ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়ন দর্শনে যুক্ত হয়েছে ব্লু-ইকোনমি, সুশাসনের সাতটি অগ্রাধিকার

এবার ভিশন ’২১ আদলে কাউন্সিলে স্বপ্ন দেখাবে আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২০ অক্টোবর ২০১৬

এবার ভিশন ’২১ আদলে কাউন্সিলে স্বপ্ন দেখাবে আওয়ামী লীগ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ জাতীয় কাউন্সিলে দেশকে সমৃদ্ধির সোপানে নিয়ে যেতে সুনির্দিষ্ট ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণা করবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে প্রণীত গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রে একদিকে দলের নেতাকর্মীদের জন্য যেমন থাকছে সাংগঠনিক পরিকল্পনা ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের দিকনির্দেশনা। তেমনি দেশবাসীর জন্য থাকবে ‘ভিশন-২০২১ ও ২০৪১’ বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ কী কী করতে চায় তার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ। আওয়ামী লীগের উন্নয়ন দর্শনে এবার নতুন যুক্ত হয়েছে ব্লু-ইকোনমি। প্রধানমন্ত্রী বুধবার নিজেই বলেছেন- এবারের সম্মেলনে দলের ঘোষণাপত্রে দেশকে উন্নয়ন-সমৃদ্ধির দিকে নিতে বেশকিছু ঘোষণা থাকছে। ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলটি তাদের সম্মেলনে জাতির সামনে উপস্থাপন করবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের সব অর্জন, উন্নয়ন-সমৃদ্ধির পূর্ণাঙ্গ বিবরণের পাশাপাশি আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে গৃহীত কর্মসূচি ও মহাপরিকল্পনার কথা। ঘোষণাপত্রে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার ঘোষণার পাশাপাশি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা না রাখা, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যে গড়ে তোলা, ব্লু-ইকোনমি, পররাষ্ট্রনীতি এবং যুদ্ধ নয় সারাবিশ্বে শান্তির বার্তাও। দলটির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, দলীয় রাজনীতির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মকৌশল নির্ধারণে উন্নয়নমুখী রাজনীতিতে এবারের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ ৪৬ পৃষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ভূমিকা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে ঘোষণা ও কর্মসূচীতে নির্বাচনী ইশতেহারের আদলে আওয়ামী লীগের উন্নয়ন দর্শন, তৃতীয় অধ্যায়ে উন্নয়ন ও সুশাসনের সাতটি অগ্রাধিকারের কথা থাকছে। যেখানে রয়েছে বিদ্যুত, জ্বালানি ও আইসিটি, বেসরকারী খাত এবং বাজার ব্যবস্থার সম্প্রসারণের মতো বিষয়গুলো। চতুর্থ অধ্যায়ে থাকছে খাতওয়ারি চলমান অগ্রযাত্রা শিরোনামে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের ফিরিস্তি। বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার না রাখার বিষয়টিকেও এবার বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে দলের ঘোষণাপত্রে। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন কোন দল সরকার গঠন করলেও যাতে ‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা’ ফিরতে না পারে, সেজন্য জনমত গঠন করা হবে। পাশাপাশি নির্বাচিত সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা থাকছে। এছাড়া দলের গঠনতন্ত্রেও আনা হয়েছে বেশ কিছু সংশোধনী। এতে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির আকার ৭৩ থেকে বাড়িয়ে ৮১ করা, জেলা কমিটি ৭৫, উপজেলা ৭১, ইউনিয়ন ৬৯ ও ওয়ার্ড কমিটি ৫৫ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়া ও বোর্ড গঠন, যুদ্ধাপরাধীর সন্তানরা আওয়ামী লীগের সদস্য হতে না পারার বিধানসহ বেশ কিছু সংশোধনী। আর ঘোষণাপত্রের অঙ্গীকারনামায় থাকবে সংসদীয় গণতন্ত্রের সুস্থ বিকাশ, প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, জনগণের পছন্দমতো ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। এছাড়া যুদ্ধাপরাধী এবং ১৫ আগস্টের খুনীদের উত্তরাধিকাররা কেউ আওয়ামী লীগের কোন পর্যায়ের সদস্য হতে পারবে না মর্মে একটি ধারা খসড়া গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে গঠনতন্ত্রের ২৭ নম্বর ধারায় একটি উপধারা সংযোজন করা হচ্ছে। এখানে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে। এই বোর্ড হবে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট। আর ৪৬-এর ঠ ধারায় জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচন শব্দটি যোগ করা হচ্ছে। বর্তমান গঠনতন্ত্রের ৫০ ধারায় বর্ণিত ‘নির্বাচন পরিচালনা কমিশন’ শব্দের স্থলে এখন থেকে ‘কাউন্সিল অধিবেশন নির্বাচন পরিচালনা কমিশন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এবারের দলীয় ঘোষণাপত্রে ক্ষুদ্র ঋণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতিবাচক অবস্থানের কথা তুলে ধরা হবে। এতে বলা হচ্ছে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প নয়, ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্প চালু করা হবে। যার মাধ্যমে হতদরিদ্র দূর করা সম্ভব হবে। আওয়ামী লীগের উন্নয়ন দর্শনে এবার নতুন যুক্ত হয়েছে ব্লু-ইকোনমি। এতে বলা হয়েছেÑ‘শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সাফল্যের সুবর্ণ ফসল মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি। এর ফলে মিয়ানমারের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের ২০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে সমুদয় অর্থনৈতিক অঞ্চল ও তার বাইরে মহাদেশীয় বেষ্টনী এবং একইভাবে ভারতের সঙ্গে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহাদেশীয় বেষ্টনীর মধ্যে সব ধরনের সম্পদের ওপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমুদ্র খাত, যা ব্লু-ইকোনমি নামে অভিহিত, বাংলাদেশের উন্নয়নে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়ন সুবিস্তৃত ও সুসংহত করার উদ্যোগকে দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছে। এছাড়াও দলটির ঘোষণাপত্রে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের উল্লেখ থাকছে। এতে বলা হয়েছে- দেশের উন্নয়নের চাকায় নতুন গতি সঞ্চারের জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রকল্পের প্রয়োজন হয়। অর্থনীতির ভাষায় যাকে ‘সজোরে ধাক্কা’ (বিগপুশ) বলা হয়। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই দশটি অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো- স্বপ্নের পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা দ্রুত গণপরিবহন, এলএনজি ফ্লোটিং স্টোরেজ এ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট, মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ এবং চট্টগ্রাম হতে কক্সবাজার পর্যন্ত ১২৯ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন। দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথাও থাকছে আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে। এতে বলা হয়েছে- ইতোমধ্যে ৫৬টি (সরকারী খাতে ৪২টি এবং বেসরকারী খাতে ১৪টি) অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে সাতটি বাস্তবায়নের কাজ চলছে। আগামী ১৫ বছরের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। এর মাধ্যমে অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন ডলার আয় বৃদ্ধি ও এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ২০২১ সালের মধ্যে উচ্চ (৮.০ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বেসরকারী ও সরকারী খাতে শিল্পায়নের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব¡ দেয়া হবে। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী উত্থাপিত শান্তির দর্শনও স্থান পাচ্ছে আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে। এতে বিশ্ব শান্তি, জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের মডেল শীর্ষক তাঁর ধারণা এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। এই মডেল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সব সদস্য রাষ্ট্র সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও তার এই মডেলকে দলের দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি শান্তির মডেল নিয়ে আওয়ামী লীগ কাজ করবে বলে উল্লেখ করা হয় ঘোষণাপত্রে। বলা হয়েছে, যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা মুক্ত এবং পশ্চাৎপদ জাতিসমূহের উন্নয়ন অনুকূল একটি শান্তির মডেল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে উত্থাপন করেছেন। ৬৫টি দেশ এই মডেলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। বিশ্বের জাতিসমূহের অধিকতর সমর্থন আদায় ও শান্তির মডেল বাস্তবায়নে গ্রহণ করা হবে বহুমুখী কূটনৈতিক উদ্যোগ।
×