ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জোবায়ের মিলন

কাব্যসাহিত্যে বৈশাখ দৃশ্যত কালের স্বনন

প্রকাশিত: ০২:০৪, ১৪ এপ্রিল ২০২২

কাব্যসাহিত্যে বৈশাখ দৃশ্যত কালের স্বনন

ঋতুতে এখন গ্রীষ্ম। গ্রীষ্মের মাস বৈশাখ। ধানের সূত্র ধরে বৈশাখ এক দিকে বাংলার নবসূচনা। আরেক দিকে ঝড়ে, বাদলে, খরায়, পোড়ায়, তাপে, উত্তাপে ওষ্ঠাগত জীবন নাকালের নাম। ব্যবহারে, বৈশিষ্ট্যে, আয়োজনে, উৎসবে, উদযাপনে এ এক অনারম্বর অথচ অত্যুচ্চ মাস- বাংলার আনাচে-কানাচে। গ্রাম থেকে নগর, নগর থেকে শহর; আমের মুকুলের দোলা থেকে শৌখিন বাঙালীর আচারে উল্লেখযোগ্য বৈশাখ। বাংলা সাহিত্যেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত। বাংলা সাহিত্যের এমন একটি শাখা বের করা যাবে না যে-শাখাকে বৈশাখ প্রভাবিত করেনি। ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী; ছড়া, কৌতুক, রম্য, রসনা রচনায়ও বৈশাখের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ে। বৈশাখী হাওয়া, নতুন বর্ষে প্রত্যাশা, ফিরে বেঁচে ওঠার আশা বাংলা কবিতায় যেভাবে উঠে এসেছে বা বাংলার কবিরা একে যেভাবে উপজীব্য বা অনুষঙ্গ করেছেন তা আর কোন বাংলা মাসের বৈচিত্র্য নিয়ে হয়েছে কিনা নির্দিষ্ট করে বলা দুরূহ। হয়ত হয়েছে। এতটা না। মধ্যযুগের খ্যাতনামা কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর থেকে শুরু করলে বাংলা কবিতার রবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল অব্দি বৈশাখকে প্রতীকে উপমায় উত্তুঙ্গ করে প্রচুর কবিতা রচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। তারপর জীবনানন্দ কালের অর্থাৎ ত্রিশের দশকেও প্রায় প্রত্যেক কবির কবিতায় বৈশাখের নতুন ধ্বনি, আহ্বান, কালবৈশাখী ঝড়, কালো মেঘ, বছর বরণ, আয়োজনসহ ঋতু বৈচিত্র্য উদ্দীপ্ত স্বরে উল্লেখিত হয়েছে। পঞ্চশ ও ষাটের দশকে এসে কালের হাওয়ায় বৈশ্বিক আবছায়া লাগতে থাকে। কবিতার ধরনে বাঁক বদল হয় বিভিন্নভাবে। শব্দে, বাক্যে, ভাষায়, বর্ণনায়, উপমায়, উৎপ্রেক্ষায় ভিন্নতা মোটা দাগে চোখ টানে। এতো দিনে প্রকৃতির আচরণেও তার প্রভাবের প্রাবাল্য দেখা দেয়। পনেরো’শ শতকে এই বাংলা ছিল সামাজিক যাপনপ্রধান, ছিল কৃষিপ্রধান। সামাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সর্বাংশে কৃষিকে রেখেই আবর্তিত হতো নীতি নির্ধারণ। কৃষিই জীবনে যাপনে ছিল বলে বৈশাখের ঝড় ছিল এক আতঙ্ক; খরা ছিল মূর্তিমান ভয়। পনেরো শতকে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিতায় স্পষ্টত সেই কথাই: ‘বৈশাখে অনলসম বসন্তের খরা/তরুতল নাহি মোর করিকে পসরা/ পায় পোড়ে তরতর রবির কিরণ।/শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞ্চার বসন/নিযুক্ত করিল বিধি সবার কাপড়।