ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমির হোসেন

করম আলীর বাড়ি ফেরা

প্রকাশিত: ০১:৩৩, ২৯ এপ্রিল ২০২২

করম আলীর বাড়ি ফেরা

করম আলী একজন ফেরিওয়ালা। কখনো তার মাথায় মাছের চাঙাড়ি, কখনো মুরগির খাঁচা। সকাল-সন্ধ্যায় রাজধানীর অলি-গলিতে হাঁক দিয়ে যায় করম আলী। একদা সে গ্রামে ছিল। খেটে খাওয়া দিনমজুর নয়। মাঝারি গৃহস্থ। গোলাভরা ধান আর গোয়ালভরা গরু তার ছিল না। তবে সামান্য জমিজামা যা ছিল তাতে তার বছরের খোরাক মতো ধান হত। পেঁয়াজ, রসুন ও অন্যান্য রবি শস্য মিলে চলে যেত পুরো বছর। আজ চাঙারি বা খাঁচা মাথায় করে জীবনের ঘানি টানা মানুষটি প্রায় নিরাশ্রয়। জনাকীর্ণ মানুষের ভারে ডুবু ডুবু ঢাকার কোন বস্তি কিংবা ফুটপাত তার ঠিকানা। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে করম আলীর। বিশেষ করে দুই ঈদের সময়। যাওয়ার উপায় নেই। ঈদ আসলে যে হাজার, হাজার বলছি কেন লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও গ্রামের দিকে ছুটে, আত্মীয় পরিজনকে দাওয়াত করে খাওয়ায় কিংবা নিজেরা তাদের বাড়ি দাওয়াত খেতে যায় করম আলী তাদের একজন নয়। যারা বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে যে যেভাবে পারে গ্রামে ছুটে সেখানে তাদের একটা আশ্রয় আছে। এই মানুষটির জন্য সে রকম কিছু নেই। যাদের জীবনে কোন ছুটি নেই, ঈদ নেই। ছুটি নিলেই পরিবারসুদ্ধ অনাহার। তাদের সামান্য হাতের পাঁচ পুঁজি থাকে। তারা সে পুঁজিকে আকড়ে ধরে থাকে। কেননা তারা জানে, যে কোন মুহূর্তে তা বেহাত হয়ে যেতে পারে। যাদের পুলিশে গুঁতোয়, মাস্তানরা চাঁদার জন্য শাসায়। করম আলী তাদের দলে। গ্রামে যদি একটা আশ্রয় থাকত তাহলে অন্তত ঈদ আসলে জীবন বিপন্ন করে হলেও বাড়ি ফিরত সে। যেমন লক্ষ লক্ষ মানুষ বাড়ি ফিরে। প্রিয়জনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ঈদের আনন্দ। কেননা গ্রামের সেই আশ্রয়ে জীবন আছে বলে মনে করে করম আলী। তাই স্মৃতির জাবর কেটে কেটে আনমনা হয় সে। কি হতে কি হয়ে গেল-সব এলোমেলো। হঠাৎ একদিন জ্বর হলো করম আলীর বৃদ্ধ বাবা রহম আলীর। টানা তিনদিন তিন রাত জ্ব¡রের পর পঙ্গু হয়ে গেলেন তিনি। অদিন- কুদিন বার মাস বিছানায় বাবা আর স্ত্রী পুত্রসহ সাত আটজনের সংসার সামান্য জমির ফসলে সামাল দিতে পারছিল না করম আলী। দেখতে না দেখতেই চারদিক থেকে ঋণের চাপে পড়ে গেল সে। একদিকে অসুস্থ বাবা-মার চিকিৎসার খরচ অন্যদিকে বাড়ন্ত লতার মতো পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল চক্রবৃদ্ধি সুদের অঙ্ক। কিছুতেই কুলে তরী বিড়াতে পারছিল না সে। দ্বিগি¦¦দিক জ্ঞানশূন্য হবার উপক্রম হল তার। বছর না ঘুরতেই সুদখোরদের সুদের দায় থেকে মুক্তি পেতে সামান্য জমিজমা এমনকি বাড়ির সামনের বিচরা জায়গাটুকুও বিক্রি করে দিতে হল তাকে। তারপরও