আননোন নাম্বারটি ইচ্ছে করেই রিসিভ করিনি। প্রথম কলটি শেষ হবার পর দ্বিতীয়বার আবার কল এলো। এবারও রিসিভ করিনি। এভাবে তৃতীয়বার, চতুর্থবার, বার বার...। এই ধরনের মানুষেন প্রতি আমার বেশ রাগ। দেখছে নাম্বারটি রিসিভ হচ্ছে না, তবু আবার কল দেয়ার কি মানে হয়! মেজাজ খারাপ হয় আমার।
অজ্ঞাত নাম্বারটি থেকে আবার কল এলো। এবার রিসিভ করব বলে স্থির হলাম। আচ্ছা কে হতে পারে ওপারের মানুষটি! আমার কোন বন্ধু? না আত্মীয়, না অন্য কেউ? ধ্যাৎ, কি সব ভাবছি! রিসিভ করলেই তো ব্যাপারটা পানির মতো পরিষ্কার।
রিসিভ করে দৃঢ় গলায় বললাম-‘হ্যালো..।’ ওপার থেকে মিষ্টি রিনরিনে নারী কণ্ঠ-‘কে রকি?’ অচেনা কণ্ঠের প্রশ্নের জবাব দিলাম-‘হ্যাঁ, আমি রকি বলছি। পুরো নাম ফরিদ হাসান রকি। আপনি কে?’ ওপারের নারী কণ্ঠের মিষ্টি জবাব-‘ইয়ে মানে আমি..। আমাকে তুমি চিনবে না। আমি তোমাকে চিনি। কেমন আছো তুমি? ভালো তো?’ হাল্কাভাবে মেজাজ খারাপ হতে চলছে। আমি চিনবো না মানে? পরিচয় দিলেই তো হয়! এত ভণিতা আমার অপছন্দ। পরিচয় দিলেই জানা যাবে আমি তাকে চিনি কি চিনি না।
একটু ভাব ধরে বললাম-‘পরিচয় দিন। চেনা না চেনা আমার ব্যাপার।’ আমার কথা শেষ না হতেই ওপার থেকে প্রশ্ন আসে-‘তুমি কি আমার কলে বিরক্ত হচ্ছো? অনেকটা অভিযোগের সুরে বললাম-‘আপনার এত কিছু জানার দরকার নেই। পরিচয় দিলে দিন। না দিলে লাইন কেটে দিচ্ছি।’ ওপার থেকে হাসিকন্ঠের জবাব আসে-‘পরিচয় জানার দরকার নেই রকি। তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হলো, তাই কল দেয়া। জানো অনেক কষ্ট করে তোমার নাম্বার সংগ্রহ করেছি।’ অনেকটা মুড নিয়ে বললাম- ‘আমার এত কিছু জানার দরকার নেই। ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। আমি ক্লাসে যাবো।’
লাইন কেটে দিলাম। আসলে আমার ক্লাসে যাবার টাইম হয়নি। একটা অজুহাত দেখিয়ে লাইন কেটে দেয়ার নাটক আর কি! আচ্ছা এই নারীকণ্ঠি করে হতে পারে। পাশের বাসার সুমি ভাবি? না সুমি ভাবির কণ্ঠ এতটা সুন্দর না। অনেকটা পাতিহাসের মতো। পাতিহাস শব্দ করলে যেমন শোনায়, তেমন। কে হতে পারে এই কলওয়ালী! আমার ক্লাসের কেউ? বিনু, মায়া, মুন্নি বা কেয়া? না, ওদের ভয়েজ তো এমন না। সবার নাম্বার তো আমার কাছে আছে। কিন্তু কলের ওই মহিলা বলল আমার নাম্বার নাকি অনেক কষ্টে সংগ্রহ করেছেন! আজকাল কেই অনেক কষ্টে নাম্বার সংগ্রহ করে? এখন ইন্টারনেটের যুগ। ফেসবুক, ইমো, ভাইবারে সবাই এখন নির্ভরশীল। ফোন কলের দিন শেষ।
বেলা গড়িয়ে যায়। ফোনের ওই নারী কণ্ঠ এখানো আমার কানে বাজছে। মাথা থেকে ব্যাপারটি ঝেড়ে ফেলতে চেয়েও ব্যর্থ হচ্ছি। কেন জানি বার বার জানতে ইচ্ছে করছে ওই মহিলার কথা। কে হতে পারে?
