ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১

একাত্তরে কূটনৈতিক যুদ্ধ ২

বাংলাদেশ ডিসেম্বরে স্বাধীন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র আগেই টের পেয়েছিল

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২১ মার্চ ২০১৮

বাংলাদেশ ডিসেম্বরে স্বাধীন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র আগেই টের পেয়েছিল

তৌহিদুর রহমান ॥ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিরোধিতা করতে থাকে। সে সময় রাশিয়া ও ভারত বাংলাদেশের পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপক্ষে অবস্থান নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপক্ষে থাকলেও মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন জাতিসংঘে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ এইচ ডাব্লিউ বুশের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়েছিল। মূলতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব বোঝার জন্যই নবেম্বরের মাঝামাঝি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল সিনিয়র জর্জ এইচ ডাব্লিউ বুশের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এক মাস আগেই জর্জ বুশ বলেছিলেন, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করতে পারে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই মুজিবনগর সরকার বিশ্বজুড়ে জনমত গঠনের কাজ করে চলছিল। মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে দৃঢ়ভাবে কাজ করেছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি লন্ডন ও নিউইয়র্কে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতায় নিয়োজিত ছিলেন। সে সময় বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রচেষ্টায় তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল জর্জ বুশের সঙ্গে দেখা করতে সক্ষম হয়। মুক্তিযুদ্ধে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কে পাকিস্তান মিশনে কর্মরত ছিলেন বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি তখন তরুণ অফিসার। তিনি নিউইয়র্কে পাকিস্তান মিশনে ডেপুটি কনসাল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন মাহমুদ আলী। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে না থাকলেও মার্কিন সরকারের চিন্তা-ভাবনা বোঝার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল মুজিবনগর সরকার। সে অনুযায়ী আবু সাঈদ চৌধুরী বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন জর্জ বুশের সঙ্গে দেখা করা যায় কি-না। তার সঙ্গে দেখা হলে মার্কিন প্রশাসনের মনোভাব বোঝা সম্ভব হবে বলেও তিনি জানান। আবুল হাসান মাহমুদ আলী তাকে বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করাটা কঠিন কাজ। তবে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। আবুল হাসান মাহমুদ আলী ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন মার্কিন প্রশাসন থেকে জানানো হয়, স্থায়ী প্রতিনিধির পক্ষ থেকে তাদের জানানো হবে। এরপর শুরু হয় অপেক্ষা। আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন। প্রায় এক মাস অপেক্ষার পর নবেম্বরের মাঝামাঝিতে জর্জ বুশের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পান তারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য শুধুমাত্র দুই জন সদস্যের কথা বলা হয়েছিল। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তবে সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য সৈয়দ আবদুস সুলতান। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধির কাছে নিয়ে যেতে চান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী পরে মার্কিন প্রশাসনকে জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্থায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দেখা করতে আগ্রহী। মার্কিন প্রশাসনকে এ বিষয়ে তিনি রাজিও করে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২২ নবেম্বর মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে গোপনীয় ভাবেই বাংলাদেশের তিন প্রতিনিধি দল সাক্ষাত করেন। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য সৈয়দ আবদুস সুলতান ও আবুল হাসান মাহমুদ আলী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতিসংঘে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশের সঙ্গে মুজিবনগর সরকারের তিন সদস্যের প্রতিনিধির বৈঠকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিষয়টি উঠে আসে। মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধির কাছে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিমত জানতে চাওয়া হয়। মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধির কাছে আরও বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মার্কিন প্রশাসন এখন কি ভাবছে। বাংলাদেশ কি এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে ? বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের এমন প্রশ্নে একটু চুপ করেছিলেন মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধি। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি সিনিয়র জর্জ বুশ বলেন, আমার ধারণা ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধির কথা শুনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি সিনিয়র জর্জ ডাব্লিউ বুশের সঙ্গে সাক্ষাত করাটা ছিল অত্যন্ত কঠিন। তবে আমাদের অব্যাহত চেষ্টায় সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে আমরা দেখা করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আর তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে কথা বলে বুঝতে পেরেছিলাম, বাংলাদেশ স্বাধীন হতে চলেছে, এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগেই টের পেয়েছিল।
×