আজাদ সুলায়মান ॥ বিমানের দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ৪ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। অযোগ্যদের সরিয়ে যোগ্যদের দায়িত্বে নিয়ে আসা হচ্ছে। খোঁজা হচ্ছে যোগ্য এমডি। এখন প্রথম লাগেজ মিলছে ১৭ মিনিটে। ইমিগ্রেশান শেষ করা যায়, তিন মিনিটে। বিমানবন্দরের টয়লেটে নেই দুর্গন্ধ- কিংবা ছড়ানো মলমূত্র। মশারও ভনভনানি থিতিয়ে এসেছে। নেই টানা পার্টির দৌরাত্ম্য। পেছনে ফেলে আসা লাগেজ পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে যাত্রীর ঘরে। বাতিল করার পথে বিতর্কিত পাইলট নিয়োগ প্রক্রিয়া। একইভাবে স্বপ্নের থার্ড টার্মিনালের দরপত্র মূল্যায়নের কাজও শেষের পথে। সেপ্টেম্বরের আগেই দেয়া হবে কার্যাদেশ। দেশের আরও ৫টি বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের কাজও চলছে ধুমতালে। বাদ যায়নি পর্যটন খাতও। দেশের ১২টি স্থানে নতুন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার মাস্টারপ্ল্যান নেয়া হয়েছে। ৭০ বছর পর বুড়িগঙ্গা থেকে কলকাতার নৌপথ চালু করে দু’বাংলায় সাড়া ফেলেছে। এছাড়া দেশের প্রথম দুটো শীর্ষ পাঁচতারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল চালুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে সোনারগাঁও হোটেলও। এভাবেই বর্তমান সরকারের একশ’ দিনের সফলতা ও অর্জনকে মূল্যায়ন করেছেন এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। বলেছেন, আমি মনে করি- এই একশ’ দিনের কর্মসূচী হিসেবে অন্য যে কোন মন্ত্রণালয়ের তুলনায় বেসরকারী বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অর্জন সবচেয়ে বেশি। আমি জোর গলায় বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে পারি-অমানিশার অন্ধকার কাটিয়ে বিমান এখন আলোকবর্তিতা। সামনে অপেক্ষায় রৌদ্র করোজ্জল ঝলমলে সকাল। বিমান নিয়ে অতীতে অনেকেই অনেক কিছু বলেছেন, আমি আর তা বলতে চাই না। আমার লক্ষ্য বিপথগামী বিমানকে সঠিক পথে এনে লাভের মুখ দেখা। কোন অভিযোগ শুনতে চাই না। এটা সম্ভব শুধুই যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে। আমরা সে পথেই।
জানা গেছে, অন্য মন্ত্রণালয়ের মতোই দায়িত্ব নেয়ার পরপরই বর্তমান সরকারের একশ’ দিনের কর্মসূচী হিসেবে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। প্রথমদিন চেয়ারে বসেই তার কাছে মনে হয় এ মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুর্নাম ঘুচিয়ে সেবা বাড়িয়ে বিমানকে লাভবান করা, দেশের বিমানবন্দরগুলোতে সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু করা, পর্যটন খাতের স্থবিরতা কাটানো ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে পূর্ণোদ্যমে চালু করা। তিনি এ কয়টি টার্গেট নিয়েই মাঠে নামেন। দায়িত্ব নেয়ার প্রথম সাংবাদিক সন্মেলনেও জনকণ্ঠের এই ক’টা চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করার পরিকল্পনা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে নিজের মতামত খোলাসা করেন। ঠিক একশ’ দিনের মাথায় গতকাল বুধবার যখন জানতে চাওয়া হয় তখনও তিনি এগুলো চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেই বলেছেন, বিমান একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যাত্রীসেবা দিয়ে লাভ করাই বড় কাজ। এর চেয়ে সফলতা তো আর কিছু হতে পারে না। সেটা হওয়ার পথে। এটাই বড় সফলতা।
এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিবুল হক জানান, চোখে পড়ার মতো অনেক অর্জনই এই একশ’ দিনে নেয়া হয়েছে। যেমন বহুল আলোচিত বিমানের দূর্নীতি খাত চিহ্নিত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। লন্ডন ও কার্গো কেলেঙ্কারির হোতাদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রশাসনিক গতিশীলতা আনার জন্য একজন দক্ষ কর্মকর্তাকে পরিচালক প্রশাসন ও পরিচালক গ্রাহক সেবায় বসানো হয়েছে। এখন এমডি নিয়োগের পালা। একজন ভাল সিইও নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এরই মধ্যে দেশ-বিদেশের অনেক যোগ্য প্রার্থীর আবেদন পড়েছে। আরও পরিচালক নিয়োগের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন। এখন দূরপাল্লার ফ্লাইটের আসন প্রায় শতভাগ পূর্ণ আসা-যাওয়া করছে। কাউন্টারে গেলে টিকেট নেই, প্লেনে উঠলে সিট ফাঁকা এই অবস্থা নেই। গতকালও লন্ডন ফ্লাইট গেছে ৪১৯ আসনের পূর্ণতা নিয়ে। নতুন নতুন রুট খোলা হচ্ছে । আগামী ১৬ মে চালু হচ্ছে বিমানের দিল্লী ফ্লাইট। গুয়াংজুও যাবে ফ্লাইট।