সন্ধ্যায় রিসিভ অপশন থেকে আননোন সেই নাম্বারে কল দিলাম। কল ধরেই সেই মিষ্টি কণ্ঠের আহ্লাদী স্বর-
-রকি তুমি আমাকে কল করেছো? বেশ ভালো লাগছে।
-আচ্ছা আপনি কে? সুমি ভাবি?
-সুমি ভাবি কে?
-পাল্টা প্রশ্ন করবেন না। আপনি সুমি ভাবি কিনা সেটা বলুন।
-না। আমি সুমি ভাবি না। তুমি কিসে পড়ো রকি, স্কুলে না কলেজে?
-আজব তো! কিসব প্রশ্ন করছেন? আপনি কে?
-পরিচয় জানাটা কি খুব জরুরী? তুমি এত অস্থির হচ্ছো কেন? তুমি তো এমন না। বেশ শান্ত স¦ভাবের ছিলে।
-আপনি এত কিছুর খবর জানেন? দেখুন আমার বেশ অসহ্য লাগছে।
-হা হা হা। তোমার মত শান্ত ছেলের অসহ্য হওয়া মানায় না। তোমার বাবা কেমন আছে রকি?
-বাবা ভালো নেই। অসুখ আরও বেড়েছে। পাবনায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বাবাকে। সেখানে হেমায়েতপুরের পাগলাগারদে আছে।
-ও আচ্ছ। বাবার জন্যে তোমার খুব কষ্ট হয়?
-বাদ দিন তো! আমার মোবইলে ব্যালেন্স কম। পরিচয় দিলে দেন, না দিলে রেখে দিই।
আমার কথা শেষ না হতেই ওপার থেকে লাইন কেটে দেয়া হলো। এতে আমি কিছুটা নার্ভাস হলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নাম্বার থেকে কল এলো।
-শোনো রকি, ব্যালেন্সের চিন্তা করবা না। দরকার হলে আমাকে মিসকল দিবে, আমি কলব্যাক করব।
-তার আর দরকার হবে না। আমি আজ থেকে আপনার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখব না। যদি পরিচয় না দেন।
-পরিচয় না হয় আরো কিছুদিন পর জানবে। তুমি আমার পরিচয়ের জন্যে এত উঠে পড়ে লেগেছো কেন রকি? আমাকে ভয় পেও না।
-ভয় পাব কেন? আপনি তো বাঘ ভাল্লুক না।
-হা হা হা। বেশ মজা করে কথা বলো তো। কে শেখায় এভাবে?
-আমার দাদী মা।
-উনি কেমন আছেন? আগের মত পান খাওয়ার অভ্যাস আছে?
-সেকি! আপনি এটাও জানেন? আচ্ছা আপনি কে? আমাদের রিলেটিভ কেউ?
-মনে করো আমি তোমার মা!
-মা? আমার মা নেই। আমি তাকে ঘৃনা করি।
-ইয়ে মানে..! ঘৃনা করো কেন?
