ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যের আহ্বান হজের খুতবায়

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যের আহ্বান হজের খুতবায়

আজাদ সুলায়মান ॥ ধর্মের নামে সহিংসতা ও উগ্রপন্থা পরিহারের আহ্বান জানিয়ে সৌদি গ্র্যান্ড খতিব আব্দুর রহমান আস সুদাইস বলেছেন, কোন ধর্ম ও দেশেই সন্ত্রাসবাদের স্থান নেই। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের আল্লাহ ও রাসুলের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ইসলামে সন্ত্রাসবাদের স্থান নেই। রবিবার আরাফাতের ময়দানে হজের খুতবা প্রদানকালে তিনি এ কথা বলেন। খুতবায় আরবকে নিরাপদ নগরী উল্লেখ করে এর নিরাপত্তা যেন অটুট থাকে সে জন্য দোয়া করেন তিনি। আব্দুর রহমান আস সুদাইস হজের এই আরাফার দিবসকে খুব গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে এ দিবসের তাৎপর্যের নানা দিক তুলে ধরেন। স্থানীয় সময় দুপুর ১টায় খুতবা শেষ হয়। তিনি সুন্নতের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং হজ পরবর্তী চার দিনের কাজগুলো ধারাবাহিকভাবে বলে দেন। আরাফাতের এই খুতবায় ইমাম ও আলেমদের উদ্দেশে আব্দুর রহমান আস সুদাইস বলেন, আমরা নবী মোহাম্মদ (স)-এর উম্মত। আমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি, ভুলে গেলে চলবে না। মানুষকে দ্বীনের পথে আনতে হবে সুন্দর হৃদয় দিয়ে। বল প্রয়োগ করে ধর্ম প্রচার করা যাবে না। উগ্রতা পরিহার করতে হবে। ইসলাম প্রচারে সব মাধ্যম ব্যবহার করতে হবে। খতিব বলেন, আরব-অনারবের কোন পার্থক্য নেই। জাতি ও দেশ ভেদের পার্থক্য ইসলাম সমর্থন করে না। এটা নবীর শিক্ষা। তিনি এখানে দাঁড়িয়ে এটা বলেছিলেন। মুসলমানরা চিরকাল এক অঙ্গভুক্ত। একজনের থেকে আরেকজনকে আলাদা করার সুযোগ নেই পরস্পরের প্রতি দয়া ও ভালবাসা প্রদর্শন করতে হবে। পরস্পরের মঙ্গল কামনা করতে হবে। খুতবায় তিনি নির্যাতিত ফিলিস্তিন, ইরাক, ইয়ামেন মুসলমানদের জন্য দোয়া করেন এবং মুক্তি কামনা করে বলেন, মুসলমানরা ভাই-ভাই। আমাদের সেভাবে চলতে হবে। ইসলাম মানবতার ধর্ম, সহানুভূতির ধর্ম। ইসলাম গ্রন্থিত হয়েছে ন্যায় বিচার দ্বারা, সততা দ্বারা ও ভাল ব্যবহার দ্বারা। এটা আমাদের মানতে হবে। আপনারা এটা মানবেন, আপনারা নিরাপদ ভূমিতে যেভাবে চলছেন হজ পরবর্তী জীবনে সেভাবেই চলবেন’। যুবকদের জন্য তিনি বলেন, ইসলামের প্রচার ঘটেছে তোমাদের মতো যুবকদের হাত ধরে। তোমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি সেটা ভুলবে না। যৌবনে গা ভাসিয়ে চলবে না। সবার উদ্দেশে তিনি বলেন, ভাল কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করবেন। আল্লাহর ইবাদতে বেশি সময় কাটাবেন, নামাজকে গুরুত্ব দেবেন। নবীজির প্রতি দরূদ পড়ে তার শাফায়াত কামনা করবেন। খুতবার বয়ানে তিনি ইসলামের চার খলিফার নাম উল্লেখ করেন এবং তাদের অবদানের কথা তুলে ধরেন। ভাষণের শেষ অংশে দোয়ায় তিনি বিশ্ব শান্তি কামনা করে মুসলমানদের ঐক্য প্রত্যাশা করেন। আত্মশুদ্ধি কামনা করেন। এ খুতবায় মহান আল্লাহ সুবহানা তালার প্রশংসা করে মানবতার মঙ্গল কামনা করেন। দোয়ায় তিনি নবীর দেখানো পথে চলার শক্তি কামনা করেন। উপস্থিত হাজীদের জন্য আল্লাহর দরবারে কবুল হজ কামনা করেন। হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জন্য দোয়া করেন। সমগ্র