ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

শত শত কোটি টাকার ক্ষতি

রেমালের আঘাতে এখনও জলমগ্ন অর্ধ শতাধিক গ্রাম

বাবুল সরদার, বাগেরহাট

প্রকাশিত: ২১:৪৮, ২৯ মে ২০২৪

রেমালের আঘাতে এখনও জলমগ্ন অর্ধ শতাধিক গ্রাম

ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষতবিক্ষত এলাকা

বাগেরহাটের সর্বত্র দীর্ঘ ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষত স্পষ্ট। ১৮ লক্ষ লোক অধ্যুষিত এ জেলা অধিকাংশ পরিবার রেমালের আঘাতে কমবেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। বিদ্যুৎ, মৎস্য, কৃষি, শিক্ষা, প্রাণীসম্পদ, যোগাযোগ, ব্যবসা, বাঁধ, জীব বৈচিত্র্য, সরকারী-আধা সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোসহ সকল ক্ষেত্রে ক্ষতি চিহ্ন স্পষ্ট। আক্ষরিক অর্থে প্রবল ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা ও আম্পানের পর ঘূর্ণিঝড় রেমালে সুন্দবনসংলগ্ন উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে। রক্ষা পায়নি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। যতই সময় গড়াচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে ধ্বংসলীলার ক্ষত।সরকারী তথ্যে কৃষিতে ক্ষতি ১০৬ কোটি
রেমালের ৪৮ ঘন্টা পরেও এ জেলার মোড়েলগঞ্জ, রামপাল, মোংলা, শরণখোলা, কচুয়া ও সদর উপজেলার অর্ধ শতাধিক গ্রাম জলমগ্ন হয়ে আছে। আমনের বীজতলা, পানবরজ, কলা-পেঁপে,মরিচ, শসা, বেগুন, কাকরোল,পটলসহ সব ফসলের ক্ষেত ডুবে রয়েছে। জেলায় ১১ হাজার হেক্টর ফসলী জমি বিধ্বস্থ হয়ে কমপক্ষে ১’শ ৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শংকর কুমার মজুমদার জানিয়েছেন।৪৫ হাজার বাড়ি ঘর বিধ্বস্থ
অসংখ্য গাছ-গাছালিসহ ১০ হাজার ঘরবাড়ি ভেঙ্গে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আরও ৩৫ হাজার ঘরবাড়ি। জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের ধানসাগর গ্রামে ঘূর্ণিঝড়ে গাছ চাপা পড়ে ফজিলা বেগম নামের এক নারী নিহত হন।এখনও সোয়া লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন
বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা ৭২ ঘন্টা সোয়া লাখ মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছেন। অসংখ্য মানুষের ফ্রীজে থাকা মাছ-মাংস-তরিতরকারী পঁচে গেছে। বাগেরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জিএম সুশান্ত রায় বলেন, ঝড়ে বিদ্যুতের ১১৪ টি পোল ভেঙে গেছে, হেলে পড়েছে ২১৭২ টি পোল, ১৫৪১ টি তার ছিঁড়ে গেছে, ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে ৩৭ টি, মিটার ভেঙেছে ৪৯৮ টি, ক্রস আর্ম ভেঙেছে ৭৩ টি, সার্ভিস ড্রপ তার ছিঁড়েছে ৪৬৭ টি, ইন্সুলেটর ভেঙেছে ৮৩ টি। তিনি বলেন, এ জেলায় পল্লী বিদ্যুতের ৪ লাখ ৮৫ হাজার গ্রাহক আছেন। ঝড়ো বাতাসে বৈদ্যুতিক খুঁটি ও বিদ্যুৎ লাইনও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। জেলার ৫ লক্ষাধিক গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এখনও পর্যন্ত প্রায় সোয়া লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছেন। অতিরিক্ত লোক নিয়োগ করে মেরামত করা হচ্ছে। ঠিকাদার ও পল্লী বিদ্যুতে সাড়ে ৫’শ কর্মী একযোগে কাজ করছে।” আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বিদ্যুৎ লাইন স্বাভাবিক হবে বলে তিনি আশাবাদী।

বাঁধ ভেঙ্গে ও উপচে লোকালয় প্লাবিত
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল-বিরুনী জানান, বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ৩৩৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় নদী পাড়ের ৭ কি:মি: ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এরমধ্যে ১.৪৮ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ১২ টি স্থান থেকে রিংবাঁধ ভেঙ্গে এবং অতি জোয়ারের পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে জরুরী ভিত্তিতে তা সংস্কার করা হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করে।

