ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

লংকাভী দ্বীপে এক জুলহাসের কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১২ জানুয়ারি ২০১৭

লংকাভী দ্বীপে এক জুলহাসের কাহিনী

ফিরোজ মান্না, লংকাভী থেকে ॥ পর্যটনের শহর লংকাভী। বিশে^র নানা প্রান্ত থেকে সাগরঘেরা পাহাড় দ্বীপটির অপূর্ব রূপ দেখতে হাজারো পর্যটকের মেলা বসে এখানে। দশ বছর আগে এই দ্বীপ শহরে বাংলাদেশের তরুণ জুলহাস আসে তার ভাগ্য বদল করতে। শিক্ষার আলো না থাকলেও আপন আলোয় জীবনকে বদলে নিয়েছে জুলহাস। শুধু জুলহাসই নয়, জীবন বদলের জন্য ছোট ভাই জসিমকেও নিয়ে এসেছে এখানে। টিকে থাকার লড়াইয়ে তারা বিজয়ী বীর। শুদ্ধ বাংলা বলতে না পারলেও কথা বলছে ইংরেজী, মালয় আর চায়নিজ ভাষায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তাদের আটকে থাকতে হয়নি। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থানার মইশগড়া গ্রাম থেকে মালয়েশিয়ার লংকাভীতে আসে জুলহাস। নয় বছর পর ছোট ভাই জসিমকেও নিয়ে আসে। দুই ভাই একই মালিকের অধীনে কাজ করছে। চটপটে তরুণ জুলহাস উদ্দিন এখানে দু’টি চাকরি করে। একটি চাকরি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। অন্যটি খাবার হোটেলে। সকাল আটটায় প্রথম চাকরির কাজ শুরু হয়। এই কাজ শেষ হয় রাত আটটায়। এরপর জুলহাস উদ্দিন বেশ খানিকটা পথ হেঁটে জালান পেনাপাকে হাজী আলী ফুড কোর্টে একটি ছোট খাবার হোটেলে কাজ শুরু করে। এই কাজ তার শেষ হয় রাত ১২ টায়। দিনে রাতে ষোল থেকে সতের ঘণ্টা শ্রম ঘাম ঢেলে পরিবারকে দিয়েছে সচ্ছলতা। এত পরিশ্রম তবুও তার মুখে কোন ক্লান্তির ছাপ নেই। রাত ১১টায় যখন আমরা ওর খাবার হোটেলে খেতে যাই তখন পরম অনন্দে আমাদের খাবার পরিবেশন করছিল। হোটেলের মালিক ওর উপর খুশি। মালিক বলে জুলহাস খুশি মনে কাজ করে রাতদিন। দেশের কোন মানুষের সঙ্গে দেখা হলে মুহূর্তে আপন করে নেয় সে। পর্যটকদের জন্য সে নিবেদিত। কোন কিছুর প্রয়োজন হলে তাদের তা ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে। করিৎকর্মা জুলহাসের সঙ্গে মঙ্গলবার কথা হলো হাজী আলী ফুডকোর্টে। জুলহাস তার জীবনের গল্প শোনায়, একেবারেই অন্যরকম গল্প। লেখাপড়া জানে না সে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গ-িও পার করেনি। বাড়িতে বেকার ঘুরে বেড়াত। একদিন গ্রামের এক দালাল তাকে জানায় মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা। দালালের কথায় সে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু টাকা পাবে কোথায়। কৃষক বাবা মোঃ কুরবান আলী এত টাকা কোথায় পাবে। পরে জমি বিক্রি করে দালালের হাতে টাকা তুলে দেই। এরপর একবছর দালালের পিছে ঘুরে ২০০৭ সালে আমি মালয়েশিয়া আসি। এখানে এসে অথৈ সাগরে পড়ি। এদের ভাষা জানি না। কারও কথা বুঝি না। কিভাবে আমার কথা তাদের বুঝাই। এমন এক মহাবিপদে পরলাম যে তা বলে শেষ করা যাবে না। বাঙালীদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়েছে। কিন্তু তা হলে কি হবে। আমাকে টিকে থাকতে