/অভাগী ফুল্লরা পরে হরিণের দুড়/পদ পেড়ে খরতর রবির কিরণ।/ শিরে দিতে নাহি আঁটে অঙ্গের বসন/বৈশাখ হৈল আগো মোর বড় বিষ।/মাংস নাহি খায় সর্বলোকে নিরামিষ।’ চ-ীমঙ্গল কাব্যে কবি দাম্পত্য জীবনের সুখ-দুঃখের চমৎকার বর্ণনার সাথে দাবদাহের বৈশাখ মাসকেও স্মরণে রাখছে ভাষার মিহিন বক্তব্যে। রবীন্দ্রনাথে এসে তার পরিবর্তন দেখতে পাই। দেখতে পাই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বৈশ্বয়িক গ্লানিতে জর্জরিত, ফিকে এই ধরা। জীর্ণ আর শীর্ণতা অনেক কিছুকে ছাপিয়ে বিশ্বকবির কবিতায় বৈশাখের আশ্রয়ে মুখ খুলছে পৃথিবীর মুক্ত মঞ্চে। তিনি ২০ ফাল্গুন, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ, ৪ মার্চ, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ, শান্তিনিকেতনে বসে গীতস্বরে লিখছেন, ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/ তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/ যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নি¯œানে শুচি হোক ধরা/ রসের আবেশরাশি শুস্ক করি দাও আসি,/ আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ/ মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।’ উন্মুক্ত আহ্বানদর্শে প্রত্যক্ষ করলে দেখা যায় সময়। কালকে গভীরে ডুব দিয়ে অনুধাবন করা যায় এমন এক সময়কে- যখন পৃথিবী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ধ্বংসের দিকে ধাবিত সময় ভরে উঠছে কালো মেঘে, সভ্যতার নামে বেড়ে উঠছে মুমূর্ষুতা। কবি বিচলিত হয়ে নববর্ষে, প্রার্থনায় বৈশাখকে সূচী করে দুনিয়াকে সজাগ করছেন এমন কাব্যভাষায়। আবার বিদ্রোহী কবি যখন লিখছেন তখন বিশ্বযুদ্ধ চলমান। দেখছেন যুদ্ধের দামামা। দেখেছেন ক্ষয়, ক্ষতি। প্রাচীন আর প্রবীণের পদতলে পৃথিবী ওষ্ঠাগত। পৃথিবী ভারাক্রান্ত। নতুনের যেন প্রয়োজন হয়ে উঠেছে সমুচ্চ। পৃথিবীর জন্য যেন খুব দরকার হয়ে উঠেছে নতুনের উপস্থাপন। তখন কবির রচনায় বৈশাখ হয়ে ওঠেছে অস্ত্র। হয়ে ওঠেছে শাণিত উপমা। প্রতীকী ব্যঞ্জনায় কবি প্রভুত স্বপ্নে ডাক দিচ্ছেন নতুনকে: ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর।/আসছে এবার অনাগত প্রলয় নেশার নৃত্য পাগল/ সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক ভেনে ভাঙলো আগল/মৃত্যুগহন অন্ধকুপে মহাকালের চ-রূপে ধূ¤্রধূপে/বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর/ ওরে ওই হাসছে ভয়ংকর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর।/মাভৈ: মাভৈ: জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে/জরায় মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ লুকানো ঐ বিনাশে/এবার মহানিশার শেষে আসবে ঊষা/অরুণ হেসে তরুণ বেশে/ দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশুদাদের কর/আলো তার ভরবে এবার ঘর/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’ (তোরা সব জয়ধ্বনি কর)। কবি যেন বুঝতে পারছিলেন বিনাশের ষড়যন্ত্র শেষ হয়ে অচিরেই ঊষা আসবে। আলোয় তার ভরবে এবার ঘর। কবি জীবনানন্দ দাশ নিভৃতের কবি। চুপিসারে জীবনভর রূপসী বাংলার রূপের কথা এঁকেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে। তাকেও সময় পীড়া দিয়েছে। তার কবিতায়ও সময় এসেছে, নিপীড়নের ছাপ এসেছে। অন্যরা যেখানে চিৎকার করে উঠেছেন। জীবনানন্দ যেখানে কোঁকিয়ে কেঁদেছেন। প্রায় বুঝতে দেননি সেই স্বর, জানতে দেখনি তার কারণ। তার কবিতায় যখন বৈশাখ আসে সেখানেও উচ্চ হয়ে বাজে কালের নিদারুণ কালোর কথা। ব্যথা। আমরা বুঝতে পারি সমাজ, সংসার, গৃহ কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে, প্রকৃতি কীভাবে বদলাচ্ছে তার রূপ। তার ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটির কয়েক চরণ পাঠ নিলে জানালার মতো খুলে যায় জট। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, রবীন্দনাথ ও জীবনানন্দ ভাষার মর্মে তাকালে ধরা পড়া পার্থক্য। দেখা যায় কালে কালে বৈশাখে কীভাবে পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে পৃথিবীর। জীবনানন্দ মৃদুভাষায় বলছেন: ‘মিনারের মত মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে/বেতের লতার নিচে চড়ইয়ের ডিম যেন শক্ত হয়ে আছে/নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বার বার তীরটিরে মাখে/খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জ্যোৎ¯œার উঠানে পড়িয়াছে/ বাতাসে ঝিঁঝিঁর গন্ধ-বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;/নীলাভ নোনার বুকে ঘনরস গাঢ় আকাক্সক্ষায় নেমে আসে।’ (মৃত্যুর আগে)। মেঘে আর চিলে যখন সখ্য হয়, এ্যাকে যখন অন্যকে ডাকে তখন কি আর কাল পড়তে অসুবিধা হয়? মোটেও না। মধ্যখানে অনেকটা সময় পারি দিয়ে তারও পরে যদি আমরা উপস্থিত হই, দেখি এ এ আরেক সময়। উঁচুতে নিচুতে দাঙ্গা। মানে অপমানে হানাহানি। বোয়ালের প্রবল সময়। পুঁটিদের জান যায় যায়! গৃহ আর সংসার ভেঙ্গে বিপরীত মেরুর সময় সঠিক। বৈশাখী ঝড়ের চেয়ে নীতিহীনতার ঝড় বড্ড বেশি ধ্বংসাত্মক। তাই কবি আলমাহমুদ বৈশাখকে উপজীব্য করে যে কবিতা লেখেন তার অন্তস্থলে এমন এক জিজ্ঞাসা হাজির- যা আমাদের নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করে। আমাদের যেন আমাদেরই সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কবি ভর্ৎসনা করেন ঝড়কে, আদতে কবি তা তো করেন সময়কেই, মানে সময়ের মানুষকে। ‘যে বাতাসে বুনোহাঁসের ঝাঁক ভেঙ্গে যায়/জেটের পাখা দুমড়ে শেষে আছাড় মারে/নদীর পানি শূন্যে তুলে দেয় ছাড়িয়ে/নুইয়ে দেয় টেলিগ্রাফের থামগুলোকে/সেই পবনের কাছে আমার এই মিনতি-/তিষ্ঠ হাওয়া তিষ্ঠ মহাপ্রতাপশালী, গরিব মাঝির পালের দড়ি ছিঁড়ে কি লাভ?