ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কানাডার আদালতের রায়ের পরে মিডিয়ার গো গো সুশীল -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

কানাডার আদালতের রায়ের পরে মিডিয়ার গো গো সুশীল -স্বদেশ রায়

কানাডার আদালতে পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতি মামলা খারিজ হওয়ার ভেতর দিয়ে অনেক দিক সামনে এলো। এক. বাংলাদেশ ও বর্তমান সরকার একটি মিথ্যা দুর্নীতির অপবাদ থেকে মুক্তি পেল। দুই. জাতি হিসেবে বাঙালী সম্মানিত হলো, অন্তত বিশ্বের কাছে প্রথমবারের মতো প্রমাণিত হলো বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ নয়। তিন. নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা আরও অনেক উঁচুতে গেলেন, প্রমাণ করলেন তিনি সত্যিকার সৎ, সাহসী ও জাতীয়তাবাদী নেতা। চার. সব সময়ে বাংলাদেশের যে তথাকথিত সুশীল সমাজ সব কিছুর ওপর তাদের আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন, ওই সুশীল ব্যক্তিরা যে কোন তথ্যভিত্তিক কথা বলেন না, তাঁদের কাছে যে কোন প্রকৃত তথ্য থাকে না- তাঁরা মনগড়া কথা বলেন- তা প্রমাণ হলো। চতুর্থ. দেশের মিডিয়ার কিছু অংশ যে ওই সময়ে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি তাও প্রমাণিত হলো। মিডিয়ার একাংশ সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি, বরং তারা ক্ষতি করেছে দেশের। তবে এখন একটি বিষয় মনে হয় সামগ্রিক মিডিয়ার ভাবার সময় এসেছে, ভবিষ্যত মিডিয়ার সার্বিক চরিত্র কী হবে? কোন একজনের মাথা দিয়ে সেটা বের হওয়া সম্ভব নয়, তবে মিডিয়াতে অনেক নমস্য ব্যক্তিত্ব আছেন, অনেক প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ এসেছেন। সবাইকে মিলে পরিবর্তিত এই বাংলাদেশের মিডিয়ার চরিত্র বিনির্মাণের দিকটি মনে হয় এখন ভাবার সময় এসে গেছে। যেমন, কানাডার আদালতে পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতি মামলা গালগল্প হিসেবে প্রমাণিত হওয়ার পরে, বাংলাদেশের মিডিয়াকে এখন অনেক কিছু নতুন করে ভাবতে হবে। নতুন করে ভাবতে হবে কীভাবে দেশ ও উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাষ্ট্রের এই চতুর্থ স্তম্ভ, এই ওয়াচ ডগ কাজ করবে? কারণ, এ দেশে এখন দ্বিতীয় পদ্মা সেতু হবে, যমুনায় রেল সেতু হবে, যমুনা সেতু থেকে পদ্মা সেতু অবধি নদীর তীর ধরে ফোর লেন হবে, ঢাকা-হিলি ফোর লেনের কাজ চলছে, রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ চলছে, মহেশখালীতে বিদ্যুত হাব হবে। এ ছাড়া আরও উন্নয়নমূলক কাজ বাংলাদেশে হবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে। এর কারণ দুটি : এক. বাংলাদেশের মানুষ বুঝে গেছে- বাংলাদেশে তথাকথিত পালাবদলের রাজনীতির দরকার নেই। বাংলাদেশে উন্নয়নের গণতন্ত্রকে অব্যাহত রাখতে হবে। দুই. ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ২০৩০-এর ভেতর বিশ্বের অন্যতম একটি শক্তিশালী অর্থনীতি হবে। তাই স্বাভাবিকই এখন মিডিয়াকে ভাবতে হবে, মিডিয়া এখন তাদের কোন চরিত্র ঠিক করবে? মিডিয়া কি ঔপনিবেশিক আমলের মতো ‘সরকার’ নাম শুনলেই তার বিরুদ্ধে একটি পাথর ছুড়বে, না কোথায় পাথরটি ছুড়তে হবে তা আগে জেনে নেবে? কারণ, পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতির ঘটনার ভেতর দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে, এই ধরনের বড় বড় উন্নয়ন কাজে, যেখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে সেখানে নানা স্বার্থ থাকবে এবং ওই সব স্বার্থের শিকড় নানা জায়গায় ছড়ানো থাকে। এবং সে যে কত বিস্তৃত তা যদি ছোট্ট একটি উদ্ভিদকে উপমা হিসেবে ধরা হয় তার থেকেই বোঝা যায়। একটি রাইশস্য গাছের মোট শিকড়ের পরিধি কয়েক মাইল লম্বা হয় সেখানে এই একক বিশ্বে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের কাজের স্বার্থ কত হাজার মাইল লম্বা হতে পারে। এসব হিসাব না করেই কিন্তু পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতি মামলা নিয়ে অনেক সাংবাদিকতা হয়েছে। লাসভেগাস থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ককের ‘রাতে জেগে ওঠা’ এলাকার বারের গো গো বয়দের মতো এদেশের বিশেষ গো গো বয়দের সুশীল বানিয়ে, টকার বানিয়ে মিডিয়ায় দেশ, উন্নয়ন ও দেশের সম্মান নষ্ট করার সুযোগ করে দিয়েছেন অনেকে। কিন্তু আজ কানাডার আদালতের এই রায়ের পরে, এখন বলা যেতে পারে, কোন মতেই ইতিহাস নতুন করে লেখা যাবে না, তবে একটি সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্য দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। আর সেটাই করা দরকার এ মুহূর্তে। বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থে, বাংলাদেশের সম্মান ও মূল্যবোধকে উর্ধে তুলে ধরার স্বার্থে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এটা এ সময়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, যেমন আমেরিকার নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে হিলারি ভাল ছিলেন না, তাঁর সততা নিয়ে, তাঁর নীতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে, তিনি আমেরিকার দরিদ্রদের পক্ষ ত্যাগ করেছিলেন, ধনীদের পক্ষ নিয়েছিলেন- এমনও বলা যায়। কিন্তু তার পরেও আমেরিকার মিডিয়ার একটি অংশ কেন ঘোষণা দিয়ে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন দিল, তার সব থেকে বড় কারণ হলো, গণতন্ত্রের যে অন্যতম শর্ত অর্থাৎ গণতন্ত্রে কোন রেসিইজম থাকবে না, সেটাকেই বাঁচিয়ে রাখার জন্য। দূরদর্শী ওই সব মিডিয়ার পরিচালকরা বুঝতে পেরেছিলেন, আমেরিকার রেসিইজমের উত্থান, বাইবেলিক ন্যাশনালইজমের উত্থান, তাই তারা তাদের সর্ব শক্তি নিয়ে নেমে পড়ে। কারণ, তাঁরা জানে হিলারি হেরে গেলেও গণতন্ত্রকে বাঁচানোর কাজে তাঁদের ভূমিকা রাখতে হবে। আমেরিকার মিডিয়ার এই অংশটি ওবামাকেও প্রথমবারের নির্বাচনে একই কাজ করেছিল। মনে হয়েছিল, তারা ওবামাকে সমর্থন করছে। বাস্তবে কিন্তু বুশের হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া আমেরিকার অর্থনীতিকে বাঁচানোর স্বার্থেই সেদিন মিডিয়ার ওই দায়িত্বশীল অংশ ওই কাজ করে। বাংলাদেশেও এখন পদ্মা সেতু এগিয়ে চলেছে। পদ্মা সেতু ২০১৮-এর ভেতর শেষ হবে। কিন্তু পদ্মা সেতুর সুফল পেতে হলে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র চালু হওয়া প্রথমে প্রয়োজন। তাহলেই পদ্মা সেতুর বড় সফলতা মানুষ পাবে। কারণ ওই বিদ্যুত দিয়েই তখন গড়ে উঠবে পদ্মা সেতুর ওপার থেকে খুলনার মংলা পর্যন্ত শিল্প এলাকা। এই শিল্পের চাকা যখন ঘুরবে তখনই কিন্তু পদ্মা সেতুর মাধ্যমে জিডিপিতে যোগ হবে আরও কয়েক শতাংশ। চালু হবে মংলা বন্দর পরিপূর্ণভাবে। একাংশ গিয়ে যোগান দেবে পায়রা বন্দরে। আর এ কারণেই কিন্তু পদ্মা সেতুতে ব্যর্থ হয়ে সেই একই শ্রেণী অর্থাৎ সেই চিহ্নিত গো গো বয়রা এখন রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র যাতে না হয় সেই কাজে লেগেছেন। আগেও