![রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করা চাই রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করা চাই](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2023May/Sompadokio1-2404191539.jpg)
.
আমাদের সকলের জানা; আত্মকর্মসংস্থান, অধিক বেতন, উন্নত কর্মপরিবেশে জীবনযাপনের লক্ষ্যে দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে পাড়ি জমান। তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির ভীত মজবুতসহ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করছেন। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিকালে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রবাসী আয়ের ব্যাপক ভূমিকা কারও অজানা নয়। বিশ্বপরিমন্ডলে অদম্য উন্নয়ন অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রগতিতে রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ‘জাতীয় প্রবাসী দিবস ২০২৩’ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রবাসীদের অবদান আন্তরিক কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশীরা অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন, বৈদেশিক সহায়তা এবং কূটনৈতিক কার্যক্রম জোরদার করতে প্রবাসীদের সক্রিয় সহযোগিতা ও অবদান অনস্বীকার্য।’
বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডেও এ অর্থ ব্যয় হয়। রেমিটেন্স আয়ের প্রায় ৬৩ শতাংশ দৈনন্দিন খাতে খরচ হওয়ায় পরিবারগুলোর দরিদ্রতা দূর হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যসূত্রে জানা যায়, প্রায় দুই বছর ধরে প্রতিমাসে বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রায় এক লাখ কর্মী বিদেশে যাচ্ছেন। এর উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে সৌদি আরবের সকল ফার্মে বাংলাদেশী কর্মীদের কোটা ২৫ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি, চারবছর বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলে যাওয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের গন্তব্যের পাশাপাশি ইতালি-যুক্তরাজ্যের মতো অপ্রচলিত বাজারগুলোতে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়গুলো উল্লেখ্য, সংস্থার প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়েছে।
২০২৩ সালে বিশ্বের ১৩৭টি দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৩ লাখের বেশি বাংলাদেশী কর্মীর, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে বিদেশে যাওয়ার রেকর্ড। এসব কর্মসংস্থানের বেশিরভাগই হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছে সৌদি আরবে। দেশটিতে ১১ মাসে যায় ৪ লাখ ৫১ হাজার ৫০২ কর্মী। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ কর্মী যাওয়া দেশ হচ্ছে মালয়েশিয়া ও ওমান। দেশগুলোতে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৪৩১ ও ১ লাখ ২৫ হাজার ৯৬১ জন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে বলেন, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা এবং শ্রমখাত নিয়ে সরকারের আন্তরিকতার কারণে রেকর্ড পরিমাণ কর্মী বিদেশে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। সরকার বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য নতুন নতুন শ্রমবাজার তৈরি করছে। আগামী বছর হয়তো এই রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে ইউরোপের অনেক দেশে কর্মী যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে বেতন নিরাপত্তাসহ সব নিশ্চিত করে দক্ষ কর্মী পাঠাতে বেশি জোর দিতে চায় সরকার, যাতে রেমিটেন্সের পরিমাণ আরও বাড়ানো যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে উন্নয়নে বিস্ময়কর অর্জনে বিশ্বস্বীকৃত বাংলাদেশ সরকারের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যকর বাস্তবায়নে অর্থনীতির চাকাকে সচল করার গৃহীত সকল উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্সের গুরুত্ব বিবেচনায় বিদেশে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের কষ্টার্জিত আয় দেশে বৈধ উপায়ে প্রেরণে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ওয়েজ আর্নার্স রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে সরকার ১ জুলাই ২০১৯ হতে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধকল্পে সরকার ১ জানুয়ারি ২০২২ হতে রেমিটেন্সের বিপরীতে নগদ প্রণোদনার হার ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ধারাবাহিকতায় বৈধ উপায়ে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধিতে প্রবাসীদের সিআইপি সম্মাননা, প্রবাসী আয়ের বিপরীতে প্রণোদনা, রেমিটেন্স আহরণ-বিতরণ প্রক্রিয়া দ্রুতকরণ, দেশে আবাসন খাতসহ বিশেষ বিনিয়োগ স্কিম চালু ও প্রশিক্ষিত লোক পাঠানোর মতো নানাধরনের কর্মতৎপরতা অতিশয় দৃশ্যমান।