ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারী কোন নীতিমালা নেই

রাজধানীতে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রাইভেট সিকিউরিটি সার্ভিস

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

রাজধানীতে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রাইভেট সিকিউরিটি সার্ভিস

তপন বিশ্বাস ॥ রাজধানীতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে প্রাইভেট সিকিউরিটি সার্ভিস। সরকারী নীতিমালা ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে এসব সিকিউরিটি সার্ভিস। চরমভাবে অবহেলিত হচ্ছে এ সেক্টরে কাজ করা নিরাপত্তা কর্মীরা। এদের যেন দেখার কেউ নেই। নিয়োগ পদ্ধতি, বেতন কাঠামো, শ্রমঘণ্টা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রশিক্ষণ, দায়দায়িত্ব, কর্তন এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের সুবিধা মতো করছে। কাজ করিয়ে বেতন না দেয়া যেন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সরকারী অফিসে নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ দিতে পারলে কোম্পানির পোয়াবারো হয়ে যায়। সামান্য পরিচয়েই চলছে গার্ড নিয়োগ। যাচাই-বাছাইয়ের কোন বালাই নেই এতে। অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগে যোগ্যতা ও বয়স বিচার করা হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিকিউরিটি সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেও তা নিজস্ব পদ্ধতিতে চলে। বেতন প্রদান ও পরিমাণ-নির্ভর করছে স্ব স্ব সিকিউরিটি সার্ভিসের গৃহীত সিদ্ধান্তের ওপর। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সরকারের একটু সুদৃষ্টি বদলে দিতে পারে এই সেক্টরে কর্মরতদের ভাগ্য। গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় এই সেক্টর একটি শিল্প হিসেবে। বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে কাজ করা নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেতন প্রদান নিয়েও চলছে চরম অনিয়ম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে ৩০০ এর মতো প্রাইভেট সিকিউরিটি সার্ভিস প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশের কয়েক লাখ যুবক-মধ্যবয়সীরা কাজ করে কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করছে সরকারের দৃষ্টি সীমার বাইরে থাকা এই সেক্টরে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঢাকা মহানগরী ও ঢাকার বাইরেও লোকবল সরবরাহ করা হয়। ব্যাংক, বীমা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল, বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি সার্ভিসগুলো নিরাপত্তা কর্মী সরবরাহ করে থাকে। যার মধ্যে সিংহভাগ প্রাইভেট সিকিউরিটি সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এবং কিছু আছে সদস্য ছাড়া। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর মধ্যে কিছু আছে অনুমতিপ্রাপ্ত আবার কিছু আছে অনুমোদন ছাড়া। সরকারী বিভিন্ন অফিস/ হাসপাতালে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। সে ক্ষেত্রেও ব্যাপক অনিয়মের ঘটনা ঘটছে বলে জানা গেছে। শেরে বাংলানগরে অবস্থিত বিভিন্ন সরকারী হাসপাতালে কাগজে কলমে যে নিরাপত্তা কর্মীর বিল প্রদান করা হচ্ছে বাস্তবের সঙ্গে তার কোন মিল নেই। কাগজে-কলমে যেখানে ২৫ জন নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ দেয়া সেখানে সর্বোচ্চ ১৫ নিরাপত্তা কর্মীকে পাওয়া যায়। বাকি ১০ নিরাপত্তা কর্মীর নামে বেতন উত্তোলন করে সরকারী অফিস/হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সিকিউরিটি কোম্পানির মালিক মিলে হাতিয়ে নিচ্ছে। আবার সরকারের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা নিলেও তাদের দেয়া হচ্ছে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। এতে একদিকে শ্রমিকরা যেমন ঠকছে, তেমনি