ঘৃনা করি কেন মাকে, এ প্রশ্নের জবাব না দিয়েই লাইন কেটে দিলাম। মা নামটা আমার ভালো লাগে না। আমি এলোমেলো হয়ে যাই। ব্যথায় বুক চিনচিন করে। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, বয়স দুই কি তিন বছর, তখনই বাবার সঙ্গে মায়ের তালাক হয়ে গেছে। মা স্বইচ্ছায় বাবাকে তালাক দিয়েছেন। আমার কথা একবারও ভাবেননি।
চব্বিশ বছর আগে আমার বাবা আবদুল জলিল খুব ভালো পরিবারে, কেশারখিল গ্রামের শাহনাজ বেগমকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। আমিই সেই ছেলে। সুখের সংসার কাটতে থাকে দুজনের।
হঠাৎ একসময় বাবা বদলে যেতে থাকেন। রাত দিন আবোল তাবোল বকতে থাকেন। অকারণে যাকে তাকে মারতে থাকেন। অচেনা কাউকে দেখলে খুব বিশ্রী ভাষায় গালি দেন।
বড় বড় ডাক্তার দেখানো হল বাবাকে। কেউ আসল রোগ ধরতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত মাদ্রাজে নিয়ে যাওয়া হল বাবাকে। সেখানে বাবার রোগ ধরা পড়ে। রোগের নাম সিজোফ্রেনিয়া। যাকে বলে মানসিক রোগ।
বিয়ের পর বাবার প্রতি মায়ের যে বিন্দু বিন্দু অকৃত্রিম ভালোবাসা জমে ছিল, সেটা শেষ হয়ে যেতে থাকে বাবার অসুখের কারণে। ক্রমেই স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে।
এক সময়ে মা দাদীমাকে জানিয়ে দেয় তার পাগল ছেলের সঙ্গে সংসার করা আর তার পক্ষে সম্ভব না। দাদীমা বেশ বোঝালেন মাকে। এমনকি সমস্ত সম্পত্তি মায়ের নামে লিখে দেয়ারও প্ল্যান করেন। কিন্তু মা তার সিদ্ধান্তে অনঢ় রইলেন।
এক সময় স্বামী সংসার আর সন্তান ফেলে মা চলে গেলেন তার বাবার অগাধ সম্পত্তির কাছে। আমার মায়ের অপার রূপের কথা না হয় বাদ দিলাম, নানাজানের বিপুল সম্পত্তির লোভে বহু বিয়ের প্রস্তাব আসে মায়ের জন্য। রূপসি মেয়ে এবং রূপসি মেয়ের সম্পদের দাপটে শাহনাজ বেগমের মত স্বামী পরিত্যাক্তা এক নারীর দ্বিতীয় বিয়ে হতে আর বেশি সময় লাগেনি।
মায়ের পরের বিয়েটা হয়েছে কোন এক নামকরা কলেজের প্রফেসরের সঙ্গে। কিন্তু সে সম্পর্কও তিন বছরের মাথায় ভেঙ্গে গেল। প্রফেসরের ব্লাড ক্যান্সারের কারণে বিধবা হলেন আমার মা।
এক সময় মা মেনে নিলেন বিয়ে তার জন্য অভিশাপ। তাইতো নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নিয়ে নানাজানের অগাধ সম্পত্তির দেখা শোনার দায়িত্ব নিলেন মা। সংসার করার চিন্তা আর করতে পারলেন না। গ্রামে স্কুল মাদ্রাসাসহ বেশ ক’টি এতিমখানা গড়লেন মা। সেগুলি পরিচালনায় দিন কাটতে লাগল তার।
জ্ঞান হবার পর থেকে আমি এসব জানি। দাদীমায়ের মুখে সব শুনেছি। দাদীমা আমার মা বাবার এই বিচ্ছেদি গল্প অনেকবার বলেছেন আমাকে। একটা সময়ে এসে এই গল্পটি শুনতে আমার বেশ অসহ্য লাগত। আমি মনে মনে অনেকটা বিরক্তও হোতাম। দাদীমাকে বুঝতে দিতাম না। কিন্তু ঘুরে ফিরে দাদীমা আমাকে কেন জানি আমার মায়ের গল্প বলতে চাইতেন। এই সংসারের বউ হয়ে এসে কিভাবে মা একাই দক্ষ হাতে সংসারের হাল ধরেছেন। কিভাবে চুলে খোঁপা বাঁধতেন, বাসায় মেহমান এলে কিভাবে তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখতেন, গলায় অপূর্ব সুর ছিল বলে শ্বাশুড়িকে নাকি প্রায়ই গান শোনাতেন!