৪’শ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে
জেলা মৎস্য কর্মকর্ত এস.এম রাসেল বলেন, রেমালের অঘাতে প্রাথমিক তথ্যে জেলার ৩৫ হাজার ঘেরে ভেসে ৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি ও মাছ চাষিরা বলছেন, ক্ষতি পরিমান ৪’শ কোটি টাকার বেশী। তাদের ভাষাষ, জেলার প্রায় সব মাছ চাষি নি:স্ব হয়ে গেছে।” বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, প্রাথমিক হিসেবে মৎস্য খাতে ৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।

দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্টান মারত্মক ক্ষতিগ্রস্থ
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস.এম ছায়েদুর রহমান জানান, রেমালের আঘাতে জেলার দেড় শতাধিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মারত্মক ক্ষতি হয়েছে। গাছ পড়ে ভবন ভেঙ্গে, চাল উড়ে, প্রাচীর ভেঙ্গে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের বইপত্র-খাতা, কম্পিউটার, আসবাবপত্র ভিজে বা’ ভেঙ্গে গেছে। এতে কমপক্ষে ৭০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।’ তাঁর ভাষায়, গাছ পড়ে অনেক প্রতিষ্ঠান তছনছ হয়ে গেছে।’’ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুকুমার মিত্র জানান, অনুরূপ ৬৮ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কমবেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।  
 
বাগেরহাটে ১২ কি:মি: সড়ক ক্ষতিগ্রস্থ
বাগেরহাট সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দিন জানান, সড়কের ওপর গাছ ভেঙ্গে পড়ে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তা সড়ক বিভাগ ও ফায়ার ব্রিগেডের যৌথ উদ্যোগে মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যে অপসারণ করা হয়েছে। তবে স্থানীয় কিছু সড়কে কাজ চলছে। প্রবল বাতাসের সাথে অতিবৃষ্টিতে ও অস্বাভাবিক জোয়ারে পানির চাপে এ জেলার বিভিন্ন সড়কের প্রায় ১২ কি:মি: সড়ক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রাথমিক হিসেবে প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ব্যাপারে মাঠপর্যায়ে প্রাথমিক সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে শত কোটি টাকার ক্ষতি  
বাগেরহাট জেলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি লিয়াকত হোসেন লিটন বলেন, অতিরিক্ত জলচ্ছাসে ও প্রবল বৃষ্টিতে এ জেলার ২ হাজারের বেশী ব্যবসায়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠে মালামাল ভিজে গেছে। এতে কয়েক শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মোড়েলগঞ্জ পৌর সভার মেয়র মনিরুল হক তালুকদার বলেন, শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠে কোটি কোটি টাকার মালামাল ভিজে গেছে। এমন দীর্ঘ ঘুর্ণিঝড় ও পানির চাপ জীবনে দেখিনি। এখনও পানিতে তলিয়ে আছে শহর-গ্রাম। উঁচু দালানের নিচেও পানি জমে আছে।’ বাগেরহাট বিসিকের ব্যবসায়ী কমল আাঁশ জানান, তাঁর ১০ লাখ টাকার ডাল-ছোলা ভিজে নষ্ট হয়ে গেচে। তাঁর ভাষায়, এখানে সবাই এমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।” এছাড়া ২ শতাধিক পোল্ট্রি খামার মারত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। 
 
সুন্দরবনের প্রাণ বৈচিত্রের ব্যাপক ক্ষতি
অনুরূপ বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দর বনের প্রাণ প্রকৃতির মারত্মক ক্ষতি হয়েছে। এ পর্যন্ত অর্ধ শতাধিক মৃত হরিনের দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। গাছগাছালি ছাড়াও এ বনের ৬ কোটি টাকার অবকাঠামো ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছে বলে প্রধান বন সংরক্ষক মো: আমীর হোসাইন চৌধুরী জানিয়েছেন। জীব বৈচিত্রের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপনে কাজ চলছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাঃ খালিদ হোসেন বলেন, এই ঝড়ে ৫ লক্ষ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৪৫ হাজার ঘর বাড়ি। আমরা ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা দিচ্ছি। উপজেলা প্রশাসনকে ৭৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১৯ লাখ টাকা, ১১ হাজার কেজি চিড়া, ৭শ কেজি গুড় ও ২০ হাজার প্যাকেট বিস্কুট দিয়েছি। দপ্তর অনুযায়ী আরও সহায়তার জন্য তালিকা হয়েছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।  

শহিদ

×