ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

এক হাজার শিক্ষার্থী এখন ইংরেজিতে দক্ষ

যশোরে এক হামিদুল স্যার নিভৃতে কাজ করে চলেছেন

সাজেদ রহমান

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

যশোরে এক হামিদুল স্যার নিভৃতে কাজ করে চলেছেন

অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন

যশোরে ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক হাজার শিক্ষার্থী এখন ইংরেজিতে পারদর্শী। তারা ইংরেজিতে ডিবেট করে। খেলতে খেলতে তারা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাও রয়েছে। আর তাদের এভাবে তৈরি করেছেন একজন কলেজ শিক্ষক। তিনি হলেন যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন।
শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে এবং ভাষা শিক্ষার প্রক্রিয়াকে সহজ করতে সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. হামিদুল হক ২০১৫ সালে ‘আইডিয়া স্পোকেন-দ্য গেম মেথড’ নামক লার্নিং ইনস্টিটিউট তৈরি করেন যেখানে শিক্ষার্থীরা খেলতে খেলতেই ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে উঠছে। হামিদুল হক দীর্ঘদিন গবেষণা করে দেখেছেন বাংলাদেশের তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ দীর্ঘ ১০ থেকে ১২ বছর ইংরেজি শিখন প্রক্রিয়ায় থাকে কিন্তু কথা বলতে পারে না, ভয় পায়। তা হলে সমস্যা কোথায়?

সেটা খুঁজতে গিয়ে তিনি দেখেন আমাদের ইংরেজি শিখন প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে আসল সমস্যা। জিএমটি মেথড-এর মধ্য দিয়ে ইংরেজি শিখন প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি সময় নেয়। এর সমাধান খুঁজতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করেন শিক্ষার্থীরা আনন্দ নিয়ে খেলার ছলে যখন কোনো কিছু শেখে তখন উক্ত বিষয় শেখা সহজতর হয় এবং এর ফলাফল হয় দীর্ঘমেয়াদি। সেই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি তৈরি করেন খেলতে খেলতে ইংরেজি শেখার নতুন মেথড আইডিয়া স্পোকেন দ্য গেম মেথড।

বাংলাদেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক খেলাধুলাকে তিনি ইংরেজি শিখন উপকরণ হিসেবে চমকপ্রদভাবে ব্যবহার করেছেন (যেমন- ওপেনটি বায়োস্কোপ ও মিলো, ইচিং বিচিং চিচিং ছা, কারি গেম, ওয়ার্ড গেম, ওয়ার্ড জাম্পিং, ইংরেজি নাটক উপস্থাপন, ইংরেজি বিতর্ক প্রভৃতি)। গতানুগতিক ইংরেজি শেখার ধারা থেকে তার উদ্ভাবিত এই খেলতে খেলতে ইংরেজি শেখার প্রক্রিয়া অত্যন্ত ফলপ্রসূ ও স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। 
যশোর জেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন বিদ্যালয়ে তার নেতৃত্বে একঝাঁক শিক্ষার্থী সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই ব্যতিক্রমী মাধ্যমে ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে উঠছে। উক্ত ইনস্টিটিউট থেকে নিজে কোনো অর্থ গ্রহণ করেন না তিনি বরং আইডিয়া স্পোকেন থেকে অর্জিত শতভাগ অর্থ শিক্ষার্থীদের নিয়ে সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করেন হামিদুল হক। এভাবেই যুবসমাজকে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করে তোলার পাশাপাশি শেখাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবার মানসিকতা।

অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন জানান, ‘স্মার্ট যশোর ফর স্মার্ট বাংলাদেশ’ শিরোনামে আইডিয়া স্পোকেন দ্য গেম মেথড’-এর আয়োজনে গত বছর শুরু হয়েছিল খেলতে খেলতে ইংরেজি শিখন কার্যক্রম। গত বছর ১০ জুন যশোরের স্বনামধন্য দশটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে প্রথম ইএসএল (ইংলিশ অ্যাজ এ সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ) সামিট আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই প্রকল্প শুরু হয়েছিল। যেখানে অংশ নেওয়া দশটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছয় মাসব্যাপী কর্মসূচি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে।