দাদীমায়ের মুখে এসব শুনতে শুনতে আমার শৈশব চলে গেছে। যখন দাদীমা তার বউমা’র গল্প করতেন, আমার চোখের সামনে যেন এক জীবন্ত কল্পছবি ভেসে উঠত। আমি যেন দেখতে পেতাম বিশ বছর আগের এই সংসারের চিত্র। যেন দেখতে পেতাম আমাদের বাড়ির বারান্দায় শাহনাজ বেগম নামের এক মা তার রকি নামের সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন।
আমি কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসি। কিন্তু সে বাস্তব সম্পূর্ণ আলাদা। আমার পাগল বাবার ঘর ভেঙ্গে চলে গেছেন মা। স্বামীর কথা তো ভাবেনইনি, ভাবেননি সেই ছোট্ট আমার কথা। বলা যায় এই একটি কারণে অদেখা সেই মাকে আমার কখনো পছন্দ না। এ কারণে দিন দিন তার প্রতি ঘৃণা জন্মে। যে মহিলা আমার কথা একবারও ভাবেননি, এমনকি এই বিশ বছরে আমার একবারও খবর নেননি, আমি কি করে তাকে ভালোবাসবো! বরং আমার ছোট্ট বুকে সেই মহিলার প্রতি ঘৃণা থেকে ঘৃণা বাড়ে। অথচ আমার দাদীমা আমার সঙ্গে বিপরীত। পাগল ছেলের কথা না ভেবে যে বউমা এই সংসারকে ফেলে চলে গেছে, তাতে দাদীমা আজো কোন স্বার্থে মনে রেখেছেন আমি বুঝি না।
এত সুন্দর করে দাদীমা শাড়ি পরেন, তবুও বলেন ‘তোর মা’র মত আর সুন্দর করে পরতে পারলাম কই?’ শীতের সকালে প্রায়ই পুলি পিঠা বানিয়ে এনে দাদীমা বলেন, ‘তোর মা’র মতো মনে হয় কোনদিনও বানাতে পারব না!’ কিন্তু আমার ধারণা আমার দাদীমায়ের মতো দুনিয়ার আর কেই এত অমৃত স্বাদ করে শীতের পুলি পিঠা বানাতে পারবে না।
দাদীমা সুশিক্ষিতা। সেই আমলে বিএ পাস করেছেন। আল্লাহ এক অপূর্ব চেহারা দিয়েছেন দাদীমাকে। এখনো চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরলে দাদীমাকে পুরনো সিনেমার নায়িকাদের মতো লাগে। এই বয়সেও দাদীমা কোন প্রোগ্রাম হলে ঠোঁটে লিপস্টিক পরেন।
কিন্তু এত এত শাড়ি থাকার পরও দাদীমা বাসার যে কোন প্রোগ্রাম হলে ওই একটিই শাড়ি পরেন। কারণ সেই শাড়িটা তাকে তার বউমা গিফট করেছেন। চুলে খোঁপা বাঁধলে বলেন, ‘তোর মা’র মতো হয়নি।’ আমি বেশ বুঝতে পারি পুত্রবধূর প্রতি দাদীমায়ের এখনো যে টান, সেটা অকৃত্রিম। সেই অকৃত্রিম টানের নাম হাহাকার। তাই তিনি পুত্রবধূর সঙ্গে কাটানো অনেক বছর আগের দিনগুলির স্মৃতি আজো ভুলতে পারেননি।
বাবার রোগ অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে যাবার কারণে তাকে পাবনায় পাঠানোর পর মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন দাদীমা। প্রথম ক’দিন তো শিশুর মতো কাঁদতেন। পরে আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে এলো। পাবনা থেকে বাবার শারীরিক অবস্থার উন্নতি-অবনতির খবর আসতে থাকে। দাদীমা মাস শেষে বাবার খরচের জন্যে ডাক্তারদেরকে টাকা পাঠান।
২.
