ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

বিমানের পাইলট গ্রেফতার ,সাসপেন্ড ;###;মিরপুরের বাসায় জঙ্গী আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়ায় সব চক্রান্ত ভেস্তে গেছে

টুইন টাওয়ার স্টাইলে হামলার ছক

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১ নভেম্বর ২০১৭

টুইন টাওয়ার স্টাইলে হামলার ছক

আজাদ সুলায়মান ॥ টুইন টাওয়ার স্টাইলে ঢাকায় বহুতল ভবনে বিমান হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল পাইলট সাব্বিরের। এ ধরনের সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। সে সুযোগ তিনি পাননি। এর আগেই তার মিরপুরের বাসায় জঙ্গী আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়ায় ভেস্তে যায় সে পরিকল্পনা। বিষয়টি র‌্যাবের পক্ষ থেকে বিমানকে জানানোর পর তাকে দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়। কিন্তু আবারও অদৃশ্য শক্তির তদবিরে মাত্র কয়েকদিনের মাথায় ফ্লাইট চালাতে শুরু করেন। তখন তিনি পরিকল্পনা করেন ঢাকায় বিশেষ এক ভিআইপির ভবনে আঘাত করার। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য র‌্যাবের হাতে আসার পরই সাব্বিরকে আটক করে র‌্যাব। সোমবার মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুরের দারুস সালাম এলাকা থেকে তাকে আটকের পর এ ধরনের বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশ করেন র‌্যাব পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান। বলেন, বিমান নিয়ে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগেই তাকে আটক করা হয়েছে। তার সম্পর্কে অপর জঙ্গী বিল্লালের ১৬৪ ধারার জবানবন্দীতে এ ধরনের তথ্য প্রকাশের পরপরই সাব্বিরকে আটক করা হয়। সাব্বির ছাড়াও তার মাসহ অন্য তিন সহযোগীকে আটক করা হয়। তারা হলেনÑ তার মা মোসাঃ সুলতানা পারভীন (৫৫), মোঃ আসিফুর রহমান আসিফ (২৫) ও চা দোকানদার মোঃ আলম (৩০)। তাদের আজ বুধবার আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করা হবে। আটকের পরপরই তাদের কাছ থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে দাবি করেন র‌্যাব পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান। সাব্বির বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৩৭-এর কো-পাইলট। তার পিতা হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ। গত ৪ সেপ্টেম্বর চার দিনব্যাপী তাদের মিরপুর দারুস সালাম এলাকায় কমল প্রভা নামক বাড়ির পঞ্চম তলায় জঙ্গী আস্তানায় র‌্যাব অভিযান পরিচালনা করে। ওই অভিযানে জঙ্গীদের বোমা বিস্ফোরণে জেএমবির সদস্য মীর আকরাবুল করিম ওরফে উপল ওরফে আব্দুল্লাহ, তার দুই স্ত্রী, দুই পুত্রসন্তান এবং তার দুই সহযোগীসহ নিহত হয়। তারপর গ্রেফতার করা হয় সাব্বিরের বাবা হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদকে। র‌্যাব তখন সাব্বিরকে বিপজ্জনক পাইলট হিসেবে বিমানকে নোটিস করে। এতে বিমান তাকে সব ধরনের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার নির্দেশ প্রদান করে। এরপর সাব্বির সম্পর্কে ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু করে র‌্যাব। এ অবস্থায় ২৬ অক্টোবর র‌্যাব-৪-এর অভিযানে নারায়াণঞ্জের ফতুল্লা হতে আব্দুল্লাহর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী জেএমবি সদস্য মোঃ বিল্লাল হোসেন (২৩) ধরা পড়ে। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি প্রদান করে গ্রেফতারকৃত মোঃ বিল্লাল হোসেন। ওই জবানবন্দীতে রেকর্ড করা হয় বিমান নিয়ে সাব্বিরের নাশকতার পরিকল্পনা। এ ধরনের তথ্য ফাঁসের পরই র‌্যাব তাকে আটক করার জন্য মাঠে নামে। অবশেষে র‌্যাব-৪-এর আভিযানিক দল সাব্বির ও তার তিন সহযোগীকে আটক করে। সাব্বির ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি হতে বিমান চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর ২০১০ সাল হতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রিজেন্ট এয়ারওয়েজে চাকরি করেন। এ সময় স্পেন থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২০১৪ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ বিমানের কো-পাইলট হিসেবে কর্মরত। বিমানের বোয়িং ৭৩৭ পরিচালনা করে থাকেন। সর্বশেষ গত সোমবার ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন। সাব্বির তুরস্ক থেকেও বিমান