এরই অংশ হিসেবে দশটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইএসএল ক্লাব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই সহ-শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে আইডিয়া স্পোকেন। এই ছয় মাসে (জুন ২০২৩ থেকে ডিসেম্বর ২০২৩) ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক হাজার শিক্ষার্থীকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ব্লেন্ডেড মেথডে ইংরেজি শিখিয়েছে আইডিয়া স্পোকেন দ্য গেম মেথড। সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন উল্লেখ করেন, যে শিক্ষার্থীরা বাংলাতেও গুছিয়ে কথা বলতে ভয় পেত; তারাই এখন ইংরেজিতে করছে বিতর্ক, পাশাপাশি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে ইংরেজিতে উপস্থাপন করছে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি ওই কোর্সের সমাপনী আয়োজন করা হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম ইএসএল সিম্বোলিক কনভোকেশনের মধ্য দিয়ে। সেখানে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের মতো করেই কনভোকেশন হ্যাট মাথায় দিয়ে, সার্টিফিকেট অর্জন করছিল ওই ৬ মাসের শিখনের।
হামিদুল হক শাহীন বলেন, আমরা এই আয়োজন করেছিলাম মূলত দুটি কারণে। একটি হলোÑ আমরা রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জানাতে চাচ্ছি যে- আইডিয়া স্পোকেন উদ্ভাবিত খেলতে খেলতে ইংরেজি শেখার এই প্রক্রিয়াটি আমাদের শিক্ষা কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে শিক্ষার্থীরা লাভবান হবে। খেলার ছলে এই বয়সেই যদি তারা ইংরেজির ভয় দূর করতে সক্ষম হয়, তাহলে স্মার্ট সিটিজেন হিসেবে স্মার্ট কমিউনিকেশনে তারা অগ্রসর হবে অনেক দ্রুত।

আর দ্বিতীয়ত, ওই সমাবর্তন আয়োজনের কারণে যেন শিক্ষার্থীদের ভিশনটা আরও বড় করা যায় এখন থেকেই। ফলে একাধারে আমরা তিন চারটা উদ্দেশ্যে কে নিয়ে কাজ করছিÑ রাষ্ট্র কে জানাতে চাচ্ছিÑ শিক্ষার্থীদের জন্য সেলিব্রেশনের আবহ তৈরি করছি পাশাপাশি ভবিষ্যতে ওদের স্বপ্নকে রাঙাতে সাহায্য করছি। 
যশোর জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আইডিয়া স্পোকেন দ্য গেম মেথড এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মো. মশিউর রহমান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। 
শুধু আইডিয়া স্পোকেন নয়। সমাজের জন্য কাজ করছেন হামিদুল হক শাহীন। পড়াশোনার পর চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেদের মতো কিছু করার চেষ্টা করছেন যশোরের কিছু তরুণ। সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীনের অনুপ্রেরণায় তরুণরা গড়ে তুলেছেন ‘আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থা।’ এই সংস্থার মাধ্যমে উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কর্মকা- পরিচালনা করছেন তারা। এতে করে নিজেদের উপার্জনের পাশাপাশি এলাকার উন্নয়নেও তারা ভূমিকা রাখছেন। 
এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের দিয়ে তৈরি আইডিয়া পিঠা পার্কের পণ্য এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। পিঠার কারখানা স্থাপন ও কাজের জন্য শিক্ষক শাহীন যশোর শহরের খড়কী শাহ আব্দুল করিম রোডে নিজের একটি জায়গা (৫ দশমিক ৮ শতাংশ) ছেলেমেয়েদের দিয়ে দিয়েছেন। 
কথা হয় আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থার সভাপতি আজহারুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক পার্শা সারজানার সঙ্গে। তারা জানান, সংগঠনটি ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অনেকেই এখন বিকল্প হিসেবে পিঠা তৈরি ও বাজারজাতকরণে নিজেদের সংশ্লিষ্ট করেছেন। তারা বলেন, ইতোমধ্যে আমরা কয়েক ধরনের শুকনো পিঠা মালয়েশিয়াতেও পাঠিয়েছি।  দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও আমাদের থেকে প্রচুর পিঠা নিয়েছে। যথাযথ মার্কেটিং ও সরকারি সহায়তা পেলে দেশীয় পিঠাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার কথা জানান তারা।

×