খুব ভোরে আমার মোবাইলে সেই নাম্বার থেকে কল এলো। স্বাভাবিকভাবে রিসিভ করলাম ঘুম ঘুম চোখে।
-হ্যালো, আপনি আবার কল করেছেন কেন?
-কল তো আমি করবই। রকি, তোমার দাদী কোথায়? একটু দিবে? কথা বলবো।
-না দিব না।
-দাও না!
-না।
ওপারের মহিলার প্যাঁন প্যাঁনানিতে শেষ পর্যন্ত আমি দাদীমাকে ফোনটা দিলামই। বিছানা ছেড়ে উঠে দাদীমায়ের ঘরে গিয়ে দেখি তিনি নামাযের বিছানায় তসবীহ হাতে বসে আছেন। তার হাতে ফোন দিয়ে পুনরায় বিছানায় চলে এলাম।
কিছুক্ষণ পর দাদীমায়ের ঘর থেকে বাড়ি কাঁপানো কান্না শুরু হল। হন্তদন্ত হয়ে দাদীমায়ের ঘরে ছুটলাম। দাদীমা কানে মোবাইল ধরে চেঁচিয়ে বলছেন-‘বউমা তুমি? এতটা বছর পর? কেমন আছো? আমাদের কি একবারও খোঁজ নিতে মন চায়নি? তোমার ছেলে রকি বেশ বড় হয়েছে। কলেজে পড়ে। জলীল পাবনায় থাকে। ওর শরীর ভালো না। তোমার শরীর ভালো তো বউমা? কাঁদছো কেন? কেঁদো না। রকি ভালো আছে। দেখতে একটা রাজপুত্র।’
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি দাদীমায়ের কথা শুনছি। তাহলে মোবাইলের ওই নারী আমার মা! যাকে আমি সারাটা জীবন ঘৃণাই করেছি।
পাবনা থেকে খারাপ খবর এলো। বাবা গত রাতে মারা গেছেন। আমাদের বাড়িতে আত্মীয়দের আসা যাওয়া বাড়ছে। সবাই দাদীমাকে সান্ত¦না দিচ্ছে। দাদীমায়ের কান্নায় সারা বাড়ি কেঁপে উঠছে।
আছরের আযানের পরপরই এ্যাম্বুলেন্স এলো বাবার লাশ নিয়ে। মৃত বাবার কঙ্কালসার দেহ দেখে আমার যতটা ভয় পাবার কথা, ততটা ভয় আমি পাচ্ছি না। অথচ লাশ দেখে আমার চিরকাল ভয়।
মাগরিবের পরপরই বাবার দাফন হলো। দাফনের পর গোরস্থান থেকে সবাই বাসায় ফিরলাম। সারাঘর গিজ গিজ করছে স্বজনেরা। সবাই দাদীমাকে সান্ত¦না দিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে। খুব অল্প সময়ে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। একেবারে লাশ ঘুম।
ঘুম ভাঙলো মোবাইলের রিংটোনে। ভোর রাত তখন। মা’র ফোন এসেছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে রিসিভ করতেই ওপার থেকে চিকন সুরের কান্না-‘রকি, বাবার জন্যে খারাপ লাগছে? বাবার জন্যে একদম কান্নাকাটি করবে না। তাহলে বাবার আত্মা কষ্ট পাবে। ফজরের আযান হচ্ছে। উঠে যাও, নামাজ পড়ে বাবার কবর জিয়ারত করবে। কি হল রকি? কথা বলছো না যে?’ তাকে আর কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম-‘এত দরদী হবেন না তো! জীবন্ত যে মানুষটার একবারও খোঁজ রাখেননি, মৃত্যুর পর তার জন্য এত দরদ দেখিয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছেন?’ আমার কথায় ওপার থেকে উচ্চস্বরে কান্না বাড়তে লাগল। লাইন কেটে দিলাম। আমার এসব ভণিতা ভালো লাগে না। আচ্ছা বাবার মৃত্যুর খবর মা কিভাবে জানলেন? দাদীমায়ের সাথে কি মায়ের যোগাযোগ হয়? কিন্তু দাদীমায়ের তো মোবাইল নেই। তবে কি মা অন্য কোন মাধ্যমে আমাদের সব খবর রাখেন?
