিশু পাঠ শেষে মাধ্যমিকে শুভ অমল নান্নু
জয় জিল্লর সহপাঠী অনেক। আইনজ্ঞ নান্নু
মুক্তিযোদ্ধা জয় চির ঘুমে অমল বিলেত পাস
ডাক্তার থিতু সেখানেই শুভ ভারতে সেটেল।
বিধবা মা বাবার ঘর ভিটার দখলদার
তোর কাছে কিছুই চাইনে মাঝে মধ্যে
বাড়ি এসে আমায় শুধু দেখে যাস বাবা
দোয়া করি তোর বউ ছেলেদের নিয়ে
চিরকাল সুখে থাকিস বাবা।
*
ক্ষয়িষ্ণু তলের মাটি
সৈয়দ রফিকুল আলম
সিঁদেল চোরের মতো মাটি কাটে নিশীথ দুপুরে
হরবেলা ঝাঁপি মেঘ ঘিরে থাকে অচলা আড়ষ্টে
চকোর বৃষ্টির আশা এক ফোঁটা সে তো বহুদূরে
যায় দিন আসে রাত বিদিশার দিশাহীন কষ্টে।
বজ্রের আওয়াজে ওঠে সসাগরা আকাল কার্তিকা
বুকের জমিনে চষে ভরা মাঠ, ক্ষেতের আবাদ
পোয়াতি শস্যের দানা ঘরে তুলে কোন সে জাতিকা
জাতিস্মর রুদ্রমালা গিলে খায় লোভন সুস্বাদ।
ক্ষয়িষ্ণু তলের মাটি টান মারে পাতাল ভৈরবে
বিবমিষা চন্ডগ্রোত ভেসে যায় লাভাসিক্ত তাপে
অসহ দহন সয়ে হাহাকীর্ণ অগুনতি অরবে
শ্মশান মাঠের গোরে শবের মিছিল কোন শাপে?
খান্ডব দাহনে আর কতো, আকাশের তারা গোনা
মৃত লাশ বুকে পুরে উন্মাতাল নৃত্যগীত শোনা!
*
ভাষার দাবিতে প্রথম কারাবন্দি তুমি পিতা
আমিনুর রহমান সুলতান
প্রাণের আগুন জ্বালিয়ে প্রাণের অক্ষরগুলো
বাঁচিয়ে রেখেছো পিতা
কারাগার নেভাতে পারেনি সে আগুন
ঘন আঁধারে প্রাণের বর্ণগুলো বিবর্ণ হওয়ার আগে
লণ্ঠনের আলো জ্বলে ওঠে
ভাষার দাবিতে প্রথম কারাবন্দি
বাঙালি জাতির পিতা
বঙ্গবন্ধু বিশ্ববন্ধু তুমি
ক্লান্ত দেহ তারপরও ঝিমিয়ে পড়োনি
ভাষার দাবির সংগ্রামের দিনগুলোতে
আন্দোলনের আলয় বানিয়েছো কারাগার
অনশনকে করেছো ধারালো দাবি।
সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিতে প্রতিবাদ
বায়ান্নর একুশে রাজপথে
রক্তাক্ত লুটায় রফিক, শফিক, জব্বার ও বরকত।
আমাদের মায়ের মুখের ভাষা আজ তাই
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে
কুড়িয়েছে বিশ্বের সম্মান।
*
সব কথা বলে যেতে চাই
ফারুখ সিদ্ধার্থ
বিজাতীয় শকুনের অহর্নিশ অপতৎপরতা
থেকে থেকে ডেকে আনছে অনাবৃষ্টি, মহামারী...
এরকম সব কথা বলে যেতে চাই, বয়ে যেতে চাই
ধুলো-জল-বাতাসের- আবহসঙ্গীতের মতো
ধূসর দেয়ালে এঁকে যেতে চাই ধানিরঙ গোয়ের্নিকা-
নির্মাণ করতে চাই নতুন প্রেক্ষাপট জীবনের;
যেন আগামী দিনের বালক রাখাল
শেকড়ের শান্তিতে বসে গলা ছেড়ে গাইতে পারে
মেঘের সারি ছুঁয়ে ছায়াময় বৃক্ষায়নের এখনই সময়!