নিয়তির নির্মম পরিহাস-বাঁচানো গেল না বাবা-মাকে। একবার ভাবে করম আলী, বাবা-মা মরে গিয়ে একপ্রকার বেঁচেই গেছেন। নয়লে এমন অভাব আর আশ্রয়হীনতায় তাদের কষ্ট কিভাবে সহ্য করত সে। এরপরও পাওনাদারদের সমস্ত পাওনা পরিশোধ করতে পারেনি করম আলী। স্বামীর সম্মান ও দায়মুক্তির কথা চিন্তা করে ভাইদের কাছ থেকে একপ্রকার জোর করেই ধর্মমতে তার পাওনা অংশটুকুও নিয়ে এসেছিল আয়েশা। তাতেও শেষ রক্ষা হল না এ পোড়া সংসারটির। করম আলীর ছোট্ট উঠোনটিতে সালিশ বসাল সুদখোর পাওনাদাররা। সালিশে মাতব্বরগণ রায় প্রদান করলেন- যেহেতু করম আলীর দুই আড়াই শতকের এই ভিটে বাড়িটুকু এবং এতে দুচালা টিনের ঘরখানা ছাড়া আর কিছুই নেই, তাই মিয়ারা তোমাদের পাওনা সমস্ত টাকা পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। তবে আগামী পনের দিনের মধ্যে আজকের সালিশ প্রধান গোলাম হোসেন মেম্বার সাহেব করম আলীর ভিটেটুকু আর চালা ঘরখানা বিক্রি করে আপনাদের পাওনা টাকার কিছু কিছু অংশ আনুপাতিক হারে পরিশোধ করে দেবেন। আর বাকি টাকা আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ করে দেয়ার জন্য সালিশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হল। সালিশের সিদ্ধান্তে আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়ল করম আলীর। কেউ যেন তেইশ মনের একটি পাথর দিয়ে চেপে ধরেছে তার বুকের ওপর। কোয়ান তুলে কাঁদতে থাকল আয়েশা। অ আল্লারে এ ভিটে ছাড়া অইলে আমি আমার মেয়ে ছেলেগুলারে নিয়া যামু কই-খাওয়ামু কী ? অবুঝ ছেলে মেয়ে কটির চোখেও জল টলমল। বার বার স্বামীকে বলল- ওগো তুমি পাওনাদারদের হাতে পায়ে ধর। তাদের বুঝাও। তোমার দু’দুটি মেয়ে সুমত্ত হয়তেছে। বছর ঘুরতেই সাদির ব্যবস্থা করতে অইবে। তাদের বুঝাইয়া কইলে তারা নিশ্চয় এতটা নির্দয় অইবো না। পাথুরে মুখ খুলল করম আলী। তুই বুঝবিনারে বউ, সুদখোরদের কাছে কাকুতি-মিনতি করা আর পাষাণ পাথরে মাথা কুটা একই কথা। সুদখোররা যে কতটা নির্মম হতে পারে তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ আন্দাজ করতে পারবে না। ভিটে এবং চালাঘর ঠিকই বিক্রি করেছিল করম আলী। তবে মাতব্বরগণের সিদ্ধান্ত মতো নয়। একজন পাওনাদারের কাছেই। পরেরদিন চুপি চুপি সুদখোর গোলাম কাদেরের সঙ্গে দেখা করে সে। চালাঘর সমেত ভিটের দাম এক লাখ টাকায় রফাদফা করে। এর পঞ্চাশ হাজার টাকা গোলাম কাদের সুদে-আসলে রেখে দেবেন। আর পঞ্চাশ হাজার টাকা করম আলীকে দেবেন। কথানুসারে কাজ। পরেরদিন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে শেষ সম্বলটুকু গোলাম কাদেরের নামে লিখে দিয়ে আসে করম আলী। এবং সেই রাতেই পঞ্চাশ হাজার টাকা পুঁজি করে ৩০ বছরের জন্মস্থানকে পেছনে ফেলে সপরিবারে ঢাকা শহরে পালিয়ে আসে সে। তারপর থেকে দীর্ঘ আধা যুগ অতিবাহিত হতে চলছে। আষাঢ়ের