ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২১:০২, ৮ এপ্রিল ২০২৪

শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা

শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা

শেষ হতে চলছে ইবাদত-বন্দেগির পবিত্র মাস মাহে রমজান। সিয়াম সাধনার পুণ্য সময়ে সর্বশক্তিমানের প্রতি নিবেদন, সমর্পণে মানুষ যে মাত্রায় মাসটিকে আবাহন করে তার তুলনা সত্যিই বিরল। আবহমান ধর্মপ্রাণ জাতি-গোষ্ঠী হিসেবে আমরা বরাবরই খ্যাত। একদা অধ্যাত্মবাদের দেশ বলে প্রসিদ্ধ বাংলা ও বাঙালি অবিভক্ত ভারতের অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে নিজেদের তৈরি করা ইতিহাসের অমোঘ লিখন।

ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি মাথা চাড়া দিলে ভারত-পাকিস্তান অনাকাক্সিক্ষত বিভাজন সেখানে কোনোভাবেই ন্যায্যতা পায়নি। সঙ্গত কারণে ২৪ বছরের করাল নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি পেতে যে স্বাধীনতার বজ্রকণ্ঠ আওয়াজ ওঠে তারই ঐতিহাসিক মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যথার্থ স্বাধীনতার পরম আস্বাদে বাংলা ও বাঙালি যখন আপন ঠিকানা খুঁজে পায় তার চিরাচরিত সংস্কার, সম্ভার, আনন্দ আয়োজনও জনগোষ্ঠীকে বরাবরই উদ্বেলিত করেছে। যথার্থ ধর্মীয় সংস্কৃতি তারই অনুরণন।

ধর্ম যার তারই কিন্তু উৎসব সবার- এমন চিরস্থায়ী বোধ আজও আমাদের যাপিত জীবনকে নানামাত্রিকে ভরিয়েও দিচ্ছে। আমরা শুধু বাঙালিই নই বরং ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবেও সব আচার-আচরণ পালনে অভ্যস্ত এক মহিমান্বিত জাতিসত্তা। উৎসবপ্রিয়তা আমাদের শাশ্বত অলঙ্কার। তাই সিয়াম সাধনার মাসেও যে ইফতারির আয়োজনে নিজেদের ভরিয়ে তুলি সেটাও চিরায়ত সংস্কারের সম্মিলিত বোধ। ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে সেহরির চমৎকার আয়োজন যেন ধর্মীয় অনুভবে এক অপরিমেয় অধ্যাত্ম চেতনা।

পুরো মাস রোজার প্রাত্যহিক সম্ভার কাটানোর সময় অপেক্ষমাণ ঈদুল ফিতরের প্রস্তুতি নেওয়াও জীবনের অনুভব, অনুষঙ্গ। রমজান মাসের শেষ প্রহরে ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত মানুষ। ঈদ আনন্দের ঝলমলে আবহে সারাদেশে বিকিকিনির যে জোয়ার, সম্মিলন তাও ধর্মীয় ভাবনাভূতির অপরিমেয় দ্যোতনা। শেষ মুহূর্তের কেনাকটায় রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষের ব্যস্ততম সময় কাটানো পরিস্থিতিরই ন্যায্যতা।

সেখানে আবার যন্ত্রযানের অসহনীয় জটে সারাদেশের যে নাকাল অবস্থা সেটাও ঈদ আনন্দের ভিন্ন মাত্রার ঝক্কি ঝামেলা তো বটেই। ঈদের খুশিতে মূল কেনাকাটায় থাকে পোশাকের বাহারি সম্ভার। আর বস্ত্রশিল্পে আবহমান বাংলার যে খ্যাতি সেটা আজও তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। যে কোনো ঈদের বাজারে ঐতিহ্যিক বস্ত্রশিল্পের চাহিদায় গ্রাহক-ক্রেতা উন্মুখ হয়ে থাকে। তবে এবারের কেনাকাটায় মুদ্রাস্ফীতির চাপ কিছুটা হলেও ক্রেতাদের একটু বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আস্তে আস্তে সহনীয় করার চিত্রও স্বস্তিদায়ক। আর সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের সঙ্গে উৎসব ভাতা যুক্ত হওয়া কিছুটা স্বস্তিদায়ক। হাত খুলে ঈদ কেনাকাটাকে অন্তত ভরিয়ে দেওয়া যায়। এ তো গেল উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার দৈনন্দিন পর্ব। আর নি¤œবিত্ত কিংবা দিন এনে দিন খাওয়া অসহনীয় মজুরি শ্রমিকদের ঈদ আনন্দ কতখানি উপভোগ্য হয় তা বলা মুশকিল। তবে সব সময় জাঁকজমকপূর্ণ বর্ণাঢ্য নামিদামি শপিংমলে যেতে হবে তা কিন্তু একেবারেই নয়।