*
লিফলেট
মিলু শামস
একটি ঝকঝকে লিফলেট
হঠাৎ উড়ে আসে
আধখোলা গাড়ির জানালা দিয়ে
অফিস ফিরতি বাড়ির পথ-
ব্যাগ ট্যাগ সামলে
গুছিয়ে বসতেই
ওটা এসে লুটিয়ে পড়ে
পায়ের কাছে।
কুঁজো হয়ে তুলে
সামনে মেলে ধরতেই
সুসজ্জিত অক্ষরগুলো
লাফিয়ে ওঠে-
‘চেঞ্জ ইয়োরসেলফ’ শিরোনামে
লেখা- ‘আমাদের গ্রুমিং সেন্টারে আসুন
নিজেকে বদলে ফেলুন’
তারপর স্টার চিহ্ন দেয়া
নিজেকে বদলানোর কী ওয়ার্ডসমূহ।
নিজেকে বদলে ফেলার
এ ধরনের আহ্বান আজকাল খুব
শোনা ও দেখা যায় টিভিতে,
খবরের কাগজ, বিলবোর্ডে।
গত শতকের ষাট সত্তর আশি
এমনকি নব্বই দশকেও
শোনা যেত এক ধরনের বদলের কথা-
তখনও বাতাসে উড়ত লিফলেট-
পল্টন মোড়, জিরো পয়েন্ট, জিপিওর
সামনের রাস্তায়
উত্তোলিত, প্রতিবাদী হাত এবং
সমবেত স্লোগানের তালে।
সে সবে এমন ঝকঝকে ছাপায়
সুললিত অক্ষর বিন্যাস
ছিল অকল্পনীয়,
সস্তা নিউজ প্রিন্ট, সস্তা ছাপা ও কাগজ
মানুষগুলোর গায়ে সস্তা জামা কাপড়;
শুধু আকাক্সক্ষাটি ছিল দামী
ঝলমলে এই লিফলেটের চেয়ে বহু বহুগুণ বেশি।
কালো অক্ষরের সরল ভাষায়
লেখা থাকত সে সব লিফলেটে
সম্মিলিত জীবন ও সমাজ বদলের কথা।
মাত্র ক’দশকের ব্যবধান-
পরিবর্তনের সংজ্ঞা কী ভয়ানক
বদলে গেছে,
এখন বদলানো মানে গ্রুমিং করে
চৌকস ও দক্ষ হওয়া
বদলানো মানে সমাজে বাস করে
ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হওয়া।
সমাজ বদলের প্রসঙ্গটি
কি আশ্চর্য ভাবে
আমাদের চোখের সামনেই
অচল পয়সার মতো
অবান্তর হয়ে পড়ে আছে!
২.২.২০
*
একুশে ফেব্রুয়ারি
আদিত্য নজরুল
বর্ণমালার সাথে
শহীদ মিনারের কি দারুণ দাম্পত্য।
তবু একজন ভাষা শহীদের বোন
প্রশ্ন করলেন:
মুত্যশয্যায় নাকি ফুলশয্যায় দাঁড়িয়ে আছে..!
শহীদ মিনার ?
এমন বিহব্বল প্রশ্ন শুনে
একুশে ফেব্রুয়ারি মায়ের কোমল কণ্ঠে বলে উঠলেন
শহীদ মিনারের সাথে
বর্ণমালার শুভ বিবাহের দিনে
এ কেমন প্রশ্ন করলে মেয়ে !
*
বর্ণমালা ফুল
ফখরুল হাসান
বায়ান্নের ফাগুনে অগ্নি ঝরেছিলো বর্ণবৃক্ষে
স্লোগানে স্লোগানে রাজপথে জ্বলজ্বলে অক্ষর!
সাদা রঙা শাড়ির আঁচলে বাঁধা আগুন ঝরা ফাগুন
বর্ণমালার পাঠশালার ত্যাজদ্বীপ্ত সূর্যেরা নির্ভীক।
হঠাৎ বুলেট বৃষ্টি পিচঢালা পথ রক্তের বন্যা!
কৃষ্ণচূড়ার শাখায় শাখায় জ্বলন্ত ফাগুনের কান্না;
পশ্চিমা বিষাক্ত বাতাসের অগ্নি থাবায় রক্তাক্ত বর্ণমালা!
শোকের মাতমে ছেয়ে যায় ফাগুনের উতলা বাতাস।
মুহূর্তেই শোকার্ত রঙে উচ্চারণ হয় দ্রোহের ঝংকার
বজ্র কঠিন গর্জনে রাজপথ দখল নেয় বর্ণের পাঠশালা
স্লোগানে চারপাশ ঘিরে ফেলে বাংলা মায়ের বর্ণচাষী
রক্তের বিনিময়ে ফাগুনের বনে ফুটে বর্ণমালার ফুল।
*
একুশ-এষণা
মিশকাত উজ্জ্বল
একুশ মানে ভাষার তরে রক্তে ভাসা-
জাতির সূর্য-সন্তানের স্মৃতি অম্লান।
একুশ মানে নয়তো শুধু পিতার অশ্রুসজল বুক;
স্বতঃপ্রণোদিত প্রাণের আত্ম-বলিদান।
একুশ মানে নব-জাগরণের চেতনায়Ñ
স্বপ্ন আঁকার তুলি।
একুশ মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীক,
উদ্ধত বজ্রাঙ্গুলি।
একুশ মানে শোষণ, অন্যায়কে দলিত করে-
দুর্বার এগিয়ে চলা।
একুশ মানে ফুলশোভিত মিনারে মৌনতা বা
বাংলিশ ভাষণ নয়; খাঁটি বাংলায় কথা বলা।
একুশ মানে নয়তো কেবল
রফিক, শফিক, সালাম, বরকতের লাশ;
একুশ মানে মাতৃভাষা বাংলার-
বিশ্বময় বিজয়োল্লাস!
*
দুঃখ
সুজন আরিফ
পাখিদের দুঃখ থাকতে নেই
থাকেও না।
কালো অথবা নীল, যেমনই হোক;
একটি আকাশ থাকলেই হলো
মনের জোরেই উড়ে বেড়ায় ওরা
গেয়ে যায় জীবনের গান।
শূন্যেই যাদের চির আস্থা,
পূর্ণের বিচ্ছেদ কি জাগাতে পারে-
তাদের বুকে দারুণ অনাস্থা।