হবে। টিকে থাকতে হলে এই দেশের ভাষা আমাকে শিখতেই হবে। শুরু করলাম ভাষা শেখা। এখন ইংরেজী, মালয় ও চাইনিজ ভাষায় কথা বলতে পারি। জীবন বদলের জন্য এই চ্যালেঞ্জেও বিজয়ী হই। আমার আর কোন সমস্যা হয় না। এখন ওদের সঙ্গে আমি ওদের মতোই কথা বলি। তাছাড়া লংকাভী পর্যটনের শহর। এখানে ইউরোপ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশের মানুষ আসে। দোকানে কাজ করতে গেলে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। শুরুতে পারতাম না। এখন তাদের সঙ্গেও ভালভাবেই কথা বলতে পারি। জুলহাস তার গত দশ বছরের সাফল্য গাথা তুলে ধরে। সে বলে, আমি দশ বছর ধরে মালয়েশিয়ার লংকাভী কাজ করছি। প্রথমে ৮শ’ রিংগিত বেতন পেতাম। সেখান থেকে ৪ থেকে ৫শ’ রিংগিত বাড়িতে পাঠাতাম। নিজে কষ্ট করে বাবা-মা-ভাই-বোনের জন্য টাকা পাঠিয়েছি। চিন্তা করলাম এত অল্প টাকায় কিভাবে আমি চলব। পরে অন্য আরেকটি কাজ খুঁজতে শুরু করলাম। পেয়েও গেলাম। এখন আমি দুটি চাকরি করি। মাসে আমার এখন আড়াই থেকে তিন হাজার রিংগিত বেতন। বাড়ির বড় ছেলে আমি। আমার অনেক দ্বায়িত্ব। ১২ লাখ টাকা ব্যয় করে বাড়ি করলাম। বাবা সারা জীবন ভাঙ্গাচুরা ঘরে বসবাস করেছে। এখন আমাদের গ্রামে আমার বাড়িটাই সবচেয়ে সুন্দর। ছোট ভাই জসিম এসএসসি পাস করে বাড়িতে বসেছিল। চেষ্টা করেছি তাকে অনেক পড়াবার। কিন্তু সে পড়লো না। পড়ালেখার যে কি দাম তা আমি বুঝতে পারি। প্রথম যখন আমি মালয়েশিয়া আসলাম তখন কারও কথা কিছু বুঝতাম না। তখন আমার খুব কষ্ট হয়েছে। এরপর চিন্তা করলাম ওদের কথা যদি আমি না বুঝি তাহলে এখানে আমি কিছুই করতে পারব না। ওদের ভাষা শিখতে শুরু করলাম। এখন আমি ইংরেজী, মালয় ও চাইনিজ তিনটি ভাষায় সমান তালে কথা বলতে পারি। চাইনিজ মালিকের ‘হাইহিন’ নামের একটি দোকানে ২ হাজার রিংগিত বেতনের চাকরি পেয়ে গেলাম। তাই ভাইকে বলেছিলাম তুই পড়ালেখা কর। কিন্তু ছোট ভাই তা করল না। এখন ওকেও আমি মালয়েশিয়া নিয়ে এসেছি। ভাইকে আনতে আমার সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে। জুলহাস নিজেকে একজন সফল মানুষ মনে করে। তার একার উপার্জন দিয়ে বাড়িতে বাবা-মা-বোনকে সুখে রাখতে পেরেছে। ছোট ভাইয়ের জীবনকে বদলে দিতে এক বছর আগে তাকে নিয়ে এসেছে। এই সফল তরুণের মুখের হাসিতে কোথায় যেন একটা বিষণœতা কাজ করছে। মাঝে মাঝে নিজের থেকে অন্যমনষ্ক হয়ে যাচ্ছে। তখন সে মোবাইল তুলে বাড়িতে ফোন করছে। জিজ্ঞেস করছেÑ মা, তাবাসসুম কেমন আছে। তাবাসসুম কে জানতে চাইলে সে বলে আমার মেয়ে। বয়স আড়াই বছর। কোন এক ঘটনার কারণে মেয়ের মা চলে গেছে। মেয়েটা আমার মায়ের কাছেই রয়েছে। আমার ওকে খুব মনে পড়ে। তাই দিনে কয়েক বার বাড়িতে ফোন করি। এত কষ্ট করে কাজ করি। তারপরও আনন্দে থাকতে চাই। কিন্তু কোথায় যেন একটা বেদনা রয়ে যায়। বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করে। আবার চিন্তা করি আমি বাড়ি গেলে বাবা-মা, ছোট বোন কিভাবে ভাল থাকবে। ওদের ভাল রাখার কথা চিন্তা করে বাড়ি যাই না। তবে এবার ছুটি নিয়ে বাড়িতে যাব।
×