ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

শিবির অভ্যন্তরে ফার্মেসির ছড়াছড়ি

ক্যাম্পে হাজারো ‘রোহিঙ্গা ডাক্তার’ ॥ শঙ্কিত প্রশাসন

প্রকাশিত: ২৩:২৯, ৪ জুলাই ২০২০

ক্যাম্পে হাজারো ‘রোহিঙ্গা ডাক্তার’ ॥ শঙ্কিত প্রশাসন

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ উখিয়া টেকনাফে স্থাপিত আশ্রয় ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে ফার্মেসি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ওষুধের দোকান করতে হলে লাইসেন্সের প্রয়োজন, তা জেনেও রোহিঙ্গারা নগদ টাকা কামাই করতে ওসব তোয়াক্কা করছে না। এছাড়াও ফার্মেসি ব্যবসার আড়ালে ক্যাম্পে চলছে ইয়াবা কারবার। উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, পালংখালী, টেকনাফের চাকমারকুল, উনচিপ্রাং, নয়াপাড়া, মুচনি ও শাপলাপুর ক্যাম্পসমূহে অন্তত সহস্রাধিক রোহিঙ্গার ফার্মেসি রয়েছে। ওসব ফার্মেসিতে ইয়াবা ছাড়াও মিয়ানমারের তৈরি বিভিন্ন জাতের ওষুধও মিলছে। উখিয়ার জামতলি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ১৫-১৬নং সংলগ্ন রোহিঙ্গা বাজারে ব্যাঙের ছাতার মতো রোহিঙ্গাদের ওষুধের ফার্মেসির দোকান গড়ে উঠেছে। কারও কাছে ফার্মেসির ড্রাগ লাইসেন্স নেই। এসব দেখেও যেন দেখেনা প্রশাসনের দায়িত্বরত লোকজন। ওইসব ফার্মেসির বদৌলতে ইয়াবা কারবারের পাশাপাশি কতিপয় রোহিঙ্গা ডাক্তারী পেশা চালিয়ে যাচ্ছে। হাজারো ভুয়া ডাক্তার রয়েছে আশ্রয়ক্যাম্পে। এক শ্রেণীর দালালের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসি থেকে ড্রাগ লাইসেন্সের ফটোকপি দিয়ে অবৈধভাবে ফার্মেসি দোকান খুলে ওষুধ বিকিকিনি করে যাচ্ছে এই রোহিঙ্গারা। উখিয়া জামতলি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ১৫-১৬ নং ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বাজার কেন্দ্রিক অহরহ ওষুধের দোকান, অনেকেই ক্যাম্পে নিজেদের কক্ষে অবৈধভাবে ডাক্তারী ও ওষুধ বিক্রি করছে। জামতলি রোহিঙ্গা বাজারের অলিতে গলিতে অবৈধভাবে ওষুধের ফার্মেসি খুলে পুরনো রোহিঙ্গারা নিজেদের বাংলাদেশী দাবি করে চিকিৎসার নামে অবৈধ পন্থায় ব্যবসা চালাচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভুয়া ঠিকানায় তৈরি জাতীয় সনদও সংগ্রহ করে সঙ্গে রেখেছে। জামতলির ডাক্তার সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার মোঃ ইউছুফ বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে আমাদের খেত-খামার ও জমিজমাসহ সবকিছু রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থলে চলে গেছে। চাহিদা থাকায় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। উখিয়া টেকনাফে পাঁচ লাখ বাসিন্দার স্থলে আরও অতিরিক্ত ১২ লাখের বেশি মানুষের চাহিদা মেঠাতে ব্যবসায়ীরা মালের দাম দ্বিগুণ আদায় করছে। স্থানীয় বা রোহিঙ্গা কোন পার্থক্য নেই। গ্রামবাসী না কিনলেও হঠাৎ পুরিয়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যাদি। ফলে বাধ্য হয়ে স্থানীয়দেরও বেশি দামে বিভিন্ন পণ্য কিনতে হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পরিশ্রমের টাকার বদলে কিনছে গ্রামবাসী। আর রোহিঙ্গারা কিনছে ত্রাণ বিক্রি ও নগদ পাওয়া সাহায্যের টাকায়। তাই রোহিঙ্গারা বেশি দামে পণ্য কিনলেও তাদের গায়ে লাগে না। এ কারণে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দারা গত প্রায় তিন বছর ধরে নিদারুণ কষ্টে দিনযাপন করছে। তাই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে দেরি হলে সব রোহিঙ্গাকে জনবিচ্ছিন্ন এলাকায় (দ্বীপে) নিয়ে যেতে দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। জামতলি ইলিয়াস নামে এক রোহিঙ্গা ডাক্তার মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এলএমএফ সার্টিফিকেট বানিয়েছে বলে। ওই ভুয়া ডাক্তার এইড্স রোগীর (রোহিঙ্গা) চিকিৎসাও করে থাকে বলে জানা গেছে। যার কারণে এসব রোহিঙ্গা মরণব্যাধি রোগ এইড্স নিয়েও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যেতে চাইছে না। স্থানীয় দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ডাক্তাররা কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রেড লাইসেন্স ও নাগরিক সনদ নিয়ে এবং অন্যজনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের ডিপ্লোমা সনদ এলএমএএফ, ডিএমএডি, এমএফ, আরএমপি সনদ বানিয়ে ডাক্তার সেজে চিকিৎসা ও ফার্মেসি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকে সাইনবোর্ডও টাঙ্গিয়েছে। রোগীদের চিকিৎসাপত্রও ধরিয়ে দিচ্ছে তারা। স্থানীয়রা বলেন, আশ্রয় ক্যাম্প কেন্দ্রিক ভুয়া রোহিঙ্গা ডাক্তার ও আনাড়ি চিকিৎসকরা যত্রতত্র দোকান খুলে চিকিৎসার নামে শুধু নগদ টাকাই কামিয়ে নিচ্ছে। ওইসব ভুল চিকিৎসায় কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ওইসব দোকান থেকে স্বল্পমূল্যে নকল ওষুধ কিনে মঝে মাঝে বাংলাদেশীয় লোকজনের ফার্মেসি থেকে বেশি দামে আসল ওষুধ কিনে রীতিমতো ঝগড়া বাধিয়ে থাকে রোহিঙ্গারা। শরণার্থী আইন অনুসারে উদ্বাস্তুরা যে দেশে আশ্রয় গ্রহণ করবে, ওই দেশে কোন রকমের ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারে না। শুধু আশ্রয় ক্যাম্প কেন্দ্রিক সীমাবদ্ধ থাকবে তারা। শিবিরের বাইরে যেতে হলে ক্যাম্প ইনচার্জের অনুমতির প্রয়োজন পড়ে। তবে রোহিঙ্গারা এসবের কিছুই তোয়াক্কা করছে না। তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিহীত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন অভিজ্ঞজনরা। উখিয়ার জামতলি রোহিঙ্গা বাজারে জামতলি শফিক মার্কেটে মোঃ জিকরিয়া, মোঃ তাহের, মোঃ ইরফান, ইব্রাহিম মার্কেটে মোঃ ইলিয়াছ, নুর সেলিম, মোঃ ইদ্রিস, মোঃ শমশু, আনসার উল্লাহ কেসিং প্রকাশ সচিংসহ অনেকেই ডাক্তার সেজে ফার্মেসি ব্যবসা করছে। এসব দোকান ও লাইসেন্স বাবদ সরকার হাজার হাজার টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উখিয়া-টেকনাফে ৩৪ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মালিকানাধীন সহস্রাধিক ওষুধের দোকান রয়েছে। ক্যাম্প অভ্যন্তরে অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের মালিকানাধীন কাপড়, স্টেশনারি স্টোর, রেস্তরাঁ, তরকারি, মাছ, মুদি, ফার্মেসি ও স্বর্ণের অন্তত ২০ হাজার দোকান রয়েছে। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, কুতুপালং বাজারসহ ক্যাম্পের ভেতরে বাইরে ওষুধের দোকান খুলে যারা নিজেদের ডাক্তার দাবি করে ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে ওষুধ বিক্রি করছে, তাদের ব্যাপারে অভিযোগ থাকায় ইতোপূর্বে একাধিক বার মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ফার্মেসি এবং কথিত ডাক্তারদের অর্থ ও জেল উভয় দন্ডে দন্ডিত করেছি। ইতোমধ্যে অনেক রোহিঙ্গার মধ্যে এইডস রোগ পাওয়া গেছে। সুতরাং রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। আর ফার্মেসি খুলে অনেকেই একটা ইনজেকশনের সিরিজ ২-৩ বার ব্যবহার করছে এমন অভিযোগ আমার কাছে রয়েছে। আগামী মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা যৌথ অভিযান চালিয়ে এসব ভুয়া ডাক্তার ও ফার্মেসির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
×