ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

জমা টাকার অর্ধেক নেওয়া যাবে ঋণ ॥ অপপ্রচারে কান না দেওয়ার আহ্বান 

সর্বজনীন পেনশনের টাকা আইন দ্বারা সুরক্ষিত

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ২৯ আগস্ট ২০২৩

সর্বজনীন পেনশনের টাকা আইন দ্বারা সুরক্ষিত

সর্বজনীন পেনশনের বিভিন্ন স্কিমে জমাকৃত টাকা নিয়ে গ্রাহকদের ভয়

সর্বজনীন পেনশনের বিভিন্ন স্কিমে জমাকৃত টাকা নিয়ে গ্রাহকদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, একটি সুনির্দিষ্ট আইন দ্বারা সর্বজনীন পেনশনের টাকা সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সর্বজনীন পেনশনে গ্রাহকদের আস্থা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে নিজের প্রয়োজনে। ৬০ বছর বয়স হলেই একজন গ্রাহক ঘরে বসে মোবাইল ফোনে পেনশনের টাকা পাবেন। আবার বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ঘরে বসেই একজন গ্রাহক পেনশনের টাকা জমা রাখতে পারবেন। সর্বজনীন পেনশনের পুরো কার্যক্রমটি হবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেÑঅনলাইন পদ্ধতিতে। এ কারণে মেয়াদ শেষে পেনশন স্কিম থেকে মুনাফা কিংবা এর আগে ঋণ উত্তোলনে ঘুষ-বাণিজ্যের কোনো স্থান থাকবে না। 
মঙ্গলবার ঢাকার মতিঝিলে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) উদ্যোগে সর্বজনীন পেনশন স্কিমবিষয়ক এক আলোচনা সভায় বক্তাদের মুখে এসব কথা উঠে আসে। ওই সভায় এমসিসিআইয়ের সভাপতি মো. সায়ফুল ইসলামের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী খান। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, সরকারি সংশ্লিষ্ট শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকতা এবং বেসরকারি খাতের বিভিন্ন কোম্পানির মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

এমসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে সংগঠনটির সভাপতি মো. সায়ফুল ইসলাম জানান, আমরা যদি আমাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে এই সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করি, তাহলে স্বল্প সময়ে এটি সবার কাছে পৌঁছতে পারব। যার সুফল ভোগ করতে পারবে দেশের সব নাগরিক। একটি বিষয়ে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন অন্য অনেক উদ্যোগের মতো এই মহৎ উদ্যোগটি মুখ থুবড়ে না পড়ে বা মাঝখানে বন্ধ হয়ে না যায়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়িয়ে সাধারণ মানুষ এখান থেকে কত সহজে সুফল ভোগ করতে পারে, সে বিষয়ে আমাদের এখন থেকে কাজ করতে হবে।
এ ছাড়া বেসরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের কিভাবে সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত করবে, সে বিষয়েও আলোচনা করা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রাণ আরএফএল গ্রুপ, ডিবিএল গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, এই স্কিমে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের নিয়ে আসতে চান। সে ক্ষেত্রে পেনশনার নিজে ৫০ শতাংশ চাঁদা দিলে বাকি ৫০ শতাংশ চাঁদা প্রতিষ্ঠান কখন, কিভাবে পরিশোধ করতে পারবেÑ এ বিষয়টিও আলোচনায় আনা হয়। অনেকে জানতে চান বেসরকারি খাতে নিয়োজিতদের পেনশনের টাকা পরিশোধে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এমওইউ বা সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। এ ধরনের বিভিন্ন পরামর্শ ও দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা করা হয়।
এদিকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমটি চলতি মাসে চালু হওয়ার পর থেকে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে অপপ্রচার এবং সমালোচনা করা হচ্ছে। এই স্কিমটি ব্যর্থ করতে অনলাইন এমনকি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ থেকে একটি পক্ষ নেতিবাচক বক্তব্য প্রদান করছে। এতে সর্বজনীন পেনশন নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ও সন্দেহও বাড়ছে। তবে এসব বিষয়ে এবার খোলামেলা কথা বলছেন, সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান। তিনি বলেন, সর্বজনীন পেনশন দেশের প্রচলিত আইন দ্বারা গঠিত এবং আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। সুতরাং পেনশনে জমাকৃত টাকা নিয়ে গ্রাহকদের আস্থাহীনতা তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অপপ্রচার বা গুজবে কান দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ৬০ বছর মেয়াদে একজন গ্রাহক ঘরে বসে পেনশন পাবেন। এ জন্য কারও পেছনে ঘুরতে হবে না কিংবা তদ্বিরেরও প্রয়োজন নেই। পুরো পদ্ধতিটি অনলাইনে হওয়ার কারণে মেয়াদ শেষে সার্ভার থেকে অটোমেটিক পেনশনের টাকা গ্রাহকের মোবাইল ফোনে চলে যাবে। আপনি এখানে যা জমা দেবেন, তা লাভসহ আপনাকে ফিরিয়ে দেবে সরকার। এখানে কোনো ধরনের ঝুঁকি নেই, অনলাইনে সব হবে। এভাবেই পুরো বিষয়টির অটোমেশন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে গ্রাহকদের স্বার্থে আরও বেশকিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও বলেন, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক পরিস্থিতি খারাপ হলে বা দেশের সরকার পরিবর্তন হলেও সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিরাপদ থাকবে।
জমাকৃত টাকার ৫০ শতাংশ ঋণ নেওয়ার সুযোগ ॥ সর্বজনীন পেনশন জমাকৃত টাকার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত একজন গ্রাহক ঋণ নিতে পারবেন। নিজের বা পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা, গৃহ নির্মাণ, গৃহ মেরামত বা সন্তানের বিবাহের ব্যয় নির্বাহের জন্য চাঁদাদাতা ইচ্ছা করলে পেনশন তহবিলে জমাকৃত অর্থের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ হিসেবে উত্তোলন করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রেও ঋণের মাশুল দিতে হবে, যা ধার্য করবে কর্তৃপক্ষ। এ ঋণ সর্বোচ্চ ২৪ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে এবং পুরো অর্থ চাঁদা দাতার হিসাবে জমা হবে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান বলেন, পেনশন স্কিমে একাধিকবার ঋণ নেওয়ার সুযোগ থাকছে। তবে প্রথমবার গৃহীত ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত দ্বিতীয়বার ঋণ নেওয়া যাবে না।

