ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

সড়ক ও সেতু ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ বাড়াতে হবে

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১৩ জানুয়ারি ২০১৬

সড়ক ও সেতু ব্যবস্থাপনায়  মনোযোগ বাড়াতে হবে

বীচের রাস্তায় ট্যাক্সি থামতে না থামতে কোত্থেকে দুই পুলিশ হাজির। আচমকা থমকে যাই। আমরা কি কোন অপরাধ করেছি? না। বিনীতভাবে আমাদের নেমে যেতে বলে চালকের দু’পাশে দুজন দাঁড়ালে বুঝতে পারি গোলমাল কোথায়। চালক মদ খেয়ে ট্যাক্সি চালাচ্ছিল, তাই তার জরিমানা হচ্ছে। লাইসেন্স জব্দ করেছে। ঘটনা দু’হাজার বারোর। ভারতের কেরালা রাজ্যের ষষ্ঠ বৃহত্তম শহর আলেপ্পি। লেক, ক্যানেল, ঝর্ণা, লেগুন আর সমুদ্র সৈকতে সাজানো ছবির মতো সুন্দর এ শহরের টান উপেক্ষা করা কঠিন। রাজধানী ত্রিবান্দ্রাম থেকে এক শ’ পঞ্চান্ন কিলোমিটার উত্তরের এ শহরকে লর্ড কার্জন আখ্যায়িত করেছিলেন ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ নামে। দু’হাজার বারোর জানুয়ারির কোন এক বিকেলে আরব সাগরের আলেপ্পুজা বীচে এ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এর বর্ধিত সংস্ককরণ হয়েছিল আলেপ্পি থেকে ত্রিবান্দ্রাম ফেরার পথে। এবারের ট্যাক্সিচালক পড়েছিল হাইওয়ে পুলিশের খপ্পরে। গতিসীমা সর্বোচ্চ সাতষট্টি কিলোমিটার পেরোতেই বিপত্তি বাধে। আমরা জানতাম না কিন্তু চালক জেনেও আইন অমান্য করার শাস্তি পেল হাতেনাতে হাইওয়ে পুলিশের কাছে নগদ চার শ’ টাকা জরিমানা দিয়ে। মুখ কালো করে এসে স্টিয়ারিং ধরল। মাঝখান থেকে প্রায় তিরিশ মিনিট নষ্ট। এ সময়ে চালকের গতিসীমা মেনে না চলার কারণ অনুসন্ধান চলছিল। প্রথমেই দেখছিল মদ খেয়েছে কিনা। তারপর কাগজপত্র পরীক্ষা। শেষে গাড়ির নম্বর ও মডেলের ছবিসহ কেন জরিমানা করা হলো তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনার রঙ্গিন কম্পিউটার প্রিন্ট ধরিয়ে দিল ঘটনাস্থলেই। সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে পুলিশ। স্পিডোমিটার ক্যামেরা, কম্পিউটার, প্রিন্টার, স্ক্যানার, মদখাওয়া পরীক্ষা করার যন্ত্র ইত্যাদিতে সজ্জিত তাদের গাড়ি। সাতষট্টির জায়গায় পঁচাত্তরে চালাচ্ছিল তারই শাস্তি পেতে হলো চালককে। পুলিশের গাড়ির স্পিডোমিটার এবং ক্যামেরা সব গাড়ির দিকে নজর রাখছে। আমাদের বাংলাদেশের চালকদের এমন ফাঁকা রাস্তায় ছাড়লে কেমন হতো? উল্টোপাল্টা চালিয়ে দুয়েকবার আইনের ঘা খেয়ে ওরাও ঠিক হতো নিশ্চয়ই। আইনের কঠোর প্রয়োগ সব ধরনের অনিয়ম রুখতে পারে। এ জন্য আইনের শাসন নিশ্চিত হওয়া জরুরী। নয় জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সেতুতে সিরিজ দুর্ঘটনার খবরে বার বার আলেপ্পির ওই দুই চালক ও ট্রাফিক পুলিশের কথা মনে পড়ছিল। আমাদের দেশে কি এমন ব্যবস্থা করা যায় না? যে কোন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যু যেন অবধারিত। কুয়াশা পড়েছে তাতেও দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাল চার ঘণ্টার ব্যবধানে সাত জন। শীতে কুয়াশা পড়বে জানা কথা। সে জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকা উচিত ছিল। অথচ সেতুর দু’পাশে সোডিয়াম লাইটও নষ্ট ছিল। দুর্ঘটনা হলে চালকের অদক্ষতার দিকেই সবার ইঙ্গিত থাকে। এবং তার ঘাড়ে দায় চাপানোয় অন্য জরুরী বিষয়গুলো আড়ালেই থেকে যায়। এখন সেতু এবং সড়ক ব্যবস্থাপনার দিকেও মনোযোগ বাড়ানোর সময় এসেছে। একথা ঠিক, বেশিরভাগ দুর্ঘটনা চালকের অদক্ষতার জন্যই হয়। কিন্তু অদক্ষ চালক স্টিয়ারিং ধরছে কেন? তাদের পেশাগত সঠিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না কেন? বছর তিনেক আগের এক জরিপে জানা যায়, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) বৈধ ছাড়পত্র নিয়ে সারাদেশে গাড়ি চালাচ্ছে নয় লাখ ষাট হাজার চালক। আর বৈধ ছাড়পত্রে গাড়ি চলছে চৌদ্দ লাখের বেশি। সরকারী হিসাবে অবৈধ চালক পাঁচ লাখের কাছাকাছি। বেসরকারী হিসাবে সংখ্যা আরও বেশি হবে নিঃসন্দেহে। বৈধ ছাড়পত্রহীন এসব চালকের একমাত্র ভরসা ‘ওস্তাদ’-এর কাছে শেখা বিদ্যা। আর এদের হাতে জীবন সঁপে আমরা রাস্তায় চলছি। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটছে ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা। দু’হাজার এগারোয় মীরসরাই ট্র্যাজেডি সড়ক পরিবহনের দুরবস্থা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। চুয়াল্লিশ স্কুলছাত্রের মৃত্যুতে আলোড়িত হয়েছিল দেশ। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশে মীরসরাই ট্র্যাজেডির খলনায়ক ট্রাকচালক মফিজ গ্রেফতার হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু শাস্তি নিশ্চিত হয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি। যদি হয়েও থাকে তাহলে বেঘোরে এত প্রাণ নষ্ট করার জন্য তার শাস্তি হয়েছে বড়জোর সর্বোচ্চ তিন বছরের জেল ও দশ হাজার টাকা জরিমানা। বেশিরভাগ দুর্ঘটনায় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চালক জামিন পায়। সড়ক দুর্ঘটনাসংক্রান্ত আইনেই এ সুযোগ রয়েছে। এ আইন পাস হয়েছিল ১৮৬০ সালে। এতে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল সাত বছরের কারাদ-। ১৯৮৫ সালে এক অধ্যাদেশে তা প্রথমে পাঁচ এবং পরে তিন বছর করা হয়। একজন মারা গেলে চালকের যে শাস্তি এক শ’ জন মারা গেলেও তাই। এরশাদ সরকারের সময় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- ও জামিন অযোগ্য ধারা যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু চালকদের আন্দোলনের মুখে কয়েক মাসের মধ্যে শাস্তির ধারা বাতিল করে পুরনো ধারায় ফিরে যায়। সড়ক দুর্ঘটনারোধে যে আইন রয়েছে তাকে চালকরা গুরুত্ব দেয় না। তারা জানে, দুর্ঘটনা করলেও তাদের বেশি শাস্তি হবে না। ১৯৯২ সালে সাবেক এক মন্ত্রীর ছেলে রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়। নিজের ছেলেকে বাঁচাতে ওই মন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় চালকদের শাস্তি কমানোর বিল উত্থাপন করেন এবং সংসদে বিল পাস হয়। দু’শ’ ঊনআশি ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর করা হয়। ব্রিটিশ আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল দশ বছর সশ্রম কারাদ- ও জামিন অযোগ্য অপরাধ। এরশাদ সরকার এ শাস্তি বাড়িয়ে চৌদ্দ বছর করে। তখন পরিবহন শ্রমিকরা আন্দোলন করে শাস্তি পাঁচ বছরে নামায়। মন্ত্রীর ছেলের ঘটনা এর পরের। আগের আইনটি কেন ফিরিয়ে আনা হবে নাÑ তা জানতে চেয়ে উচ্চ আদালত থেকে একটি রুলও জারি হয়েছিল। কিন্তু শুধু আইন করেই কি দুর্ঘটনা বন্ধ করা যাবে? ব্রিটিশ আমলের আইনে গাড়ি চালানো অবস্থায় ইয়ার ফোন চালানো নিষেধ ছিল। সমসাময়িক বাস্তবতা বিবেচনা করে বিআরটিএ আইনের ধারা সংশোধন করে ইয়ার ফোনের সঙ্গে মোবাইল ফোন ব্যবহারও নিষিদ্ধ করেছিল। অমান্য করার শাস্তি এক মাসের কারাদ- অথবা পাঁচ শ’ টাকা জরিমানা অথবা দুই-ই। কিন্তু কে শুনছে কার কথা? গাড়ি চালাতে চালাতে সেলফোনে কথা বলা এখন পরিচিত দৃশ্য। মীরসরাইয়ের দুর্ঘটনা হয়েছিল ফোনে কথা বলতে বলতেই। দৈনিক জনকণ্ঠের মানবসম্পদ বিভাগের সোহেলী আক্তার শম্পা ও তার স্বামীকে চাপা দেয়া বাসের চালকও সেলফোনে কথা বলতে বলতে দুর্ঘটনা ঘটায়। এসব দুর্ঘটনায় শুধু পরিবার নয়, চূড়ান্ত অর্থে ক্ষতি দেশেরই। গত দশ-বারো বছরে যানবাহন বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। ১৯৯৫ সালে দেশে যানবাহন ছিল তিন লাখ পঁয়ষট্টি হাজার। ২০০৯ সালে তা বারো লাখ সত্তর হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে শতকরা আশি ভাগ গাড়ির ফিটনেস নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর আর্থিক ক্ষতি হয় বছরে সাত হাজার কোটি টাকার বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। ২০০৬ সালে পরিচালিত এদের আরেকটি প্রতিবেদনে ক্ষতির পরিমাণ পাওয়া গিয়েছিল এক শ’ ছিয়াত্তর কোটি টাকার। বেশিরভাগ দুর্ঘটনার মামলা হলেও ঠিকমতো তদন্ত হয় না। দুর্ঘটনার পর চালককে শনাক্ত করতে পারে না পুলিশ। করলেও অনেক সময়ই নেপথ্য কারণে ঘটনা চেপে যান তদন্ত কর্মকর্তারা। ঝামেলা এড়াতে সাধারণত নিহতের পরিবার পুলিশের কাছে যায় না। মামলা করলেও তার খোঁজ রাখে না। তদন্তকারী কর্মকর্তারাও ছয় মাস-এক বছর ফাইলবন্দী রেখে মামলা তামাদি করে দেন। কখনও কখনও অজ্ঞাত আসামি এবং চালককে দায়ী করে এবং চালকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেয়। কিন্তু তাতেও নানা রকম অসঙ্গতি ও দুর্বলতা থাকে। ফলে বিচারিক আদালতে আসামি সহজে পার পায়। সড়ক দুর্ঘটনা আইনেই গলদ থাকায় চালক বা আসামির তেমন কিছু হয় না। দুর্ঘটনাসংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) এর এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় বারো হাজার মানুষ মারা যায়। দুই-তৃতীয়াংশ দুর্ঘটনা হয় বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে। নিহতদের শতকরা আশি ভাগের বয়স পাঁচ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে। তিপ্পান্ন ভাগ পথচারী, যাদের মধ্যে শতকরা একুশ ভাগের বয়স ষোলো বছরের নিচে। শতকরা পঞ্চাশ ভাগ মারা যায় দুর্ঘটনার পনেরো মিনিটের মধ্যে। মস্তিষ্ক বা হৃদযন্ত্রে বড় ধরনের আঘাত ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে এসব মৃত্যুর মূল কারণ। পঁয়ত্রিশ ভাগ মারা যায় এক থেকে দু’ঘণ্টার মধ্যে। সাধারণত মাথা ও বুকে আঘাতে এ মৃত্যু হয়। বাকি পনেরো ভাগ মারা যায় দুর্ঘটনার এক মাসের মধ্যে। বিশেষ কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হওয়ায় এরা মারা যায়। এআরআইয়ের তথ্য মতে, সারাবিশ্বে প্রতিবছর প্রায় বারো লাখের মতো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এর শতকরা নব্বই ভাগই হয় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে। মোট দুর্ঘটনার অর্ধেকের শিকার এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো। দুর্ঘটনার শিকার মানুষের চিকিৎসার জন্য এসব দেশে জাতীয় প্রবৃদ্ধির শতকরা এক থেকে পাঁচ ভাগ খরচ করতে হয়। সরকারীভাবে বছরে প্রায় চার হাজার দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান থাকলেও আসল সংখ্যা তার চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি। দুর্ঘটনার জন্য বছরে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি গুনতে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশিক্ষিত চালকের অভাব, পথচারীর অসতর্কতা, ফিটনেস ঠিক না থাকা, অতিরিক্ত গতি, সড়ক নির্মাণে ত্রুটি, অতিরিক্ত গাড়ি, ত্রুটিপূর্ণ সেতু এবং অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের কারণেই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া জাতীয় স্থল পরিবহন ও মহাসড়ক বিধিমালা ২০০১সহ বিভিন্ন নীতিমালার বাস্তবায়ন না হওয়া, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের অকার্যকর অবস্থা, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও সামাজিক আন্দোলন জোরদার না হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ সবগুলো বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সমাধানের পথে এগুতে হবে।
×