প্রথম ঢলে বিচ্ছিন্ন হওয়া একগুচ্ছ কচুরী পানার মতোই ভাসছে করম আলীর পরিবার রাজধানী ঢাকার জন¯্র্েরাতে। বড় মেয়ে মেহেরজান ও মেঝো মেয়ে রূপচানকে সে রামপুরা রোডের একটা গার্মেন্টে চাকরিতে পাঠিয়েছে। তৃতীয় নম্বর মেয়েটিকেও তাদের সঙ্গে পাঠাতে চায় আয়েশা। কিন্তু রাজি হয় না করম আলী। বলে গার্মেন্টের কাজের এত কষ্ট সহ্য করতে পারবে না আমার মা কুদুরচাঁন। আর একটু ডাঙ্গর হউক। গরিবের ঘরে যখন জন্মাইছে গার্মেন্টের কাজ অথবা কোন বড় লোকের বাসা বাড়িতেই তো কাজ করতে হইবে ওদের। করম আলীর চারটি ছেলেমেয়ের সবচেয়ে ছোটটি ছেলে। করম আলী তার একমাত্র ছেলে সন্তান মারুফ আলীকে বস্তির ব্র্যাক স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। মগবাজার বার নম্বর বস্তির একটিমাত্র খুপড়ি ঘরেই স্ত্রী-পুত্র ও মেয়েদের নিয়ে থাকে করম আলী। কতবার সে ভেবেছে যে এমন একটি খুপড়ি ঘর যদি পাওয়া যাইত যেটিতে মেয়েদের জন্য ছোট্ট একটি পার্টিশান দেয়া যায়। মেয়েরা এখন বড় হয়েছে। সুমত্ত মেয়েদের নিয়ে এক ঘরে আয়েশার পাশে শুতে খুবই লজ্জা করে করম আলীর। কিন্তু উপায় নেই। পার্টিশানওয়ালা খুপড়ি ঘর পাওয়া গেলেও ভাড়া গুণতে হবে দ্বিগুণ। তাছাড়া মাস্তান আর সেচ্চর পোলাপানগুলার কারণে মেয়েদের এক খুপড়িতে রেখেই অনিরাপত্তায় ভুগে সে। না জানি কখন হুক্কা হুয়া দিয়ে তার মেহেরজান আর রূপচাঁনের ইজ্জতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শেয়ালের দল। ঈদ আর মাত্র পাঁচ-ছয় দিন বাকি। গত এক সপ্তাহ ধরেই মনটা কেবল আনচান করছে করম আলীর। এবারও বাড়ি যেতে পারবে না সে ! গত ঈদের সময় মেহেরজান বলেছিল- আব্বা আপনে কোন চিন্তা কইরেন না। আমাদের গার্মেন্টের মালিক কইছে সামনের ঈদের এক সপ্তাহ আগে আমাদের বেতন বোনাস একসাথে দিয়া দিবে। তখন আপনেরে গ্রামের বাড়ি পাঠাব। পাওনাদারদের কিছু কিছু টাকা তুমি দিয়া দিবা। আর কইয়া আসবা যে আমার মেয়েরা এখন গার্মেন্টে চাকরি করে। তারা বেতন বোনাস পাইলে সামনের ঈদে সমস্ত টাকাই পরিশোধ কইরা দিমু। তাছাড়া আমরা টাকা জমাইয়া আমাদের দাদার কালের ভিটে মাটিও ছাড়াইয়া লইমু। মেয়েদের কথা শুনে নিজের অক্ষমতার কথা চিন্তা করে ভাবতে থাকে করম আলী। মেয়েরা রোজগার করে ফিরাইয়া আনবে তাদের পৈত্রিক ভিটা। কিন্তু কিভাবে! ওরা যে বড় হয়েছে। ওদের কি সাদি দিতে হইবে না। তাছাড়া ওরা কি ঠিকমতো বেতন বোনাস পাইবে! প্রতি বছরইতো বেতন বোনাসের দাবিতে রাস্তায় নামতে হয় হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিকদের। ন্যায্য পাওনা তো পায়ই না উপরন্তু পুলিশ আর মাস্তানদের কিল ঘুষি আর লাঠিপেটা খাইয়া জান যাইবার জোগার হয়। বস্তিঘরে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে করম আলী। রাত গভীর হয়। চিন্তাক্লিষ্ট চোখে ঘুম আসে না। আয়েশা হাত