ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুধে স্বনির্ভর করতে ঋণ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি, এখন লক্ষ্য অপুষ্টি দূর করা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৪ জানুয়ারি ২০১৬

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি, এখন লক্ষ্য অপুষ্টি দূর করা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমান সরকার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার মাধ্যমে সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। এখন আমাদের লক্ষ্য অপুষ্টি দূর করার মাধ্যমে সবার জন্য পুষ্টি নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য অর্জনে আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছি। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী একেকটা ধাপ শেষ করে আমরা পরবর্তী ধাপে পা দিচ্ছি। ডেইরি শিল্পের উন্নয়ন জোরদারের মাধ্যমে সবার জন্য পুষ্টি নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারের প্রচেষ্টায় সহযোগিতা দেয়ার জন্য বেসরকারী উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। বুধবার সকালে রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ মিলনায়তনে দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করে তোলার লক্ষ্যে ৫ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ কর্মসূচী উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাণিসম্পদ বিভাগ এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। স্বল্প সুদে পর্যায়ক্রমে দুগ্ধ খামারিদের ২শ’ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে কর্মসূচীর সুবিধাভোগী ১৩ জনের মাঝে ঋণের চেক বিতরণ করেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব মাকসুদুল হাসান খানের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেনÑ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক, প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান, ব্যাংক ও ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন সচিব ড. এম আসলাম আলম প্রমুখ। এছাড়া কর্মসূচীর ২ জন সুবিধাভোগী রংপুরের বদরগঞ্জের একজন এবং গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার একজন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জয় করা বিশাল সমুদ্রসীমাকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা যদি কাজ করে যাই তবে দেশের উন্নয়ন করতে পারবই। ইতোমধ্যে মাছের উৎপাদন বাড়িয়েছি, জয় করা বিশাল সমুদ্রসীমাকেও কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে, তা ধরে রাখতে হবে। বিশ্বে যে খাদ্য-ঘাটতি রয়েছে তার কিছু অংশ পূরণের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। দুধ দ্রুত নষ্ট হওয়া পণ্যগুলোর মধ্য অন্যতম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী দুগ্ধজাত পণ্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে নতুন পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি এসব পণ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ডেইরি শিল্প বিকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, দুধ উৎপাদনের পাশাপাশি আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য এই দুধ নিরাপদ কিনা সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ঝুঁকি, জীবাণু সংক্রমণ ও ক্ষতিকর উপাদানের ব্যাপারে দুগ্ধচাষীদের সচেতন করে তুলতে হবে। ব্যাপক শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দেশব্যাপী এক শ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় সরকারের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ অঞ্চলগুলোতে কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের জন্য নির্দিষ্ট স্থান থাকবে। এসব অর্থনেতিক অঞ্চলে যাতে কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠে, সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, ক্ষুদ্রচাষীরা দেশে দুধ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বড় আকারে ডেইরি ফার্ম গড়ে উঠেনি। তাই ক্ষুদ্র চাষীদের শ্রম কাজে লাগিয়ে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং প্রাণিসম্পদ প্রজাতি উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ প্রজাতির উন্নয়নে প্রধান কৌশল হচ্ছে কৃত্রিম গর্ভাধান পদ্ধতির প্রয়োগ। তবে কৃত্রিম গর্ভাধানে প্রধান বাধা হচ্ছে সঙ্কর প্রজাতির বাছুরের মৃত্যুহার বেশি। তিনি এই মৃত্যুহার হ্রাসের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার জন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগকে নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, হালাল মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। এ ধরনের মাংস রফতানির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ অনেক মুসলমানপ্রধান দেশ তাদের জনগণের জন্য বিপুল পরিমাণ হালাল মাংস আমদানি করে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের বিস্তীর্ণ চর ও পাহাড়ী এলাকায় গরুর পাশাপাশি মহিষ ও ভেড়া পালন করতে পারি। এছাড়া বিশ্বব্যাপী আমাদের ‘ব্লাকগোট’-এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তিনি বলেন, স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে চাকরি করার কারণে বাসার বাইরে খাবারের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এ ধরনের মাংসের গৃহস্থালি চাহিদা নিত্যদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুগ্ধ উৎপাদন বাড়াতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করে তিনি বলেন, গবেষণার মাধ্যমে উন্নতজাত উদ্ভাবনে বুলস্টেশন ও ল্যাবরেটরি স্থাপনে একটি নতুন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতি ও বাজেট সম্প্রসারিত হচ্ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে এবং শিল্পায়ন ও নগরায়নও দ্রুত হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, এমডিজির মূল লক্ষ্য হচ্ছেÑ দারিদ্র্য ও অপুষ্টি অর্ধেকে নামিয়ে আনা। তিনি বলেন, তার সরকার দুগ্ধ উৎপাদন বাড়াতে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া ও কৃত্রিম প্রজনন কর্মসূচী কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এ কর্মসূচী সফল করতে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এসেছে। শেখ হাসিনা বলেন, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের (এমডিজি) ছয়টির মধ্যে একটি অর্জন করার জন্য বাংলাদেশ পুরস্কার লাভ করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এসডিজি) নির্ধারণ করা হয়েছে এবং আমাদের এখন টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন বজায় রাখা ও অর্জনের জন্য এসডিজি’র ওপর মনোযোগ দিতে হবে। এছাড়া দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্য অর্জন করার জন্য আমাদের দেশকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত অন্যান্য পণ্যের বিপুল চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকার এফএও, ডানিডা ও ইউএনডিপিসহ অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতায় ‘মিল্কভিটা’ হিসেবে সুপরিচিত বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেছিল। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছেন এবং দেশের জনগণকে উন্নয়নের পথ দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বিরামহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছি। পাঁচ শতাংশ সুদে ২০১৬ সালে ঋণদান কর্মসূচীর সাফল্য কামনা করে শেখ হাসিনা বলেন, গাভী পালন ও দুধ উৎপাদনে প্রান্তিক চাষীদের আরও উৎসাহিত করতে হবে। তাহলেই দেশ দুধ উৎপাদনে স্বনির্ভর হবে। উল্লেখ্য, এ কর্মসূচীর অধীনে আগামী পাঁচ বছরে দুধ উৎপাদন ও কৃত্রিম গর্ভাধান প্রক্রিয়ায় কৃষকদের সহায়তা দিতে ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০ কোটি টাকার একটি পুনর্অর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। সর্বোচ্চ ৪টি বাছুর সংগ্রহ ও পালনের জন্য প্রত্যেক চাষী ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন। এ ধরনের অর্থায়ন ব্যবস্থা থেকে ঋণ লাভের ক্ষেত্রে মহিলা ও প্রান্তিক চাষীরা অগ্রাধিকার পাবেন। সুদসহ ঋণ পরিশোধের জন্য ঋণ গ্রহীতা ১৪ মাসের রেয়াতি সুবিধাসহ সর্বোচ্চ ৫৪ মাস সময় পাবেন। সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ হারে এই ঋণ লাভের সুযোগ দেবে ১৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এই ১৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের জন্য প্রযোজ্য হারে (বর্তমানে যা পাঁচ শতাংশ) বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ ধরনের পুনর্অর্থায়ন সুবিধা লাভ করবে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণ বা লোকসান বা ভর্তুকির জন্য অতিরিক্ত পাঁচ শতাংশ সুদ পাবে।
×