চালনার ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি দুবাই, কাতার, মাসকাট, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ছাড়াও অন্যান্য দেশেও বিমানের কো-পাইলট হিসেবে কাজ করেছেন। তার নিজ বাড়ির ভাড়াটিয়া হিসেবে আব্দুল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি মানিক ফরহাদ ওরফে সারোয়ার জাহানের নিকট থেকে বায়াত গ্রহণ করেন। র‌্যাব পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বলেন, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার আগে ও পরে আব্দুল্লাহ, গ্রেফতারকৃত পাইলট সাব্বির, সারোয়ার একত্রে নাশকতার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনায় ছিল- সাব্বির বিমান চালিয়ে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের বাসভবনে আঘাত করবে বা বিমানের যাত্রীদের জিম্মি করে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যাবে। সম্প্রতি বিমান থেকে বেতন-ভাতাদি বাবদ ১০ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল। ওই টাকা পেলে আব্দুল্লাহর মাধ্যমে সংগঠনে দান করার ওয়াদাও করেছিলেন তিনি। গত সেপ্টেম্বরে দারুস সালামে সাব্বিরের পৈত্রিক বাসায় জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালানোর পর র‌্যাব জানতে পারে তার সম্পর্কে। সেদিনই র‌্যাব সাব্বিরের কর্মস্থল বিমান অফিসে গিয়ে তার সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত করে। এ সময় তাকে বিমানের বিপজ্জনক পাইলট হিসেবে উল্লেখ করার পর তাকে দাযিত্ব থেকে বিরত রাখা হয়। পরে পাইলটদের সংগঠন বাপা ও ডিএফও ক্যাপ্টেন ফারাহাত জামিল তাকে আবারও ফ্লাইট চালানোর সুযোগ দেন। এ সম্পর্কে মঙ্গলবার বিকেলে এক সংবাদ সন্মেলনে বলা হয়, সাব্বিরের মা মোসাঃ সুলতানা পারভীন (৫৫) নিজেও একজন সক্রিয় জঙ্গী। তিনি আব্দুল্লাহর ভাড়াকৃত ফ্ল্যাটে নিয়মিত আড্ডা দিতেন। ওই বাসার ছাদে উঠে প্রায়ই জঙ্গী সংগঠনের বিষয়ে আব্দুল্লাহর সঙ্গে আলোচনা করতেন। তিনি আব্দুল্লাহর বাসায় মানিক ওরফে ফরহাদ ওরফে সারোয়ার জাহানের নিকট হতে বায়াত গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি আব্দুল্লাহকে সংগঠনের জন্য বিভিন্ন সময় আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন। গ্রেফতারকৃত মোঃ আসিফুর রহমান আসিফ (২৫) মোসাঃ সুলতানা পারভীনের ভাইয়ের ছেলে। বাসা এ/পি-২/৩ বি, বর্ধনবাড়ী, দারুস সালাম, ঢাকা। আব্দুল্লাহর সঙ্গে আসিফের ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে আব্দুল্লাহর বাসায় যাতায়াত করত এবং জঙ্গী সংগঠনের বিভিন্ন বিষয়ে তারা আলোচনা করত। সেও আব্দুল্লাহর বাসায় বসে সারোয়ার জাহানের নিকট বায়াত গ্রহণ করে। সে বিস্ফোরক তৈরির জন্য আব্দুল্লাহর বাসায় বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল সরবরাহ করত। এছাড়াও সে তার বন্ধুর কাছ থেকে একটি নাইন এমএম পিস্তল এনে আব্দুল্লাহর নিকট সরবরাহ করতে চেয়েছিল। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় আব্দুল্লাহ পিস্তলটি গ্রহণ করেনি। সুলতানা পারভীন ওই অস্ত্রটি ক্রয়ের জন্য আব্দুল্লাহকে টাকা দিতে সম্মত হয়েছিলেন। গ্রেফতারকৃত চা দোকানদার মোঃ আলমের বাসা এ/পি-২/১, ভাঙ্গা দেয়াল (ভাঙ্গা ওয়াল), দারুস সালাম, ঢাকা। সে বিভিন্ন সময় সংগঠনের কাজে আব্দুল্লাহকে গাড়ি সরবরাহ করত। গত রমজান মাসের আগে গ্রেফতারকৃত মোঃ আলমের মাধ্যমে ট্রাক সংগ্রহ করে। ওই ট্রাক চালিয়ে তাদের নিকটবর্তী পুলিশী স্থাপনায় নাশকতার পরিকল্পনা করে আব্দুল্লাহ। সম্প্রতি ইউরোপে জঙ্গীদের গাড়ী হামলা কৌশলে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রেফতারকৃত আলমের সরবরাহকৃত গাড়ি দিয়ে সংগঠনের অন্য সদস্যরা গাড়ি চালানোর অনুশীলন করে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানির ন্যায় এ দেশে তাদের উদ্দেশ্য ছিল গাড়ি চালানো শিখে বিভিন্ন স্থানে গাড়ি অথবা গাড়িবোমা হামলা করা। মুফতি মাহমুদ খান বলেন, গ্রেফতারকৃত সাব্বির এমাম সাব্বিরের মতো একজন দুর্ধর্ষ ব্যক্তির বাংলাদেশ বিমানের মতো সংবেদনশীল স্থানে চাকরি করাটাই ছিল বিস্ময়কর বিষয়। যে বিমানের ফ্লাইটে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের যাতায়াত নিয়মিত। এ ধরনের একজন উগ্রবাদী জঙ্গীকে আটক করে বড় ধরনের নাশকতা থেকে দেশকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে র‌্যাব।
×