বিশ্বের কবরবাসীদের মাগফিরাত কামনা করেন। খুতবায় তিনি সৌদি হাজীদের উন্নয়নে গৃহীত সৌদি সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচীর প্রশংসা করেন। সেই সঙ্গে তিনি বাদশাহর সুস্থতা কামনা করে দোয়া করেন ও দোয়া প্রার্থনা করেন। এ সময় সাবেক খতিব শায়েখ আব্দুল আজিজকে মসজিদে নামিরার সামনের কাতারে চেয়ারে বসে বয়ান শুনতে দেখা গেছে। খতিব খুতবার শেষ প্রান্তে বর্তমান বিশ্বব্যাপী মিডিয়ার প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে সেনসেশনাল নিউজ তৈরি করে শান্তি বিনষ্ট করা হচ্ছে। রবিবার ফজর থেকেই আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হওয়া প্রায় পনেরো লাখ হাজী লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক-ধ্বনিতে পাপ মুক্তি ও আল্লাহর খাস রহমতের আশায় কান্নাকাটি করেছেন। দুই হাত তুলে তারা সবাই ইহকাল ও পরকালের কল্যাণের পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। মোনাজাতে বার বার ওঠে এসেছে, সন্ত্রাসমুক্ত শান্তিময় পৃথিবী গড়ার। বিশ্বের ১৬৩টি দেশ থেকে আগত প্রায় পনেরো লাখ মুসলমান আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়ে এ খুতবা শোনেন। হজ ব্যবস্থাপনায় সৌদি আরবের গৃহিত যাবতীয় পদক্ষেপের প্রশংসা করেন এবং মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে তাদের কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। সন্ধ্যায় (সূর্যাস্তে পর) তারা মুজদালিফার উদ্দেশে আরাফাতের ময়দান ত্যাগ করেন। মুজদালিফায় পৌঁছে আবারও এক আজানে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করবেন। সেখান থেকে জামারায় (প্রতীকী শয়তান)কে নিক্ষেপের জন্য কঙ্কর (ছোট পাথর) সংগ্রহ করেন। মসজিদে নামিরা থেকে খুতবার শব্দ গোটা আরাফাতে শোনা না গেলেও মুসল্লিরা রেডিও এবং টিভির মাধ্যমে শুনেছেন গুরুত্বপূর্ণ এ খুতবা। তিনি খুতবায় সারাজাহানের মুসলিম উম্মাহর শান্তি কল্যাণ ও সমৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন। দুপুরে খুতবার পর জোহর ও আছরের নামাজ আদায় করেন হাজীরা। তাঁরা সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে পাঁচ কিলোমিটার দূরের মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায়ের নিয়তে রওনা হন। রাতে সেখানে অবস্থান করেন খোলা মাঠে। শয়তানকে নিক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহ করেন এখানেই। আজ (সোমবার) মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে হাজীদের কেউ ট্রেনে, কেউ গাড়িতে, কেউ হেঁটে মিনায় যাবেন এবং নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরবেন। মিনায় বড় শয়তানের উদ্দেশে সাতটি পাথর মারার পর পশু কোরবানি দিয়ে মাথার চুল ছেঁটে (মাথা ন্যাড়া করে) গোসল করবেন। সেলাইবিহীন দুই টুকরো কাপড় বদল করবেন। এর পর স্বাভাবিক পোশাক পরে মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে কাবা শরীফ সাতবার তাওয়াফ করবেন। কাবা শরীফের সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় ‘সাঈ’ (সাতবার দৌড়াবেন) করবেন। সেখান থেকে তাঁরা আবার মিনায় যাবেন। মিনায় আরও এক বা দুই দিন অবস্থান করে হজের অন্য আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করবেন। এর পর আবার