ব্যাপক অপচয় হচ্ছে সরকারেরও । এ ছাড়া বিভিন্ন নামে-বেনামে চলছে এ ধরনের ব্যবসা। সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স আর জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নিবন্ধকের কার্যালয় থেকে নিবন্ধন এ সার্ভিসগুলোর মূল দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। অল্প পুঁজিতে অত্যন্ত লাভজনক এ ব্যবসায়। ফলে মধ্যস্বত্বভোগীরা এ ব্যবসায় বেশি লাভবান হচ্ছে। সূত্রে জানা গেছে, সরকারীভাবে এই ব্যবসার জন্য কিছু পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে সফিপুর আনসার একাডেমিতে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ, লাইসেন্সের জন্য সাত লাখ ৫০ হাজার টাকা পুলিশ মহাপরিদর্শক বরাবর জমা, পুলিশ তদন্তসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়মনীতি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সিকিউরিটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বাংলাদেশ প্রফেশনাল সিকিউরিটিস সার্ভিসেস প্রভাইডারস এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এ প্রক্রিয়া আটকে দেয়া হয়েছে। এ জন্য তারা ব্যবহার করেছে সরকারের একটি প্রভাবশালী মহলকে। ফলে এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের শ্রমঘণ্টা ও বেতনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ব্যাপক অনিয়ম। কোন কোন সিকিউরিটিস সার্ভিস ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত শ্রমঘণ্টা ধরে এবং এর অতিরিক্ত ওভারটাইম হিসেবে ধরে না। বেতন তিন হাজার টাকা থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত। নিয়ম অনুসারে বোনাস, ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ দেয়া হয় না। ঘুমানোর পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়া হয় না। বনানীর এক সিকিউরিটি সার্ভিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মাওলার কাছে তার প্রতিষ্ঠানে গার্ড নিয়োগ পদ্ধতি ও নিয়মনীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি তা জানাতে অনীহা প্রকাশ করেন এবং তাঁর নিজের পরিচয়ও দেন না। তিনি তাঁর হিসাবরক্ষককে দেখিয়ে দেন। হিসাবরক্ষক বলেন, আমি এ প্রতিষ্ঠান থেকে এ মাসেই চলে যাচ্ছি। আমি তেমন কিছু জানি না। তাঁদের প্রতিষ্ঠানে অন্য একজন পরিচয় গোপন রেখে বলেন, এই সিকিউরিটি সার্ভিসের সব ধরনের অনুমতিপত্র ও নিবন্ধন আছে। তখন এমডি পরিচয় গোপন রেখে গোলাম মাওলা পায়চারী করতে করতে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশনসহ সব ধরনের অনুমতিপত্র আমাদের আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিকিউরিটি সার্ভিসটির এক গার্ড মহাখালীতে দায়িত্ব পালনের সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের বেতন ঠিকমতো দেয়া হয় না। মেসে ভাল খাবার দেয়া হয় না। ১২ ঘণ্টা বেসিক ডিউটি করতে হয়। বেতন চাইলে বলে আগামী সপ্তাহে দেয়া হবে। কিন্তু সপ্তাহ এলে আবার একই রকম কথা বলা হয়। বাড়িতে টাকা পাঠানোর খুবই দরকার। এক মাস ২০ দিন গেলেও টাকা পাচ্ছি না। তাই অনেকে চাকরি ছেড়ে বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কথা বললে গালমন্দ করেন। অন্য একটি সিকিউরিটিস সার্ভিসের গার্ড তাঁর এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, আমাদের বেতন থেকে চুরি ফান্ড, মেডিক্যাল ফান্ড, বীমা ফান্ড ইত্যাদি নামে টাকা কেটে রাখে। পাঁচ হাজার টাকা অফেরতযোগ্য ধরে ভর্তির সময় এক হাজার ও মাসে মাসে ২০০ টাকা করে কাটে। অপর এক কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা ১৯৯৭ সালে এ সিকিউরিটি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করে। গার্ড নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন অষ্টম শ্রেণী পাস এবং উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি যোগ্যতা দেখেন। নাগরিকত্বের সনদ, পাসের সনদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে গার্ড নিয়োগ দেন তাঁরা এবং ১০ থেকে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে গার্ডকে দায়িত্ব পালনে পাঠান। যথাযথ প্রশিক্ষণ ও নির্বাচন ব্যতিরেকে দায়িত্ব পালনের অদক্ষতার পরিচয় দেয় নিয়োগ পাওয়া প্রহরীরা। বারিধারার অপর এক সিকিউরিটি সার্ভিসের অফিসে দেখা যায়, ছোট দুটি রুম নিয়ে বসেছে তারা। বেশ কয়েক দিন ঘুরে এ অফিসে একটি পিয়ন ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমাদের এ প্রতিষ্ঠান থেকে নিরাপত্তা কর্মীদের ৬ হাজার টাকা নিয়ে থাকি। এর মধ্যে ৫ হাজার টাকা তাদের দেওয়া হয়। আর এক হাজার টাকা থেকে অফিস ভাড়া ও তাদের ইউনিফর্ম দিয়ে থাকি। এ পর্যন্ত আমাদের ৩শ’ গার্ড বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আবার যথাযথ বাছাই পদ্ধতি না থাকায় অনেক অপরাধীও গার্ডে ঢুকে পড়েছে এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। সিকিউরিটি সার্ভিস আইন ॥ নিরাপত্তা প্রহরী পুলিশ এবং সেনাবাহিনী থেকে সৃষ্টি হলেও আধুনিক যুগে এসে এ পেশাটি একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। ব্যাপক চাহিদা এবং বাজার অর্থনীতি বিকাশের সুযোগে উন্নত দেশসমূহে গড়ে ওঠে নিরাপত্তা সেবাদানকারী বিভিন্ন বেসরকারী কোম্পানি। এই সকল কোম্পানি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক এ্যাক্ট ৩৩০ প্রণীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশেও বেসরকারী সেবা আইন ২০০৪ প্রণীত হয়। এই এ্যাক্ট অনুযায়ী বেসরকারী নিরাপত্তা প্রহরী হচ্ছে এমন একজন ব্যক্তি বা একটি নিরাপত্তা কোম্পানির চাকরিজীবী যিনি নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বিভিন্ন স্থাপনা কিংবা অন্য কোন সম্পত্তির নিরাপত্তা রক্ষা করেন। ইন্টারনেটভিত্তিক বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী, বিশেষ কোন সম্পত্তি এবং সংশ্লিষ্ট লোকদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত বেসামরিক ও বেসরকারী ব্যক্তিই নিরাপত্তা প্রহরী। এরা নিরস্ত্র কিংবা সশস্ত্র দু’রকমের হতে পারে। নিরস্ত্র নিরাপত্তা প্রহরী পদে নিয়োজিত ব্যক্তির বয়স কমপক্ষে ১৮ এবং কোন সন্ত্রাসী তৎপরতা থেকে অনভিযুক্ত হতে হবে। এছাড়াও তাকে অবশ্যই সরকারী লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোন বেসরকারী নিরাপত্তা কোম্পানিতে চাকরিরত কিংবা এরকম কোন কোম্পানি থেকে চাকরির অফার প্রাপ্ত হতে হবে। সর্বোপরি সুনির্দিষ্ট দায়িত্বে নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে তাকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজনে চিহ্নিত করার সুবিধার্থে তাকে সরকারী দফতরে একসেট আঙ্গুলের ছাপ দিতে হবে। এজন সশস্ত্র নিরাপত্তা প্রহরীর বয়স কমপক্ষে ২১ বছর বয়সসহ বেসরকারি সশস্ত্র নিরাপত্তা প্রহরীর লাইসেন্স, স্বীয় আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইত্যাদি থাকতে হবে। বেসরকারী সিকিউরিটি সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা ॥ ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনা এবং পরবর্তীতে ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ সমগ্র বিশ্বকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। যার প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে। ক্রমবর্ধমান অবনতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়সমূহ ভীষণভাবে গুরুত্ব লাভ করেছে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে গঠন করা হয়েছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি নামে একটি নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই খাতটি নিরাপত্তা সেবা প্রদান ছাড়াও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখছে। আমাদের দেশে বর্তমানে এই সেক্টরে কয়েক লাখ লোক কর্মরত রয়েছে।
×