রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে কৃষ্ণচূড়া। সম্পূর্ণ ঝরে পড়ার আগেও সৌন্দর্য বিলাচ্ছে
প্রকৃতি বেশ বিগড়ে আছে এখন। গরমে টেকা যাচ্ছে না। তার ওপর ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাত। উপকূলীয় অঞ্চল একেবারে তছনছ করে দিয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকায় উদ্বেগের কিছু ছিল না। কিন্তু শেষতক ভালোই ভুগতে হয়েছে নগরবাসীকে। তুমুল বৃষ্টিতে ঝড়ো হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল অনেক কিছু। এমনকি রাস্তার ধারে উপড়ে পড়েছিল বৃক্ষ।
গাছ যে আঘাত সইতে পারে না, ফুল কি করে পারবে? ঘন মঞ্জরি থেকে তাই অনিচ্ছায় ঝরে পড়েছে কৃষ্ণচূড়া। এত বেশি ঝরেছে যে, কোনো কোনো ফুটপাত ঢাকা পড়েছে ফুলে। বিশালকার গাছ ঝড়ো হাওয়ায় ল-ভ- এখন। আগের মতো ঘনবদ্ধ নয় ফুলগুলো। যেগুলো আছে সেগুলোও খুব বেশি দিন টিকবে না। স্বাভাবিক নিয়মে ঝরে পড়বে। বিলীন হয়ে যাবে। তবে আশার কথা যে, শেষ বেলায়ও রং হারায়নি কৃষ্ণচূড়া। বরং ফুরিয়ে যাওয়ার আগে ঝলক দেখাচ্ছে।
এর আগে গ্রীষ্মের শুরুতে ফুলটি ফুটতে শুরু করেছিল। পাপড়ির হাল্কা লাল রং ক্রমে গাঢ় হয়েছে। দেখতে দেখতে রঙিন হয়ে উঠেছে গোটা রাজধানী। সৌন্দর্যের কথা বিবেচনা করেই শহরের বহু রাস্তার ধারে পার্কে উদ্যানে অসংখ্য কৃষ্ণচূড়া লাগানো হয়েছিল। ফলে ফুলপ্রেমীরা তো বটেই, সাধারণ পথিকও উপভোগ করেছেন এর সৌন্দর্য। বর্তমানে ফুলের পরিমাণ কমলেও, বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া পাপড়ির রং আরও উজ্জ্বল হয়েছে।
তাকালে ভীষণ আরাম হয় চোখের। আগে ওপর থেকে তাকালে গোটা গাছটাকেই লাল মনে হতো। এই লাল মনের ভেতরে অদ্ভুত একটা দোলা দিয়ে যেত। এখন তেমনটি না হলেও, ফুলের প্রকৃত গঠন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। লাল ফুল, সবুজ পাতার কম্পোজিশন বেশ লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে ফুরিয়ে যাওয়ার আগে শেষ ঝলকটা দেখাচ্ছে কৃষ্ণচূড়া।
কৃষ্ণচূড়ার বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া। এটি ফাবাসিয়ি পরিবারের অন্তর্গত। গুলমোহর নামেও ডাকা হয়। আদি নিবাস আফ্রিকার মাদাগাস্কার। ১৮২৪ সালে সেখান থেকে প্রথম মুরিটাস, পরে ইংল্যান্ড এবং শেষ অবধি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার ঘটে। এখন জন্মে আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন, ভারতসহ বিশ্বের বহু দেশে। ধারণা করা হয়, কৃষ্ণচূড়া ভারত উপমহাদেশে এসেছে তিন থেকে চার শ’ বছর আগে। বহুকাল ধরে আছে বাংলাদেশে।
তবে ফুলের নাম কী করে কৃষ্ণচূড়া হলো সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায় না। ধারণা করা হয়, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অবতার কৃষ্ণের নামে ফুলটির নামকরণ করা হয়েছে। একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়বে, কৃষ্ণের মাথায় চুলের চূড়া বাঁধার ধরনের সঙ্গে ফুলটির বেশ মিল। সেখান থেকেই কৃষ্ণচূড়া। আবার উদ্ভিদবিজ্ঞানী, নিসর্গপ্রেমী কিংবা কবি- সাহিত্যিকরাও নামকরণ করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়।
উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা মতে, এই ফুল বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ফুটে থাকে। বাংলাদেশে ফোটে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত। প্রথম মুকুল ধরার কিছু দিনের মধ্যেই পুরো গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। ফুলের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর উজ্জ্বল রং। তরুরাজ্যে এত উজ্জ্বল রং সত্যি দুর্লভ। ফুলের পাপড়ির রং গাঢ় লাল, লাল, কমলা, হলুদ, হাল্কা হলুদ হয়ে থাকে। প্রস্ফুটিত ফুলের ব্যাস ২ ইঞ্চি থেকে ৩ ইঞ্চি। বৃত্তির বহিরাংশ সবুজ।
ভেতরের অংশ রক্তিম। কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো বড় চারটি পাপড়িযুক্ত। পাপড়ি প্রায় ৮ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হয়ে থাকে। কৃষ্ণচূড়া জটিল পত্রবিশিষ্ট। প্রতিটি পাতা ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার লম্বা। ২০ থেকে ৪০ উপপত্র বিশিষ্ট। আরও তথ্য আছে দেওয়ার মতো। সে দিকে না যাই। বরং ফুলটির দিকে চোখ মেলে তাকাই।
ঝড়ের পরের ক’দিন চন্দ্রিমা উদ্যান, রমনা পার্ক, হাতিরঝিল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ বেশকিছু এলাকা ঘুরে দেখেছি, ফুলটির সৌন্দর্যে ভাটা পড়েনি। হোটেল সোনারগাঁওয়ের পেছনের সীমানা প্রাচীর ঘিরে আছে অনেকগুলো কৃষ্ণচূড়া গাছ। ঝিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি গাছে ফুল। একসঙ্গে থাকায় অনেক ফুল বলে মনে হয়।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের দুই পাশের গাছগুলোয়ও শেষ বেলার কৃষ্ণচূড়া। আপনার আশপাশেও আছে। আছে বলেই শামসুর রাহমান লিখেছিলেন : আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে...। লাল রঙের পাপড়িতে বাঙালির চেতনার রং দেখেছিলেন কবি। আপনিও দেখুন। কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য উপভোগ করার এখনই শেষ সময়।