দিন যেতে থাকে। বাবার শোক আমাকে আর দাদীমাকে কিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। আমি রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর বাবার কবর জিয়ারত করি।
প্রায়ই মায়ের কল আসে। ইচ্ছে করে রিসিভ করি না। তবু কল আসে। আমি বিরক্ত হয়ে লাইন কেটে মোবাইল বন্ধ করে দিই।
বাবার মৃত্যুর দেড়মাস পরের ঘটনা। শেষ বিকেল সেদিন। আমি গঞ্জের হাটে সাপুড়েদের সাপের খেলা দেখছি। সে সময়ে আমার ফোনে আমার বন্ধু জনির কল আসে।
-আমি তোদের বাসায়। একটু জলদি বাসায় আয় তো।
-মিথ্যে বলবি না জনি।
-মিথ্যে মনে হল কেন?
-আমার দাদীমাকে খুব ভয় পাস বলে তুই কখনো আমাদের বাসায় আসিস না। তোকে কখনো আমাদের বাসায় আনতে পেরেছি?
-বিশ্বাস না করলে তোর দাদীমায়ের সঙ্গে কথা বলে দেখ।
জনি সত্যি সত্যি আমাদের বাড়িতে এসেছে। ফোনে দাদীমায়ের উচ্ছ্বাস গলা-‘রকি, এক্ষুণি বাসায় চলে আয় ভাই। দেখে যা কে এসেছে!’ আমাকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দাদীমা লাইন কেটে দিলেন। জনি আচমকা আমাদের বাসায় আসার রহস্য কি?
ড্রয়িং রুমের সোফায় তিনজন বসে আছে। জনি, দাদীমা আর একজন অচেনা ভদ্রমহিলা। তাকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কে এই অচেনা মানুষ? মানুষটার সামনে দাদীমা দুনিয়ার নাস্তা পানি এনে হাজির করেছেন।
দাদীমা অতি স্বাভাবিক গলায় বললেন- ‘তোর মা এসেছে। শাহনাজ, দেখো তোমার ছেলে!’ দাদীমায়ের কথা শেষ হবার আগেই ভদ্রমহিলা ঝড়ের বেগে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে গুমরে কাঁদতে লাগলেন। ঘটনার আকস্মকিতায় আমি বাকরুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমার মা এসেছেন?
জনি আমাকে একরকম টেনেহেঁচড়ে বারান্দায় নিয়ে এসে মিনমিন করে বলল-‘তোর মায়ের সঙ্গে ফেসবুকে আমার দেড় বছরের সম্পর্ক। তোকে কখনো বলিনি। আমার কাছ থেকে তোর সব খবর রাখতেন উনি। তোর ফোন নাম্বারও আমার কাছ থেকে নিয়েছেন। এই যে আজ তিনি এখানে, এটাও আমার সহায়তায়। বাদ দে, মাকে দেখে কেমন লাগছে তোর?’
মাকে দেখে কেমন লাগছে-এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে আমি টের পেলাম আমার চোখে পানি চলে আসছে। এই মুহূর্তে আমার সামনে যা ঘটছে, এটা কি বাস্তব?