মৌসুমি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঈদ বাজারে ফুটপাতে তাদের বাণিজ্যের পশরা নিয়ে দোকান খুলে বসেন। বেচা-বিক্রির ওপরই তাদের লভ্যাংশ নির্ধারণ হয়ে যায়। তা ছাড়া ক্রেতা সাধারণেরও অভাব হয় না। ক্রেতারা নিজেদের আয়-রোজগার মাথায় রেখে এমনসব ফুটপাতের দোকানেই ঈদ কেনাকাটায় শামিল হয়। অদ্ভুত এক দর্শনীয়, দৃষ্টিনন্দন চিত্র। ফুটপাতের কেনাকাটায়ও নাকি সময়ের গতিতে ভিন্নতা এসেছে। আগে যেখানে এক দামে পণ্য বিক্রির হাঁকডাক ভেসে বেড়াত এখন সেখানে আলাদা চিত্র।

ফুটপাতের ব্যবসায়ীরাও নিজেদের বাণিজ্যিক মুনাফায় যেভাবে সম্ভব ক্রেতাদের আকর্ষণীয় করে রাখছে। সেখানে কেউ কেউ একদরে বিক্রি করলেও অন্য কেউ ডিসকাউন্টে ক্রেতাদের কাছে টানার চেষ্টা করছে। বাহারি পণ্যের পশরা সাজানোই নয় নির্দিষ্ট পণ্যের হরেক নকশা আঁকানো ডিজাইনে ক্রেতা মুগ্ধতার বিস্ময়ে কেনার আগ্রহে মশগুল হয়ে যায়। 
রমজান তো শেষ হতে চলল, তাই ঈদের কেনাকাটা ও বেচায় লাগাতার ভিড় আর হুমড়ি খাওয়ার দুরবস্থা। তবে সংশ্লিষ্ট ক্রেতা-বিক্রেতা কেউই যেন বেসামাল পরিস্থিতিকেও তেমন তোয়াক্কা করছেন না। তাই যেমন করেই হোক শেষ সময়ের কেনাকাটা অতি আবশ্যিকভাবে সম্পন্ন করাও জরুরি। বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় বস্ত্রশিল্পের চাহিদা দেশ-বিদেশে সর্বত্র প্রসিদ্ধ। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তেমন চিরস্থায়ী সম্ভার উৎসুক গ্রাহকদের নয়নাভিরামের পর্যায়ে নিয়ে যায়।

বড় বড় শপিংমলের মধ্যে আবার দেশীদশের ব্র্যান্ড যে কতখানি বাড়বাড়ন্ত আর সাড়া জাগায় গ্রাহকদের মাঝে তা নির্দিষ্ট স্থানে না গেলে বোঝাই যায় না। তবে এবার ঈদের পর পরই সর্ববিধ আবেদন নিয়ে আবহমান বাংলা ও বাঙালির নববর্ষের উদ্যাপন আনন্দ উপভোগের অনন্য মাত্রা তো বটেই। সেখানে বিকিকিনিতেও আসে নানামাত্রিক সৌরভ আর জৌলুস। ঈদ ও নববর্ষের ব্যস্ততায় তাঁতপল্লিতে যে আমেজ আর সাড়া তাও দেশ ও দশের এক অভাবনীয় গৌরবগাথার ঐতিহাসিক সম্ভার।