এ সম্পর্কে বিমানের এক জিএম জনকণ্ঠকে বলেন, পূর্ণক্ষমতার পর্ষদের অধীনে কোম্পানি থাকায় এতদিন বিমানের বড় সিদ্ধান্তে কোন ভূমিকা রাখতে পারত না মন্ত্রণালয়। সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি বা অর্জন বলতে যা বুঝায় তার সবটাই আসছে মন্ত্রণালয় থেকে। মন্ত্রী ও সচিবের সার্বক্ষণিক নজরদারি ও তদারকিতে সবার টনক নড়েছে। পর্ষদের ব্যর্থতার সুযোগে মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনায় বিমান এখন অনেকটাই ঘুরে দাঁড়ানো মতো অবস্থায় পৌঁছেছে। এতদিন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা দুর্নীতিবাজ ও অনিয়মের হোতাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রকৃত সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিমানবন্দরে লাগেজ পড়ে থাকবে আর বিমানকর্মীরা যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ঘুমাবে সে দিন শেষ। ঘুম হারাম হয়ে গেছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, পাইলট ও অন্যদের ইউনিয়নবাজদের। দ্রুততম সময়ে এমডি নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার চাপ রয়েছে মন্ত্রণালয়ের। এতে আর কোন টালবাহানা বরদাশত করা হবে না।
এদিকে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, একশ’ দিনের চ্যালেঞ্জ বা কর্মসূচী কি জিনিস তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বিমানকর্মী ও কর্তারা। টিকেট নিয়ে ব্লক বাণিজ্য বন্ধ করে সবার জন্য ওপেন করা হয়েছে। নতুন এমডি, ডিএমডি ও পরিচালক নিয়োগের পর আগামী দু’মাসের মধ্যেই পাল্টে যাবে বিমানের চিত্র। এরই মধ্যে বিমানবন্দরের যাত্রীসেবায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এখন বোডির্ং ব্রিজে ফ্লাইট লাগার ১৭ মিনিটের মাথায় প্রথম লাগেজ ডেলিভারি দেয়ার রেকর্ড হয়েছে। ইমিগ্রেশানের দুর্নীতিবাজদের লাগাম টেনে ধরায় যাত্রী দ্রুত পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছে। যাত্রী নিরাপত্তার স্বার্থে এখন বেল্ট পর্যন্ত খোলা হচ্ছে- প্রয়োজনে আরও নিচে খোলা হবে। একটির স্থলে দুটো স্থানে চেক করা হয়। অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের যাত্রীদের সুবিধার্থে আরও একটি গেট খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কোন যাত্রীর অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হয়। বিমানের মতোই সিভিল এভিয়েশনেও নেয়া হয়েছে একগুচ্ছ কর্মসূচী। সচিব মহিবুল হকের মতে, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো স্বপ্নের থার্ড টার্মিনাল এখন আার স্বপ্ন নয়। সঠিক সময়েই দরপত্র খোলা হয়েছে। মূল্যায়নও শেষের পথে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে কার্যাদেশ দিয়ে এই মহাযজ্ঞের শুভ উদ্বোধন করা হবে। সিলেট এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ও রানওয়ে শক্তিশালী প্রকল্পের কাজ চলছে। কক্সাবাজারে উদ্বোধন করা হয়েছে ঝিনুকাকৃতির চোখ ধাঁধানো টার্মিনাল ভবন নির্মাণের কাজ। শেষের পথে কক্সবাজার এয়ারপোর্টের রানওয়ে নির্মাণ প্রকল্প ও জমি অধিগ্রহণের কাজ। সৈয়দপুর, রাজশাহী, যশোর, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিমানবন্দরেও নেয়া হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্প।
জানা গেছে, বর্তমান সরকারের একশ’ দিনের মধ্যেই চালু করা হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাজ। যা থমকে ছিল দীর্ঘদিন। সোনারগাঁও হোটেলেও নেয়া হয় আধুনিকায়নের প্রকল্প।
পর্যটনখাতেরও মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এই একশ’ দিনেই। বিশেষ করে ৭০ বছর পর বুড়িগঙ্গা থেকে নৌ-তরী নিয়ে কলকাতায় পাড়ি দেয়ার ঘটনা ছিল বেশ আলোচিত। নৌপথের এ যোগাযোগ নবদিগন্তের সূচনা করবে।
এ সম্পর্কে বিমান মন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, অন্য কোন মন্ত্রণালয়ের এত বেশি কর্মসূচী আছে বলে আমার জানা নেই। আমি বেশ গর্বের সঙ্গেই বলতে চাই- এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সেক্টরে যে কর্মসূচী নেয়া হয়েছে তার বাস্তবায়নও ঘটবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। বিশেষ করে থার্ড টার্মিনালের পাশাপাশি নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু করাই আমার বর্তমান স্বপ্ন, সাধনা ও চ্যালেঞ্জ।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: