ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এবার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই পালিত হলো স্বাধীনতা দিবস

প্রকাশিত: ১০:৩২, ২৭ মার্চ ২০২০

এবার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই পালিত হলো স্বাধীনতা দিবস

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ দেশের চিরচেনা চিত্রই পাল্টে গেছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা, প্রায় জনশূন্য। দেশের পথে প্রান্তরে যেন চলছে অঘোষিত লকডাউন। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস থেকে নিজেদের রক্ষা এবং বিস্তৃতিরোধে দেশের অধিকাংশ মানুষই এখন স্বেচ্ছায় ঘরে থাকছেন। স্বাধীনতা লাভের ৪৯ বছরে এই প্রথম এবার বাংলাদেশের জন্মদিনে ছিল না কোন রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা কিংবা স্বাধীনতা দিবসের কোন কর্মসূচী। ছিল না কোন উৎসব-আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের চিত্র। বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে দেখা দেয়া করোনাভাইরাসের কারণে স্বাধীনতা দিবসের সকল রাষ্ট্রীয়, সরকারী-বেসরকারী সকল কর্মসূচীই বাতিল করা হয়েছিল আগেই। তবে প্রাণঘাতী করোনাও কৃতজ্ঞ মানুষের মন থেকে ভুলিয়ে দিতে পারেনি দেশের জন্মদিনের কথা। কোয়ারেন্টাইনে অর্থাৎ ঘরে বসে থাকলেও তাদের মন পড়েছিল সাভার স্মৃতিসৌধে, ৩২ নম্বর ধানম-ির বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। অনেকে ঘরে থেকে আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তে পারিবারিকভাবে এবং প্রতীকীভাবে শহীদদের স্মরণে নানা আয়োজনে অংশ নেয়। হৃদয়ের গভীরতায় বৃহস্পতিবার যে যার অবস্থানে থেকেই কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতি দেশের স্বাধীনতা দিবসে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি। মনের গভীরতা থেকে ঘৃণা ও ধিক্কার জানিয়েছেন একাত্তরের ঘাতক, স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের প্রতি। করোনাভাইরাসের নিষেধাজ্ঞার কারণেই সীমিত আকারে হলেও বৃহস্পতিবার মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণ করেছে জাতি। স্বাধীনতা দিবসে আনুষ্ঠানিকতা বাতিল করে বৃহস্পতিবার সকাল সাতটায় বাংলা একাডেমি তাদের আঙিনায় উত্তোলন করে লাখো শহীদের রক্ত¯œাত জাতীয় পতাকা। সব কর্মসূচী বাতিল হলেও দেশের অনেক পথে, প্রান্তরে, বাসা-বাড়িতে পত পত করে উড়েছে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা। আর এ পতাকা জানান দিয়েছে একটি স্বাধীন দেশের জন্মদিনের কথা। যে দেশটি অর্জনে ত্রিশ লাখ মানুষকে আত্মবলিদান দিতে হয়েছে। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস এবার ঘটা করে দেশের জন্মদিন পালন করতে না দিলেও মানুষ ঘরে বসেই, আবার অনেকে গণজমায়েত না করে এক দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে ধানম-ির বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে, আবার অনেকে পারিবারিক নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বীর শহীদদের। যার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, আমরা পেতাম না স্বাধীন দেশ ও পতাকা। সেই স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ ছাড়াও হৃদয় থেকেই স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান দেয়া ত্রিশ লাখ শহীদদের প্রতি জানিয়েছেন বিনম্র শ্রদ্ধা, জানিয়েছেন দেশের মানুষ। কেউবা ঘরে বসে একাত্তরের বীর শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া ও মোনাজাত করেছেন। সত্যিই এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে জাতির সামনে এসেছিল বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটির জন্মদিনটি। একাত্তরের মতোই এবার দেশের জন্মদিনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সম্মিলিতভাবে প্রাণঘাতী করোনা মোকাবেলার দৃঢ় শপথ নিয়েছেন দেশের মানুষ। কালরাতের আঁধার পেরিয়ে আত্মপরিচয় অর্জন ও পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গার দিনটি বাঙালী জাতি হৃদয়ের গভীরতা থেকে শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্মরণ করেছে একাত্তরের বীর শহীদদের। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৪৯ বছর পূর্ণ করা বাংলাদেশে এবার স্বাধীনতা দিবস এসেছে নতুন অনুষঙ্গ নিয়ে। করোনা নামক এক প্রাণঘাতী ভাইরাস পুরো বিশ্বকে প্রায় অচল করে দিয়েছে। প্রতিদিনই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে মানুষের প্রাণ। বাংলাদেশও এর থেকে মুক্ত নয়। বাংলাদেশে ভাইরাসটি মহামারী আকারে দেখা না দিলেও দেশের মানুষ সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বেচ্ছায় নিজ নিজ ঘরে নিজেদের কোয়ারেন্টাইনে রেখেছেন। বিশ্ব ও দেশের বাস্তব এমন এক পরিস্থিতির কারণেই বাংলাদেশের মানুষ এবার লাল-সবুজের বিজয়ের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা নিয়ে, মিছিলের পর মিছিল নিয়ে, আনন্দ-উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে স্বাধীনতা দিবস পালন করতে পারেননি। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এবার ছিল না কোথাও কোন জনস্রোত কিংবা জমায়েত করে উৎসব পালনের দৃশ্য। প্রতিবছরের মতো এবার রাস্তায় বের শিশু-কিশোর ও তরুণরা হাতে, গালে কিংবা কপালে রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা এঁকে দেশের জন্মদিনের উৎসবে শামিল হতে পারেনি। ইচ্ছা থাকলেও তরুণ প্রজন্মের ছেলেরা গায়ে জাতীয় পতাকা সদৃশ্য শার্ট পাঞ্জাবি বা গেঞ্জি এবং মেয়েরা পরনে লাল-সবুজের মিশ্রণে জাতীয় পতাকার মতো শাড়ি পড়ে রাস্তায় নামতে পারেনি। স্বাধীনতা দিবসে আনন্দমুখর কোন উৎসবের কর্মসূচী না থাকলেও প্রতিবছরের ন্যায় এবারও দেশের জন্মদিনে মানুষের অন্তঃস্রোতে বয়ে গেছে স্বজন হারানোর বেদনা। বাঙালীর জাতীয় জীবনে আনন্দ-বেদনার এমন দ্বৈরথের ঘটনা খুব বেশি নেই। বাঙালী জাতি আনন্দ আর বেদনার মহাকাব্য স্বাধীনতার সংগ্রামে একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সাহসিকতা আর হাজারো নারীর আত্মত্যাগের বীরত্বগাথা। অন্যদিকে বর্বর পাকসেনা আর রাজাকার-আলবদরদের নিচুতা, শঠতা ও হিংস্রতার কলঙ্কময় ইতিহাস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় ৪৯ বছর আগের এ দিনে পাকিস্তানী বাহিনীর দমন অভিযানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ ভূ-খ-ের মানুষ। তার পরের ৯ মাস পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর চক্র চালিয়েছে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। তাই স্বাধীনতা দিবসের এই দিনে দেশবাসী হৃদয় থেকেই শ্রদ্ধা আর বেদনায় স্মরণ করে যুদ্ধে নিহত স্বজনদের আর অসম লড়াইয়ে বিজয়ী রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার বাদ জোহর নামাজের পর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা মিজানুর রহমান দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন। মোনাজাতে ২৬ মার্চ ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শাহাদাতবরণকারী শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। এছাড়া বর্তমানে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস যেভাবে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে তা থেকে যেন বাংলাদেশের মানুষসহ বিশ্বের মানুষ পরিত্রাণ পায় সেজন্য বিশেষভাবে দোয়া করা হয়। এছাড়া মোনাজাতে দেশ ও জাতির শান্তি-সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ আগস্ট শাহাদাতবরণকারী তাঁর পরিবারের সদস্যের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। এ সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক মুহাম্মদ মহীউদ্দিন মজুমদার, মোঃ আনিছুর রহমান সরকার, উপ-পরিচালক মোঃ আলমগীর হায়দার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বায়তুল মোকাররম মসজিদে জোহর নামাজ পড়তে আসা অল্প কয়েকজন সাধারণ মুসল্লি উপস্থিত ছিলেন। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে জাতির পিতার ম্যুরালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বি-ব্লকে স্থাপিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালে এই শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কনক কান্তি বড়ুয়া, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ডাঃ সাহানা আখতার রহমান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডাঃ মুহাম্মদ রফিফুল আলম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল হান্নান, প্রক্টর অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ মোজাফফর আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ সময়ে তারা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের সামনে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এর আগে ভোরে ক্যাম্পাসে জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পতাকা উত্তোলন করা হয়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ॥ যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদ্যাপন করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। দিবসটি উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সকাল সোয়া ৬টায় বিজিবির সকল ইউনিটসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। দিবসের অন্যান্য কর্মসূচীর মধ্যে- দেশ ও জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আত্মার শান্তি এবং বিজিবির উত্তরোত্তর অগ্রগতি ও একাত্মতা কামনা করে বিজিবির সকল সদস্য নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। এছাড়াও দুপুরে বিজিবির সদস্যদের মাঝে উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হয়। বিজিবির সকল ইউনিটে ‘আমাদের বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং সন্ধ্যার পর পিলখানার গুরুত্বপূর্ণ অফিস ভবন ও গেটসমূহে আলোকসজ্জা করা হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুভেচ্ছা ॥ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের ৪৯তম স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং বাংলাদেশের জনগণকে তাঁর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদকে পাঠানো এক বার্তায় বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের পক্ষ থেকে আমি বাংলাদেশের ৪৯তম স্বাধীনতা বার্ষিকী উপলক্ষে এবং ২০২১ সালে সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের আগে আপনারা যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করছেন তখন আপনাকে ও দেশের জনগণকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।’
×