ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজাকে হারিয়ে এখনও শোকার্ত থাই জনগণ

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১১ জানুয়ারি ২০১৭

রাজাকে হারিয়ে এখনও শোকার্ত থাই জনগণ

থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজ গত ১৩ অক্টোবর ৮৮ বছর বয়সে লোকান্তরিত হওয়ার পর থাই জনগণের রাজাকে হারানোর শোক ও বিয়োগব্যথা এখনও কাটেনি। যুবরাজ মহা ভাজিরালোংকর্ন আগামী ১ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসনে আরোহণ করবেন। প্রয়াত রাজার শোকানুষ্ঠানে লোকে যাতে যোগ দিতে পারে তার জন্যই তিনি সিংহাসন আরোহণ বিলম্বিত করেছেন। থাই রাজার মৃত্যু সে দেশের জনগণের কাছে পিতৃহারার মতো ব্যাপার। বিশ্বের ইতিহাসে রাজা ভূমিবলের মতো এত দীর্ঘ সময় আর কেউ সিংহাসনে থাকেননি। ১৮ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণের পর থেকে দীর্ঘ ৭০ বছর তিনি এই আসনটি ধরে রেখেছিলেন। এবার তার পুত্র যুবরাজ ভাজিরালোংকর্নের পালা। তিনি প্রথানুযায়ী রাজার মরদেহ সুগন্ধী পানিতে স্নান করিয়েছেন। চিরুনি দিয়ে চুল আঁচরিয়ে সেটি দুই টুকরো করে ভেঙ্গেছেন। এরপর নানাবিধ সুগন্ধী দ্রব্য দিয়ে রাজার মরদেহ তাজা করে রাখা হয়েছে। শোকানুষ্ঠান শেষে মরদেহ একটি চিতায় রেখে দাহ করা হবে। শেষকৃত্যের কোন তারিখ ধার্য করা না হলেও বছরখানেক সময় লাগবে। সুতরাং এখন থাইল্যান্ডে জাতীয় শোক চলছে যা ১২ মাস স্থায়ী হবে। থাইরা ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিগুলো কালো চতর্ভুজের মধ্যে প্রদর্শন করছে। কাপড়ের দোকানে ম্যানিকিনগুলোকে রাখা হয়েছে। সরকারী কর্মচারীরা শোকের চিহ্ন হিসেবে কালো পোশাক পরছে যা তারা এক বছর ধরে পরবে। অনেকে শোক প্রকাশের এত দীর্ঘ ও ব্যাপক আয়োজনকে দেশের ভবিষ্যত নিয়ে জনগণের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ভিন্ন খাতে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। রাজার মৃত্যু অপ্রত্যাশিত ছিল না। তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে থাইল্যান্ড রাজতন্ত্রপন্থী এলিট এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন শিনাওয়াত্রার নেতৃত্বাধীন শক্তি- এই দুই প্রধান শক্তির মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। থাকসিন ২০০৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। তার প্রক্সি হিসেবে নির্বাচিত উত্তরসূরিও ২০১৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন। তারপর থেকে দেশটি শাসিত হয়ে এসেছে সামরিক জান্তার দ্বারা, যার নাম ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর পিস এ্যান্ড অর্ডার। জান্তা সেনাশাসনের বিরোধীদের জেলে পুরেছে। নির্বাচন ২০১৭ সালের শেষভাগ অবধি পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। শোকের এই দীর্ঘ অধ্যায়ে থাইল্যান্ডের ভবিষ্যত নিয়ে কেউ কথা বলতে চাইবে না। অন্যদিকে সামরিক বাহিনী দায়িত্ব নিতে চাইবে এবং নিজেকে দেশের চূড়ান্ত ভবিষ্যত হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করবে। রাজা ভূমিবল ছিলেন সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে একটা নিয়ন্ত্রণ। তিনি ছিলেন নিম্ন আয়ের মানুষদের ক্রমবর্ধমান হতাশা প্রশমনের একটা মাধ্যম। এখন তিনি না থাকায় থাইল্যান্ড হয়ে পড়বে একটা খ-িত জাতির মতো। সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে জান্তা ক্ষমতায় এসেছে তার প্রধান প্রাইয়ুথ চান ওচা। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার দেশকে দূরে সরিয়ে এনেছেন এবং চীনের সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছেন। এর পেছনে প্রেরণা হলো অর্থনৈতিক। থাই অর্থনীতির এক-দশমাংশ পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। এ বছর রেকর্ডসংখ্যক ৩ কোটি ৩০ লাখ ট্যুরিস্টের আগমন ঘটবে বলে আশা করছে থাইরা। এই ট্যুরিস্টদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই হবে চীনা নাগরিক। থাইল্যান্ড চীনের পক্ষপুটে চলে যাওয়ায় এশিয়ায় আমেরিকা তার সবচেয়ে বলিষ্ঠ মিত্রদের একজনকে হারানোর আশঙ্কায় পড়ল। আর সেটা ঘটল এমন এক সময় যখন বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগর ও অন্যান্য গোযোগপূর্ণ এলাকায় চীনের প্রভাব মোকাবেলায় তার আঞ্চলিক সমর্থন প্রয়োজন। থাই সমাজ তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছেÑ রাজতন্ত্র, সামরিক বাহিনী ও জনগণ। ১৯৪৬ সালে রাজা ভূমিবল যখন অপ্রত্যাশিতভাবে সিংহাসনে আরোহণ করেন ততদিনে রাজতন্ত্র তার সর্বময় কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছিল এবং ক্ষমতালিপ্সু ফিল্ড মার্শালদের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। কালক্রমে স্নায়ুযুদ্ধের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া একটা প্রক্সি রণাঙ্গনে পরিণত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র থাইল্যান্ডকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লে আমেরিকায় শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণ রাজা যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করতে এগিয়ে আসেন। তিনি নিশ্চিত করেন যে থাইল্যান্ড কমিউনিস্ট শাসনাধীনে যাবে না। ওয়াশিংটনের আশীর্বাদে এবং নিজের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার জোরে তরুণ নিয়মতান্ত্রিক রাজা এমন এক প্রতীকী সম্পর্ক গড়ে তোলেন যেখানে রাজতন্ত্র সামরিক বাহিনীকে বৈরতা দেবে এবং সামরিক বাহিনী রাজতন্ত্র রক্ষায় অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবে। রাজা ভূমিবল কমিউনিস্ট প্রভাব ঠেকাতে আমেরিকানদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কিছু করেছিলেন। দেশের সুদূরতম প্রান্তে গিয়ে তিনি উন্নয়ন প্রকল্পে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। শত শত বছর ধরে সামন্ততান্ত্রিক অবহেলার শিকার কৃষকরা রাজার এমন কৃপাদৃষ্টি লাভ করায় তাদের কাছে তিনি দেবতার আসন লাভ করেছিলেন। ‘তার প্রতি কৃষকদের ভক্তি হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। ১৯৭৩ সালে রাজা গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভরত ছাত্রদের সেনাবাহিনীর রোষানল থেকে বাঁচানোর জন্য নিজ প্রাসাদে আশ্রয় দিয়ে আপন ভাবমূর্তিকে বহুগুণ উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন। তবে তিন বছর পর এই সেনাবাহিনীর হাতে ছাত্রদের ব্যাপক হত্যাকা- ঠেকাতে পারেননি। দেশের রাজনীতিতে অনেক উত্থান-পতন ঘটলেও রাজা ভূমিবলের অবস্থান কিন্তু এতটুকু পাল্টায়নি। তিনি ছিলেন পার্থিব রাজনীতির উর্ধে এক ঐশ্বরিক শক্তির মতো জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। চলমান ডেস্ক সূত্র : টাইম
×