এ ক্ষেত্রে ঠিক কতবার ঋণ নেওয়া যাবে, বিধিমালায় তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া চাঁদা দাতারা চাইলে স্কিম পরিবর্তন করতে পারবেন, বিধিমালায় সেই সুযোগ রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, চাঁদাদাতা যৌক্তিক কারণ উল্লেখ করে স্কিম পরিবর্তনের আবেদন করতে পারবেন। তিনি বর্তমানে যে স্কিমে আছেন, তার পরিবর্তে অন্য স্কিম বা স্কিমের চাঁদা প্রদানের হার পরিবর্তন করতে পারবেন, অর্থাৎ মাসে এক হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীকালে কেউ চাইলে দুই হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিতে পারবেন। বিধিমালায় আরও বলা হয়েছে, স্কিম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত স্কিমে নতুন চাঁদার হিসাব পৃথক রেখে লভ্যাংশ ও পুঞ্জীভূত জমার অর্থের হিসাব করতে হবে, যা আগের স্কিমের পুঞ্জীভূত জমার সঙ্গে যুক্ত হবে।

এ ছাড়া স্বাভাবিকভাবে স্কিম রূপান্তরের কারণে মেয়াদ পূর্তিতে মাসিক পেনশনের পরিমাণ পুনর্নির্ধারিত হবে। বিধিমালায় বলা হয়েছে, চাঁদা দাতার অনুকূলে কর্তৃপক্ষ যে স্কিম ইস্যু করবে, তার সম্পূর্ণ স্বত্ব চাঁদা দাতার। তিনি  সেই স্কিমের স্বত্ব অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সত্তার কাছে হস্তান্তর করতে পারবেন না। তবে আরও বলা হয়েছে, স্কিম বা পেনশন চলাকালে যে কোনো সময় চাঁদা দাতার মৃত্যু হলে স্কিমের অর্থ চাঁদাদাতা কর্তৃক মনোনীত নমিনি বা নমিনির অবর্তমানে চাঁদা দাতার উপযুক্ত উত্তরাধিকারী বরাবর হস্তান্তরে বাধা নেই।
সর্বজনীন পেনশনের টাকা বিকাশ, রকেট ও নগদে জমা দেওয়া যাবে ॥ সর্বজনীন  পেনশন স্কিমের টাকা মোবাইলে আর্থিকসেবা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জমা দিলে প্রতি হাজারে অতিরিক্ত খরচ হবে সাত টাকা। শতকরা হিসাবে গ্রাহকদের শতকরা ৭০ পয়সা সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। পেনশন স্কিমভেদে প্রতি মাসে ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা জমা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এই খরচ নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা অনুসরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। দেশে এখন ১৩টি এমএফএস প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে গ্রাহক ও লেনদেন সবচেয়ে বেশি বিকাশ, নগদ ও রকেটÑ এই তিন এমএফএসে।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের একটি অংশ, বিধায় সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ব্যক্তি থেকে সরকারের হিসাবে টাকা জমা পদ্ধতিতে চাঁদা দাতারা পেনশন কর্তৃপক্ষের হিসাবে এমএফএসের মাধ্যমে চাঁদা প্রদানের সেবা মাশুল একই রকম, অর্থাৎ শূন্য দশমিক সাত শতাংশ প্রযোজ্য হবে। পরিপত্রে আরও বলা হয়, চাঁদা দাতারা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশনের পর পেনশন কর্তৃপক্ষের হিসাবে অর্থ জমা করলে মোবাইলে আর্থিকসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চাঁদাদাতা বরাবর নিশ্চিতকরণ বার্তা  প্রেরণ করবে।

এদিকে সর্বজনীন পেনশন নিয়ে জনগণ যাতে কোনো অপপ্রচারে প্রভাবিত না হয়, সেদিকে নজরদারি রাখতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় তিনি এ নির্দেশ দেন। এ ছাড়া মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন নিয়ে অপপ্রচার না করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। 

×