তারা যেমন তাদের নেতা হিলারি ক্লিনটনকে ব্যবহার করেছিলেন এবারও আল গোরকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। আর এরা যে গো গো বয় তা বোঝা যায়, এরা সুন্দরবন রক্ষার নামে হরতাল ডাকার দিনটি বেছে নেয় সেই দিনটিকে, যেদিন বেগম জিয়ার দুর্নীতি মামলায় আদালতে হাজিরা দেয়ার দিন থাকে। হরতাল না হলেও বেগম জিয়ার আইনজীবী যাতে আদালতে বলতে পারেন, হরতাল বলেই তাঁর মক্কেল আসতে পারেননি। যারা এই পদ্মা সেতু প্রকল্পে বাধা দেয়, রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রে বাধা দেয় এদের বেগম জিয়ার মতো একটি নষ্ট রাজনৈতিক শক্তি বা দুর্বৃত্ত শক্তির দরকার হয়। এই শক্তিটি তাদের জন্য ওই ‘রাতে জেগে ওঠা’ এলাকার মস্তানরা যে কাজ করে সেই কাজই বাস্তবে করে। বেগম জিয়াদের এখানে লাভ থাকে দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল; অন্যদিকে, যারা সুশীল সেজে থাকে তাদের হয় আর্থিক লাভ। পদ্মা সেতুর আর্থিক লাভ কোথায় ছিল তা খুব শীঘ্র আরও ভালভাবে বের হয়ে আসবে। তবে এটা তো ঠিক, বিশ্বব্যাংক এমন একটি কোম্পানিকে কাজ দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল যাদের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না শুধু নয়, তারা জাল ডকুমেন্টস দিয়ে দরপত্রে অংশগ্রহণ করেছিল। কর্পোরেট দুর্নীতির ইতিহাস পড়লেই দেখা যায়, সারা বিশ্বেই এসব কোম্পানি সুশীলের নামে এ গো গো বয়দের পালন করে। এদের কালো অর্থনীতির হাত অনেক শক্ত। বাংলাদেশের বর্তমানের ও ভবিষ্যতের উন্নয়নের কালে এই কালো অর্থনীতির হাত বার বার প্রবেশ করবে। তাই এ ক্ষেত্রে মিডিয়াকে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। মিডিয়ার বেশি অংশ এতদিন যা করে এসেছে অর্থাৎ সার্কুলেশান বাড়ানোর জন্য বা টিআরপি রেটিং বাড়ানোর জন্য ওই সব গো গো সুশীলকে প্লাটফর্ম দিয়েছে। এখন ভাবার সময় এসেছে, সত্যিকার অর্থে যারা বাংলাদেশে বিশ্বাস করে, যারা দেশের উন্নয়ন চায়, সম্মান চায় তারা ওই সব ব্যক্তিকে প্লাটফর্ম দেবে কিনা? যেমন রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র ও সুন্দরবন নিয়ে যারা আন্দোলন করছেন, যারা রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ করতে চাচ্ছেন, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট নিয়ে তাদের জ্ঞান কতটুকু? তাদের সাবজেক্ট কি ওটা? তাই কেউ একজন কোন বিষয় নিয়ে দোকান খুলে বসলেন, আর ওমনি ওই বিষয়ে মিডিয়ায় তাকে কথা বলার প্লাটফর্ম করে দেয়া হবে, এ কিন্তু প্রকৃত সাংবাদিকতার ভেতর পড়ে না। যিনি ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তিনিই কথা বলবেন। মিডিয়া তাকেই প্লাটফর্ম দেবে। কানাডার আদালতের এই রায়ের পরে, মিডিয়া যদি সচেতন না হয়, তাহলে শুধু একের পর এক দেশের ক্ষতি হবে না- মিডিয়াও বিশ্বাস যোগ্যতা হারাবে। তবে বাস্তবতা হলো, সৎ মানুষ যেমন শেষ অবধি বিজয়ী হন, সৎ রাজনীতি যেমন শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়, মিডিয়ার সঠিক অংশকেই শেষ অবধি মনে রাখে মানুষ। যেমন আজ আমেরিকায় মিডিয়ার যে অংশ রেসিইজমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তারাই কিন্তু ইতিহাসে টিকে থাকবে। ইতিহাসের যে কোন ওলট পালট সাময়িক, সত্যই শেষ ঠিকানা। যেমন পাঁচ বছর না যেতেই কানাডার আদালত বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মুখে চুনকালি দিয়ে উন্মোচন করল সত্য। [email protected]
×