ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ জুলাই ২০২৫, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২

আপনি জানেন কি মুসলিম পুরুষদের টুপির অজানা রহস্য ?

প্রকাশিত: ২১:০০, ২০ জুলাই ২০২৫

আপনি জানেন কি মুসলিম পুরুষদের টুপির অজানা রহস্য ?

ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালে দেখা যায়, মুসলিম সমাজে পুরুষদের মাথা ঢেকে রাখার ঐতিহ্য কেবল রীতি বা প্রয়োজন থেকেই নয়, বরং পদমর্যাদা, ধর্মীয় পরিচয়, সামাজিক মর্যাদা ও আত্মমর্যাদার প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছিল। নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও পাগড়ি পরিধান করতেন এবং সাহাবিদের তা পরার উৎসাহ দিতেন। হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে, তিনি পাগড়ির পিছনের অংশটি কাঁধের মাঝে ঝুলিয়ে রাখতেন।

মক্কা বিজয়ের সময় তিনি একটি কালো পাগড়ি পরে প্রবেশ করেন এবং বদর যুদ্ধে ফেরেশতারা সোনালী রঙের পাগড়ি পরে এসেছিলেন সাহাবি জুবায়ের ইবন আল-আওয়ামের (রা.) সম্মানে। ঐতিহাসিক দলিল অনুসারে, পাগড়ি ছিল আরবদের জন্য একটি 'মুকুট'। পরে এই ঐতিহ্য আলেম-ওলামা ও ধর্মীয় পণ্ডিতদের মাঝে বিস্তার লাভ করে। ইমাম মালিক (রহ.) বর্ণনা করেন, তার মা তাকে ইলম শিক্ষার উদ্দেশ্যে পাঠানোর সময় নিজের হাতে তার মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দেন। তিনি বলেন, "আমি কোনো মহৎ মানুষকে পাগড়ি ছাড়া দেখি নি।"

আজও, বিশেষত আলেমগণের মধ্যে, বিভিন্ন রঙ ও শৈলীর পাগড়ি একজন ব্যক্তির ধর্মীয় অবস্থান, শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা আধ্যাত্মিক সংযোগ প্রকাশ করে। মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লাল টুপি ও সরু পাগড়ি পরিধান করে থাকে, অন্যদিকে ইয়েমেনের দারুল মুস্তাফা কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশের দারুল উলূমের শিক্ষার্থীরা ভিন্নধর্মী পাগড়ি পরে। তুরস্ক ও বালকান অঞ্চলের সরকারি ইমাম ও খতিবগণ একটি সাদা পাগড়ি জড়ানো লাল টুপি পরে থাকেন।

আব্বাসীয় যুগে (৭৫০–১২৫৮) কালো পাগড়ি ও পোশাক ছিল সরকারি ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের চিহ্ন। আফ্রিকার মারাবিতুন শাসকগোষ্ঠী পুরুষদের নাক-মুখ ঢেকে রাখার 'লিথাম' প্রচলন করলেও, তাদের পরবর্তী মুওয়াহহিদুন শাসকরা তা নিষিদ্ধ করে।

মামলুক ও অটোমান যুগে পাগড়ি ও টুপির আকার, রং, জড়ানোর ধরন ইত্যাদি সমাজে একটি মানুষের পেশা, ধর্মীয় পরিচয়, এমনকি রাজনৈতিক অবস্থান পর্যন্ত চিহ্নিত করত। অটোমান সমাজে মুসলমানরা সাদা, ইহুদিরা সবুজ, খ্রিস্টানরা নীল ও জরথুস্ট্রবাদীরা কালো পাগড়ি পরত। অনেক সুলতান ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁদের কাফন পাগড়ির মাঝে জড়িয়ে রাখতেন, মৃত্যুচিন্তা ও সুবিচারের স্মারক হিসেবে।

সুফি তরিকাগুলোর মাঝে বিভিন্ন ধরনের টুপি ও পাগড়ি ব্যবহৃত হত আধ্যাত্মিক স্তর ও সম্পর্ক বোঝাতে। মাওলাভি তরিকার লম্বা টুপি, কিরগিজদের 'আক-কালপাক', আফগানদের পাকোল, পূর্ব আফ্রিকার কোমা এবং মালয় অঞ্চলের সঙকক ছিল বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অংশ।

১৮শ ও ১৯শ শতকে অটোমান সাম্রাজ্যে সংস্কারমূলক উদ্যোগের অংশ হিসেবে সুলতান মাহমুদ দ্বিতীয় ১৮২৬ সালে 'ফেজ' টুপি চালু করেন, যা দ্রুত পুরো মুসলিম দুনিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতীয় হায়দারাবাদি রুমি টুপি, মালয় সঙকক, আফ্রিকান ও মিশরীয় শৈলীর ফেজ প্রাচীন ঐতিহ্যকে নতুন রূপ দেয়।

উপনিবেশবাদ ও পাশ্চাত্য আগ্রাসনের যুগে ফেজ ও পাগড়ি ইউরোপীয় ফ্যাশনে স্থান পায়। ফরাসি 'জোয়াভ' বাহিনী, আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সৈনিক, এমনকি ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডের 'স্মোকিং ক্যাপ' এ প্রাচ্য প্রভাব দৃশ্যমান ছিল। এমনকি একটি মেসোনিক সংগঠন 'শ্রাইনারস' এখনো ফেজকে তাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে।

ওসমানীয় খিলাফতের বিলুপ্তি ও আধুনিক তুরস্কে ১৯২৫ সালের 'হ্যাট আইন' দ্বারা ফেজ ও পাগড়ি নিষিদ্ধ হয়। একই ধারা অনুসরণ করে অনেক মুসলিম দেশে ঐতিহ্যগত হেডড্রেস বিলুপ্ত হয়ে যায় অথবা নির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরবে লাল-সাদা গুতরা স্টাইল সার্বজনীন করা হয়, যদিও হিজাজি ঘাবানা বা ফুলের মালা মাথার সাজ পূর্বে প্রচলিত ছিল।

আজকের দিনে মুসলিম পুরুষরা মূলত সালাত, ঈদ, বিবাহ অথবা বিশেষ ইসলামি অনুষ্ঠানে টুপি বা পাগড়ি ব্যবহার করেন। তবে সর্বাধিক ব্যবহৃত ও সর্বজনীন প্রতীক হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিনি কেফিয়াহ, যা কেবল জাতীয় পরিচয় নয় বরং বৈশ্বিক প্রতিরোধ ও ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এই ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ ও সংরক্ষণ আজকের প্রজন্মের জন্য একটি সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক দায়িত্ব।

Jahan

×