রাখে তার বুকের ওপর। বুকের কাঁচাপাকা চুলগুলোকে মুঠো করে আলতো টান দেয়। মায়াবী কণ্ঠে বলে-কি এমন ভাবছ মেহেরজানের বাপ! এবারও গ্রামের বাড়ি যাইতে পারবা না বইল্লা মন খারাপ করছ ? আয়েশার কোন কথার উত্তর দেয় না করম আলী। নিজের শূন্য বুকটার সঙ্গে আয়েশার পালক নরম বুক দুটিকে মিশিয়ে ঝাঁপটে ধরে ওকে। যৌনতার বশে নয় আশ্রয় খোঁজার জন্য। ফিসফিস করে বলে আয়েশা-তুমি কি লজ্জা শরমের মাথা খাইছ নাকি। একঘরে সুমত্ত মেয়েরা। ছাড়ো আমায়। নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় করম আলী। কতদিন হল আয়েশার ফুলবনে প্রবেশ করে না করম আলী। করতে গেলেই অভাবের কাঁটায় খোঁচা খেয়ে নিরস্ত হয়ে যায়। মাথায় এসে ভিড় করে আসন্ন ঈদে বাড়ি ফেরার চিন্তা। বাড়ি ফিরতে পারে না সে। মেহেরজান ও রূপচাঁন বেতন বোনাসের দাবিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে খুপড়িতে ফিরে আসে। মালিকপক্ষ নাকি তাদের চাকরি নট করে দিয়েছে। মেয়ে দুটির মাথায় হাত রাখে করম আলী। গত এক মাস ধরেই একটা ঘুষ ঘুষে জ্বরে ভুগছিল সে। কে জানে বস্তির এডিস মশা কামড়িছে কি না! ডেঙ্গু জ্বর হলে তো আর উপায়ই নাই। কেমন যেন ঝাঁপসা হয়ে আসে তার চোখ দুটি। বলে-মারে আমি তোদের একটা কথা কই মন দিয়া হুইন্না রাখ। সত্যিই বাড়ি ফেরার জন্য আমার মন সব সময়ই আনচান করে। সেখানে যে আমার প্রাণ-সুখের স্মৃতিময় শৈশব, দূরন্ত কৈশোর, তিতাস নদীর ¯্র্েরাতধারার মতো জীবন। এই নিরস ঢাকা শহরে জীবন নাইরে মা। আমি যদি গ্রামে যাইতে পারতাম ! আর আমার বাপ দাদার ভিটাটারে ফেরত লইতে পারতাম ! তই আমি তোদের নিয়া এই বস্তি নামের নরকে পইড়া থাকমান না। আর তরারেও গার্মেন্টের চাকরিতে পাঠাইতাম না। যে কাজে সম্মান নাই, মেয়েদের ইজ্জতের নিরাপত্তা নাই, হেই কাজে আমার মেয়েরারে আমি দিতাম না। গ্রামে গিয়া ভালা ছেলে দেইখা আমি তররা সাদি দিতাম। কিন্তু গ্রামে যাইবার আমার উপায় নাই। পাওনাদারদের ভয়ে সেখানে আমি যাইতে পারি না। এ কথাতো তরা ভাল করেই বুঝস। নিজের মেয়েদের কাছে অক্ষমতার কথা বলতে বলতে তার দুটি চোখের কোণে জমে আসে দু’ফোটা জল। কিছুটা থেমে আবার বলতে থাকে-তই আমি একটা কথা কইয়া রাখি। আমি যদি মইরা যাই-আমরে কিন্তু তরা এই ঢাকা শহরে দাফন করিস না। কিভাবে করবি ? আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করতে ওতো টাকা লাগে। যে টাকা দিয়া তরা আজমপুর জাগা কিনবি সেই টাকা দিয়া আমারে আমার গ্রামে নিয়া যাবি। নিশ্চয় আমার লাশের কাছে পাওনাদাররা আর টাকা চায়তে পারবে না। বলে ঝাঁপসা চোখ দুটি বন্ধ করতেই যেন করম আলী দেখতে পায় দূরে গোধূলির ম্লান আলোর ভেতর মিলিয়ে যাচ্ছে বেলা শেষে বাড়ি ফেরা একটি পথহারা পাখি। একটু পরে বস্তি ঘরের ভেতর থেকে শোনা গেল কান্নার কোরাস। আয়েশা ও তার মেয়েরা কোয়ান তুলে কাঁদছে।
×