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার, যা সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তা বেড়েছে ৮ শতাংশ। এছাড়াও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে প্রবাসী আয় ৩ শতাংশ বেড়ে ১২ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা এ যাবৎকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ২ হাজার ১৬১ কোটি মার্কিন ডলার। পূর্বে করোনাকালীন ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমটি) তথ্যানুসারে, এখন পর্যন্ত বছরভিত্তিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে ২০২১ সালে, যার পরিমাণ ২ হাজার ২০৭ কোটি ডলার। ২০২২ সালে তা কমে হয় ২ হাজার ১২৯ কোটি ডলার এবং ২০২৩ সালে সামান্য বেড়ে তা দাঁড়ায় ২ হাজার ১৯১ কোটি ডলার। এছাড়া চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম ৫ দিনে রেমিটেন্স এসেছে ৪৫ কোটি ৫৪ লাখ মার্কিন ডলার (৪৫৫ মিলিয়ন), যার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৩ কোটি ৮৫ লাখ, বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ২ কোটি ৭৩, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৩৮ কোটি ৭৭ লাখ এবং বিদেশী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স। কিন্তু জনশক্তি রপ্তানিতে মাইলফলক অর্জন সত্ত্বেও এর বিপরীতে বাড়েনি রেমিটেন্স প্রবাহ। উল্লেখ্য যে, প্রবাসী আয় অর্জনে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য; এই ধরিত্রীর বিভিন্ন দেশে অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জিত অর্থ- রেমিটেন্স যারা দেশে পাঠাচ্ছে, তাদের দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তাদের প্রতি বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোর অসহযোগিতা-অভিযোগের অন্ত নেই। দালালের দৌরাত্ম্য, পাসপোর্ট জটিলতা, কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে অস্বস্তিকর পরিবেশ নতুন কোনো বিষয় না হলেও তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৃত্যুর পর প্রবাসীদের প্রতি অবহেলাও। প্রবাসীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু বৃদ্ধি পেলেও তা প্রতিরোধে বা ঘটনা তদন্তে উদ্যোগী নয় দূতাবাসগুলো। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স প্রেরণকারী মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকরা দেশে অধিকতর নিগৃহীত হচ্ছেন। বিমানবন্দরে নেমেই তারা অরাজক আচরণ-ভোগান্তিতে নিপতিত হয়। অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (বামারু) প্রতিবেদনেও প্রবাসী কর্মীদের নানান দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে।
ডব্লিউইডব্লিউবির পরিসংখ্যান মতে, ২০২৩ সালে শূন্য হাতে দেশে ফিরে আসা প্রবাসীর সংখ্যা ৮৬ হাজার ৬২১ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ৮৩ হাজার ৭১৯ এবং নারী ২ হাজার ৯০২ জন। তবে সংস্থাটির নিকট পাসপোর্ট নিয়ে দেশে ফেরা প্রবাসীর কোনো হিসাব নেই। অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্টদের অভিমত, ব্যর্থ অভিবাসনের প্রকৃত চিত্র আরও নাজুক। বছরে এ সংখ্যা হতে পারে লাখের বেশি। দেশে ফিরে আসা ২১৮ প্রবাসীর ওপর বামারু কর্তৃক পরিচালিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশে গিয়ে কোনো কাজ পাননি এমন কর্মীর সংখ্যা ১৫ শতাংশ এবং চুক্তি অনুসারে কাজ পাননি ২০ শতাংশ। ফলশ্রুতিতে এসব কর্মীর দেশে ফিরে আসা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। উক্ত জরিপে অংশ নেওয়া কর্মীদের ১৫ শতাংশ বিদেশে যাওয়ার ১ মাসের এবং ২৯ শতাংশ কর্মী ৬ মাসের মধ্যে দেশে ফেরেন। অভিবাসন খাত বিশেষজ্ঞদের দাবি, যে ধরনের কাজে বাংলাদেশী কর্মীরা বিদেশে যাচ্ছেন, সেসব কাজের জন্য অন্যান্য দেশ থেকে দক্ষ কর্মীরা যাচ্ছেন। তাই বিদেশের কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের কর্মীদের চাহিদা কমছে। এ ক্ষেত্রে এটি সুস্পষ্ট যে, রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অধিকতর অনুপ্রাণিত করার জন্য প্রচলিত সুবিধাদি পর্যাপ্ত নয়। তাদের দেশে থাকা মা-বাবা-স্ত্রী-সন্তান-সন্ততিসহ পরিবার পরিজনদের জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পর্যটন-ব্যাংক-বিমাসহ সরকারি-বেসরকারি সেবাখাতসমূহে কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করে সুবিধাদির সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যথায় বৈধ পথে নয়; বরং অবৈধ পথে বা হুন্ডি ও টাকা পাচারের কদর্য পন্থায় তাদের সৎ উদ্যোগকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার সমূহ সম্ভাবনা প্রবল।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়