ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিমান ছিল লাশ- আমরা প্রাণের সঞ্চার করেছি

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৩ জানুয়ারি ২০১৬

বিমান ছিল লাশ- আমরা প্রাণের সঞ্চার করেছি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিমান ছিল লাশ। আমরা ক্ষমতায় এসে সেই লাশে প্রাণের সঞ্চার করেছি। বিমানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে এভাবেই মূল্যায়ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বিমান এখন লাভ করছে। আরও লাভ করতে হবে। সে জন্য সেবা ও নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে আধুনিক ও শক্তিশালী করে বিশ্বব্যাপী এর মর্যাদা ছড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বিমান আজ জাতীয় গর্বের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে বিমান যাচ্ছে, আরও নতুন নতুন গন্তব্যে যাবে। এভাবেই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স আরও শক্তিশালী হবে। কারণ বাংলাদেশের মানুষ নিজস্ব ক্যারিয়ারে দেশে আসতে চায়, তাদের সেই সুযোগ করে দেয়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দায়িত্ব। মঙ্গলবার দুপুরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিভিআইপি লাউঞ্জে ‘মেঘদূত’ ও ‘ময়ূরপঙ্খী’ নামে দুটি বোয়িং উড়োজাহাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি আবেগাপ্লুত বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, এটা বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া একটা প্রতিষ্ঠান। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ একটি ভাড়া করা উড়োজাহাজ দিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের লন্ডন-ঢাকা ফ্লাইট শুরু হয়। ৭ মার্চ সিলেট ও চট্টগ্রামে যাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হয় অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা। তিনি বলেন, অনেক কঠিন সময় পেরিয়ে বিমান আজ এই জায়গায় এসেছে। আর মাঝে বিএনপি জামায়াত জোট বিমানকে লাশে পরিণত করেছিল। আমরা আবারও ক্ষমতায় এসে সেই লাশকে জীবিত করেছি। তিনি বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ এমন একটি স্থানে যা পূর্ব-পশ্চিমে সেতু গড়তে পারে। পাশ্চাত্য-প্রাচ্যের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করার সব সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে আমরা সে পথেই এগিয়ে যাচ্ছি। ১৯৯৬ সালের আগে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বেহাল দশার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে কথা ও চিত্র সবারই মনে আছে। এখন বিমানবন্দর, রানওয়ের মান উন্নত হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট আন্তর্জাতিক বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতেও বিমান তার ফ্লাইট পরিচালনা করে সচল করে তুলেছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে একটি আঞ্চলিক বন্দরে পরিণত করার সম্ভাবনা ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আশা করি এই বিমান বন্দরটিকে আমরা আরও উন্নত করে গড়ে তুলতে পারব। তাতে ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে ফ্লাইট পরিচালনা সহজ হবে। আর তার মধ্য দিয়েই এর বাণিজ্যিক গুরুত্ব বাড়বে। নতুন বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মেঘদূত ও ময়ূরপঙ্খীর প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অভ্যন্তরীণ রুটগুলোর পাশাপাশি আঞ্চলিক রুটগুলোতেও এই ফ্লাইট পরিচালনা করা যাবে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে এখন নিজস্ব যাত্রীবাহী ফ্লাইট পরিচালনার পাশাপাশি কার্গো বিমান পরিচালনার উদ্যোগ নেয়ার ওপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের রফতানিকারকরা বিদেশ থেকে কার্গো ভাড়া করে তাতে রফতানিপণ্য পাঠাচ্ছেন, এতে খরচ বেশি পড়ছে। বিমান কার্গো চালু করলে তাদের অনেক সুবিধা হবে আর বিমানও লাভবান হবে। তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা, স্ক্যানিংয়ের সঠিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বিমানকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বিমান শুধু আপনাদের জীবন-জীবিকার পথই নয় একটি জাতীয় প্রতীক, যা দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে। বিমান আপনাদেরই প্রতিষ্ঠান। সুনাম কুড়ালে তা আপনাদের গর্বের হবে, না হলে তা হবে লজ্জার। আমরা কষ্ট করে সব ঠিক করে দিচ্ছি, এগুলো রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের। বিমানের যে উন্নয়ন হয়েছে তার ধারাবাহিকতা যেন টিকে থাকে।’ এ সময় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, বিমানবন্দরে নেমে যাত্রীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, এটা যাতে না হয় সেদিকটা লক্ষ্য রাখতে হবে। এ সময় চারদলীয় জোট সরকারের সময় বিমানে নিউইয়র্ক, ব্রাসেলস, প্যারিস, ফ্রাঙ্কফুর্ট, মুম্বাই, নারিতা এবং ইয়াংগুন ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন। ২০০৯ সালে আবারও ক্ষমতায় এসে রাজধানীর সঙ্গে সাত জেলার অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালু করে আওয়ামী লীগ। অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট বাড়ানোর জন্য মিসর থেকে দুইটি ড্যাশ উড়োজাহাজ ভাড়া আনা হয়। চালু হয় ঢাকা-দিল্লী, ঢাকা-ইয়াংগুন ও ঢাকা-হংকং রুটে ফ্লাইট। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী নিজেই নতুন এই উড়োজাহাজ দুটির নামকরণ করেছেন ‘মেঘদূত’ ও ‘ময়ূরপঙ্খী’। এর আগে গত কয়েক বছরে বিমানের বহরে যুক্ত হয় বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ ‘পালকি’, ‘অরুণ আলো’, ‘আকাশ প্রদীপ’ ও ‘রাঙাপ্রভাত। সব মিলিয়ে বিমানের নিজস্ব অর্থে কেনা সুপরিসর বোয়িং উড়োজাহাজের বিমানের সংখ্যা এখন ছয়টি। ২০১৮ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে চারটি বোয়িং ৭৮৭ ‘ড্রিমলাইনার’ বিমান বহরে যুক্ত হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, বিমানের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব) জামালউদ্দিন আহমেদ, বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী, বিমানের সিইও উইং কমান্ডার আসাদ্জ্জুামান, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্স ডেভিড মিলি ও বোয়িংয়ের প্রতিনিধি সবিতা গৌড়। মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, বিমান আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সত্যিকার অর্থেই আজ জাতীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ২০১৬ সাল পর্যটন বছর হিসেবে ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বছর বিমানের মাধ্যমে দেশে আরও বেশি পর্যটক আসবে। বিমান যে পথে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো তার চিত্র তুলে ধরে চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব) জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, গত অর্থবছরে বিমান ২৭২ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। বিমান কর্মীরা তাদের দক্ষতা দেখিয়ে এই অর্জন নিশ্চিত করেছেন। বিমানকে একটি ‘ভালো পে মাস্টার’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাওনা পরিশোধ করে ধীরে ধীরে বিমান একটি শক্ত অবস্থানে এগিয়ে যাচ্ছে। মোট ১০টি বোয়িং কেনা বাবদ বিমানকে পরিশোধ করতে হয়েছে সোয়া ২ বিলিয়ন ডলার। এরই মধ্যে বিমান নিজস্ব তহবিল থেকে এই টাকার মধ্যে ৭০৮২ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। তিনি বলেন, আগামী এপ্রিল থেকে কলম্বো, মালে এবং চীনের ক্যান্টনে বিমানের ফ্লাইট চালু করবে বিমান। খোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, গুণগত মান বিচারে বিমান এখন তার ইতিহাসের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময় পার করছে। বিমানের সিইও উইং কমান্ডার আসাদুজ্জামান যাত্রীসেবার মান উন্নয়নে কর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টা চলছে বলে উল্লেখ করেন এবং বিমান এগিয়ে যাবে এমন প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্স ডেভিড মিলি বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ক্রমশই আধুনিকতর ফ্লাইট ক্যারিয়ারে পরিণত হচ্ছে, আর তা একটি আধুনিক বাংলাদেশেরই পরিচয়। বোয়িংয়ের প্রতিনিধি সবিতা গৌড় তার বক্তৃতায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বোয়িংয়ের মধ্যে দীর্ঘ ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন, আশা করি এই সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সবিতা আগামী ২০১৮ সালেই এ প্রজন্মের সবচেয়ে বিস্ময়কর ও আকর্ষণীয় মডেল বোয়িংয়ের ২টি ড্রিমলাইনার ৭৮৭ বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
×