মক্কায় ফিরে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন। আগে যাঁরা মদীনায় যাননি, তাঁরা বিদায়ী তাওয়াফের পর মদীনায় যাবেন। যাঁরা আগে মদীনায় গেছেন, তাঁরা নিজ নিজ দেশে ফিরবেন। এবারও কটি স্যাটেলাইট চ্যানেল সৌদিয়া টেলিভিশনের কল্যাণে আরাফাতের ময়দান থেকে খুতবা ও দোয়া সরাসরি সম্প্রচার করে। এতে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ কোটি কোটি মানুষ আরাফাতের হজের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। জানা যায়, এবার আরাফাতের ময়দানে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় হজের সামগ্রিক কর্মকা- তদারকি করা হয়েছে। বাংলাদেশের হাজীদের সবাইকে একটি নির্দিষ্ট চিহ্নিত স্থানের খিমায় রাখার আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে অনেকেই আখেরি মোনাজাত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিজ নিজ স্বজনদের কাছে সরাসরি সম্প্রচার করেছেন। এতে বাংলাদেশে অবস্থান করেও অনেকে মোনাজাতে অংশ নেন বলে জানা যায়। সৌদি হজ মন্ত্রণালয় ও মোয়াচ্ছাসা কার্যালয় সূত্র জানায়, মক্কা, মিনা ও আরাফাতের ময়দানে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে সব হাজীকে বিনামূল্যে খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ সব সুবিধা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান হাজীদের নানা উপহার দিচ্ছে। জানা যায়, পবিত্র হজ পালন করতে এসে এ পর্যত ৩৫ বাংলাদেশীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের সব হাজী সুস্থ আছেন। হজ মিশনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে হজযাত্রীদের সার্বিক বিষয়ে দেখভাল করা হয়। হজের তিন ফরজের মধ্যে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হিজরী ১০ সালে অর্থাৎ ৬৩২ খ্রীস্টাব্দে হজ চলাকালীন সময় আরাফাতে অবস্থিত জাবালে রহমত পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের উদ্দেশে হযরত মোহাম্মদ (স) বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ ভাষণ। তাই সচরাচর এটিকেই বিদায় খুতবা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ অনুযায়ী মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে এ ভাষণেই চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দেয়া ছিল। কাবা শরীফের চাদরে পরিবর্তন ॥ প্রতিবারের ন্যায় এবারও কাবা শরিফের চাদর পরিবর্তন করা হয়েছে। দরজা ও বাইরের জন্য ব্যবহৃত দু’টো চাদরই মজবুত রেশমি কাপড় দিয়ে তৈরি। গিলাফের মোট পাঁচটি টুকরা বানানো হয়। চারটি টুকরা চারদিকে এবং পঞ্চম টুকরাটি দরজায় লাগানো হয়। টুকরাগুলো পরস্পর সেলাইযুক্ত। কাবার গিলাফের প্রতিটি কাপড়ের জন্য প্রয়োজন হয় ৬৭০ কেজি রেশম, ১৫০ কেজি সোনা ও রূপার চিকন তার। ৪৭ থান সিল্কের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয় এই গিলাফ, মোট আয়তন ৬৫৮ বর্গমিটার। প্রতিটি থান ১ মিটার লম্বা, ৯৫ সেন্টিমিটার চওড়া। একটা আরেকটার সঙ্গে সেলাই করা। প্রতিবছর দুটি করে (একটি সতর্কতামূলক) গিলাফ তৈরি হয়। একটি হাতে তৈরি, বানাতে সময় লাগে আট-নয় মাস। অন্যটি মেশিনে মাত্র এক মাসে তৈরি করা হয়। পুরনো গিলাফটি কেটে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র ও সংস্থাকে উপহার হিসেবে প্রদান করা হয়।
×