/কি সুখ বলো গুঁড়িয়ে দিয়ে চাষীর ভিটে?/বেগুন পাতার বাসা ছিঁড়ে, টুনটুনিদের উল্টে ফেলে,/দুঃখী মায়ের ভাতের হাঁড়ি-/হে দেবতা, বলো তোমার কি আনন্দ,/ কি মজা পাও বাবুই পাখির ঘর উড়িয়ে?’ (বোশেখ)। ততদিনে পৃথিবীতে যে পুঁজির মিনার স্থায়ী হয়ে গেছে তাই বুঝতে সাহায্য করে এই কবিতা। সরল চোখে এ বাক্য বৈশাখকে বললেও অন্তর্চোখ জানান দেয় উুঁচ আর নিচুর অর্থনৈতিক বৈসম্যের পাহাড়কে। যে পাহাড় দিনে দিনে বাড়ে, কমে না কোথায়। কাল সচেতন আরেক কবি ফররুল আহমদের বৈশাখ নির্ণিত কবিতায় কালের কালো ধুলা দেখি, শঙ্কা দেখি, উৎকণ্ঠা দেখি, ভাবনা দেখি। ‘বৈশাখ’ নামে তার কবিতার চরণগুলো তাই এরকম, ‘ধ্বংসের নকিব তুমি হে দুর্বার, দুর্ধর্ষ বৈশাখ/ সময়ের বালুচরে তোমার কঠোর কণ্ঠে-/ শুনি আজ অকুণ্ঠিত প্রলয়ের ডাক।’ এ কবি বৈশাখকে ডাকছেন ধ্বংসের নকিব রূপে। দ্বিতীয় চরণে আরও স্পষ্ট করে তিনি সময়কে বলছেন বালুচর! যা প্রকাশ করে কালের দুঃসময়কে। তার ‘বৈশাখের কালো ঘোড়া’ কবিতাটি পাঠ করলে সময়ের আরও নাজুক নূপুর দেখতে পাই জলের মতো টলটল। সেখানে তিনি বলছেন , ‘বৈশাকের কালো ঘোড়া উঠে এলো। বন্দরে শহরে/পার হয়ে সেই ঘোড়া যাবে দূর কোফাফ মুলুকে,/অথচ চলার তালে ছুটে যাবে কেবলি সম্মুখে/প্রচ- আঘাতে পায়ে পিষে যাবে অরণ্য, প্রান্তর।’ কবির কাছে বৈশাখ শুধু একটি মাস, বাংলা বর্ষের প্রথম লগ্ন নয়। বৈশাখ বিপ্লবের মতো। আপসহীনতার মন্ত্র। তবে বিপ্লব, আপসহীনতা কোন সময়ের জন্য ভাবতে হয়, তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? সকল সময় যে মন্দ সময় যায় এমন না। সময় তো সানন্দেরও হয়। কখনো উজানে, কখনো ভাটিতে মিলিয়েই তো সময় অগ্রসর হয় সমানের দিকে। সময়টা পরিবর্তনশীল বলেই পৃথিবীও পরিবর্তনশীল। মনুষ্য আচরণে প্রতিনিয়ত বদলায় সময়। সময়টা বৈশাখেও লিখিত হয় কবির কবিতায়। কবিতা টিকে থাকে কালের পাতায়, সেই পাতা থেকে প্রজন্ম অনুমান করে কালকে। কবি আহসান হাবিব এর কবিতায় বৈশাখ-নিক্তির ভেতর আমরা পাই ঊষার লালিত্যে ভরপুর এক সময়কে। যে সময়কে পাঠ করে জানতে পারি সময় কেবল নেতিবাচক হয়েই ভাসে না, ইতিবাচক হয়েও ভাসে, ‘ মৃগনাভি-দুলনায় নিজেকেই নিজে/মুগ্ধ করে রেখেছ ঊষার লালিত্যে/আর মধ্য দিনের আগমনে তুমি অকৃত্রিম/তোমাকে আমি কি দিতে পারি/ কি দেব বলো হে বৈশাখ।’ (হে বৈশাখ) শামসুর রাহমান নাগরীক কবি। গ্রাম ভাঙ্গতে থাকা বিকাল-প্রবণ কালে কবি বড় হয়ে উঠছেন। মানুষ শহরে আসছে। কবি মুক্তিযুদ্ধ দেখছেন। এর ভেতর দিয়ে পরিণত হয়ে উঠছেন। অভিজ্ঞতায় ভারি হচ্ছেন। তিক্ত সময়ের নদী পার হয়ে এগুচ্ছেন। বিধ্বস্ত দেশের অভাব অনটন দেখছেন। সে কথা বলতে বৈশাখ তার মাধ্যম হয়ে উঠছে। তার কবিতায় সেই বৈশাখের ব্যবহারে পড়া যায় কিভাবে ভেঙ্গে পড়ে শ্রমজীবী মানুষের দিনকাল। কিভাবে তারা হ্যাঁচরে হ্যাঁচরে অতিবাহিত করেন জীবন। ‘রাত্রি ফুরালে জ্বলে ওঠে দিন/বাঘের থাবায় মরছে হরিণ/ কাল বোখেকের তা-বে কাঁপে পড়ো পড়ো চাল/শূন্য ভাঁড়াবে বাড়ন্ত চা/ও ইচ্ছে তার ইচ্ছে’। এই যে ‘বাঘের থাবায় মরছে হরিণ’ কি বুঝবো আমরা? এখানেও তো পুঁজির উত্থানকেই দেখি সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করে আছে বৈশাখে। বৈশাখে যে আয়োজন, যে উদযাপন; বাংলা সংস্কৃতির সাথে মিশে যাওয়া মেলায় খেলায় এক আলোরিত মাস সে কথা কি তবে বাদ গেছে সময় চিহ্নিত করতে? না। সৈয়দ শামসুল হক অনেক কবিতার সাথে তার ‘বৈশাখ’ কবিতায় তুলে এনেছেন তা, ‘আমি কে/আমি পারিনি চিনতে আজ/কি অবাক কি অবাক/পুরনো আমাকে নতুন নতুনে সাজিয়েছে বৈশাখ/দুচোখে আমার নতুন নীলিমা নতুন পৃথিবী ডাকে/দেখি বার বার উৎসব দিনে বাংলায় বাংলা।’ উপর্যুক্ত বাংলার এই প্রধান কবিদের কবিতা ছড়াও পূর্ব ও পরে আরও আরও বহু কবিই তাদের কবিতায় বৈশাখের বৈশিষ্ট্যকে তুলে এনেছেন আপন নয়ন দিয়ে। তারা বাংলা নববর্ষের এই বৈশাখকে, ঋতুর বৈশাখকে, বৈশাখের আয়োজনকে, উৎসবকে, সংস্কৃতিকে যেভাবে দেখেছেন, বুঝেছেন, অভিজ্ঞানে ধারণ করেছেন ঠিক সেভাবেই লিপিবদ্ধ করেছেন আবেগ-উৎসারিত রসে রূপে। সমকালীন প্রতিনিধিত্বশীল কবি নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আসাদ চৌধুরী, শিহাব সরকার, আবিদ আজাদ, কামাল চৌধুরীর কবিতায়ও বৈশাখ এসেছে। এর পরের কবিদের কবিতায়ও বৈশাখ প্রচ্ছন্ন বিছিয়ে আছে। মোটকথা, বাংলা ভাষায় কবিতা লেখেন এমন কবি কমই পাওয়া যাবে, যার খাতায় রচিত হয়নি একটি বৈশাখের কবিতা। উৎসবের কবিতা। নববর্ষের কবিতা। কারও কবিতায় উঠে এসেছে বৈশাখী ঝড়। কারও কবিতায় খরতাপ। কারও কবিতায় দক্ষিণা বাতাসের তোড়। কারও কবিতায় মাঠের চৌচিড় মাটি। কারও কবিতায় খা খা রৌদ্র। কারও কবিতায় নতুন দিনের আগমন বাণী। কারও কবিতায় মরা জরা জীর্ণতাকে শীর্ণতাকে মারিয়ে নবপ্রাণের আহ্বান। আর এ-সব বিষয়ের দূরদৃষ্টে সূক্ষ্ম খেয়াল করলে দেখা যায় সেখানে আঁকা রয়েছে পরিবর্তিত কালের রেখা, যা পাঠে পৃথিবীর সময়কে একবাক্যে পড়া যায়। বৈশাখের কবিতার মধ্য দিয়ে অনুধাবন করা যায়- সময় কিভাবে পরিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে। ভাষা, বর্ণনায়, শব্দের ব্যবহারে সভ্যতার ক্রমবিকাশরূপ কিংবা ক্রম ধ্বংসরূপ আমরা দেখতে পারি নিবিড় বৈশাখী কবিতা পাঠের ভেতর দিয়ে। শুনতে পারি বাংলা কাব্যসাহিত্যে বৈশাখ, দৃশ্যত কালের স্বনন; যা আমাদেরকে কালের ক্রমধারা সম্পর্কে শিক্ষিতই করে না, জ্ঞানী ও ধ্যানীও করে বটে।
×