যা আধুনিকতা ও প্রযুক্তির মহাসমারোহেও ঐতিহ্যিক আবেদনে কিছুমাত্র পিছিয়ে নেই। ঈদের বাজারে ক্রয়-বিক্রয় দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার এক বাৎসরিক অনন্য অর্থযোগ তো বটেই। ঈদ ও নববর্ষকে মাথায় রেখে বিভিন্ন তাঁতপল্লির কারখানাগুলো যান্ত্রিক কলাকৌশলে হরেক মাত্রার পোশাক তৈরি করে গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যস্ততম সময় পার করছে। আর উত্তরবঙ্গের রেশম শিল্প-কারখানা তো মাঝারি থেকে উচ্চ মূল্যের কারুকাজ খচিত সিল্ক শাড়ি, পাঞ্জাবি ও থ্রি পিস তৈরি করে ক্রেতাদের মুগ্ধতার স্থানে নিয়ে গেছে। রাজশাহীর রেশম শিল্পের চাহিদা সেই বহু আগের।

শুধু দেশে নয় বিদেশেও প্রচুর গ্রাহক এমন শিল্পের বিশেষ সমঝদার। বস্ত্র, বয়ান, বুটিক শিল্পের অনন্য পারদর্শিতা সত্ত্বেও ঈদ বাজারে বিদেশী পণ্যের সয়লাবও এক আবশ্যিক বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা। সেখানে মূলত আসে চীন ও ভারতের পোশাক। তবে প্রতি ঈদের মতো এবারও দেশী পোশাকের বাইরে ভারতীয় শাড়ি, পাঞ্জাবি, থ্রি পিস, শিশু-কিশোরদের তৈরি কাপড়ের চাহিদা বেশি। 
শেষ প্রহরের বিকিকিনিতে রাজধানীসহ সারাদেশের বাজার এক অভাবনীয় কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর। সাথে থাকছে বাজার অর্থনীতিরও মহাযোগ। যা দেশজ উন্নয়নের এক বিরাট প্রাপ্তি। তবে শুধু যে নিজেদের জন্য আনন্দ আয়োজন তা কিন্তু নয় বরং অপেক্ষাকৃত দুঃখীজনকে সুখী করাও এক প্রকার ইবাদত। যার যা সামর্থ্য সে অনুযায়ী গরিব-দুঃখীদের পাশে দাঁড়ানো বাঞ্ছনীয়। তাই সার্বজনীন রমজান আর ঈদের মাহাত্ম্যও সবার মধ্যে সম্প্রসারিত হওয়া এক অবধারিত ধর্মীয় ও মানবিক বোধ।

তা ছাড়া সম্প্রীতির বাংলাদেশের আবহমান সংস্কার ও ঐতিহ্যিকবোধ মিলেমিশে সমভাবে সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নেওয়ার এক অষ্ট্রিক জাতিগোষ্ঠীর অনবদ্য সম্মিলন। সেটা বাদ দিলে কিন্তু জাতিগত আর বংশপরম্পরায় বৈশিষ্ট্য আর সহজাত বোধের চরম স্খলন। শুধু কি ঈদ বাজার সরগরম? ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হচ্ছে ঈদযাত্রায় গ্রামে ফেরা মানুষদের আনন্দ উল্লাসের মহাসাড়ম্বর। ঈদের লম্বা ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার যে ঢল দৃশ্যমান তা চোখে দেখার মতো।

যানজটের দীর্ঘ সারি, সময়মতো ঠিক স্থানে না পৌঁছাও যাত্রীদের দুর্ভোগের শেষপরিশেষ থাকে না। সব কিছুর পরও ঈদ মানেই আনন্দমুখর এই মহাসাড়ম্বর। তা ছাড়া রোজা ধর্মীয় গাম্ভীর্যে পার করে আসার পর তেমন আড়ম্বর তো সীমাহীন উপভোগের পরম নির্মাল্য। ঈদ আনন্দ সব শ্রেণির মানুষের জন্য সমান আবেদন নিয়ে যেন সাড়া জাগাতে পারে তেমন প্রত্যাশা।

ঈদ যাত্রায় পথের ক্লান্তি, অবসাদ, শেষ প্রহরের কেনাকাটায় ব্যাপক ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে ঈদ হয়ে উঠবে শ্রান্তি, সম্মিলন আর সৌহার্দ্যরে অম্লান দ্যুতি। যে আলোকিত ঝর্ণাধারা সর্বমানুষের মিলনযজ্ঞে অনন্য এক সুদৃঢ় গ্রন্থিতে সকলের মাঝে অভিন্ন ধারায় মুখরিত হয়ে উঠবে।
লেখক : সাংবাদিক

×