ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মু. আবদুল্লাহ আলআমিন

যেভাবে নিখোঁজ হলো মালয়েশিয়ার প্লেনটি

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ২০ নভেম্বর ২০১৫

যেভাবে নিখোঁজ হলো মালয়েশিয়ার প্লেনটি

মাঝ আকাশে হারিয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং ৭৭৭ (ফ্লাইট এমএইচ৩৭০) এর ভাগ্যে কি ঘটেছিল সে সম্পর্কে বিমান উড্ডয়ন বিশেষজ্ঞরা নতুন তত্ত্ব হাজির করেছেন। ২০১৪ সালের ৮ মার্চ ভোররাতে প্লেনটি কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিংয়ের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু মালাক্কা প্রণালী পার হওয়ার পরপরই এটি ২৩৯ জন আরোহীকে নিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। মালয়েশিয়ার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল জানিয়েছিল, কোটাবারু উপকূল থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে ভিয়েতনামের আকাশসীমা থাকা অবস্থায় প্লেনটির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। প্লেনটি এ সময় ৩৫ হাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়ছিল। এর ফলশ্রুতিতে পরিচালিত হয় বিমান উড্ডয়নের ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্তৃত ও ব্যয়বহুল অনুসন্ধান অভিযান। দক্ষিণ চীন ও ভারত মহাসাগরের ৬০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গায় ১০টি প্লেন এবং ১৪টি জাহাজ নিয়ে ২৬টি দেশের অনুসন্ধানকারীরা রাতদিন চষে বেড়ান। এতে ব্যয় হয় কোটি কোটি ডলার। এসব কিছুর পরও প্লেন বা এর ধ্বংসাবশেষের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ব্যাপক অনুসন্ধানের পর মোটামোটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, প্লেনটি দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের কোথাও বিধ্বস্ত হয়েছে। মালয়েশিয়া উপত্যকা থেকে কেন প্লেনটি ঘুড়ে গিয়ে উল্টোদিকে ঘুরে গেল তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানকারীরা মনে করেন ইচ্ছাকৃত প্লেনের রুট পরিবর্তন করা হয়েছিল এবং এটি করার আগে প্লেনের বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে নেয়া হয়েছিল। মালয়েশিয়ার কর্র্র্র্র্র্র্তৃপক্ষও নিখোঁজদের আত্মীয়-স্বজনদের যথেষ্ট তথ্য দিতে পারেনি। ফলে দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে নানারকম গুজব ডালপালা ছাড়ানোর সুযোগ পায়। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকও স্বীকার করেছেন দুর্ঘটনার পর পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে তারা কিছু ভুল করেছিলেন। ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর এ বছর ৩০ জুলাই মাদাগাস্কারের নিকট ফরাসী মালিকানাধীন পশ্চিম ভারতীয় রিইউনিয়ন দ্বীপের কাছে প্লেনটির একটি ডানার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। ফ্লান্সের বিশেষজ্ঞরা তদন্ত করে নিশ্চিত হন যে, এটি হারিয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭ এরই অংশ। প্রশ্ন হলো, প্লেনটি কেন নির্ধারিত পথে না যেয়ে উল্টোদিকে গিয়ে বিধ্বস্ত হলো তার কোন কারণ এখনও জানা যায়নি। মার্কিন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও নিউজউইক ডেইলি বিস্ট পত্রিকার কনসাল্টিং এডিটর ক্লিভ ইরভিং বলেছেন, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি থেকে আগুন ধরে গিয়ে প্লেনটি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকতে পারে। মার্কিন ফেডারেল এভিয়েশন এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) এবং উড়োজাহাজ নির্মাতা সংস্থা বোয়িংয়ের প্লেনে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি বহনের ওপর সতর্কতা জারির কথা উল্লেখ করে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন। মোবাইল ফোন, ডিজিটাল ক্যামেরা ও ল্যাপটপে এই ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। জানা গেছে, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এমএইচ৩৭০এ ৪৪০ পাউন্ড লিথিয়াম ব্যাটারির একটি চালান বহন করা হচ্ছিল। ইরভিংয়ের তত্ত্বানুসারে, প্লেনের ফায়ার সাপ্রেশন সিস্টেমকে পাশ কাটিয়ে লিথিয়াম ব্যাটারিতে আগুন ধরে যায়। ব্যাটারির স্তূপটি রাখা ছিল মাল পরিবহন অংশের বাম দিকে। তার ঠিক পাশে প্লেনে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান কেন্দ্র। ব্যাটারিতে আগুন ধরে যাওয়ার অল্পসময়ের মধ্যে সেটি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। উড্ডয়নের পরপরই ককপিটে পাইলট বিপদ আঁচ করতে পেরেছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন নিকটবর্তী কোন এয়ারপোর্টে অবতরণ করানো যায় কিনা। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা কাজ না করায় প্লোনটিকে বাম পাশে ঘুরিয়ে প্রায় বিপরীতদিকে আনা গেলেও কোথাও অবতরণ করানো সম্ভব হয়নি। ইরভিং মনে করেন, প্লেনটি ভারত মহাসাগর অভিমুখে অন্তত কয়েক ঘণ্টা আকাশে ছিল। তার মতে, ট্র্যান্সপন্ডার নামে পরিচিত প্লেনে যোগযোগ যন্ত্র কাজ না করলেও আগুনের প্রভাবে ইঞ্জিনের কোন ক্ষতি হয়নি। যে কারণে এটি দক্ষিণ ভারত মহাসাগর পর্যন্ত পৌঁছে বিধ্বস্ত হয়। কার্গোতে অগ্নিকা- প্রতিরোধের অতিরিক্ত কিছু বিশেষ ব্যবস্থা থাকে যেটা যাত্রীবাহী প্লেনে থাকে না। লিথিয়াম ব্যাটারি বিশেষজ্ঞ কানাডার ভিক্টর ইটেল বলেছেন, এসব ব্যাটারিতে আগুন ধরার পর প্লেনের ফায়ার সাপ্রেশন সিস্টেম ঠিকমতো কাজ করতে না পারলে আগুন থেকে ছড়িয়ে বিষাক্ত ধোঁয়ায় আরোহীদের মৃত্যু ঘটতে পারে। কারণ এতে আছে ফ্লোরিন ও আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত যৌগ উপাদান। তবে নিখোঁজ সেই প্লেন ভারত মহাসাগরে নয় দক্ষিণ চীন সাগর পৃষ্ঠে আলতোভাবে অবতরণের পর পুরো কাঠামোটি সাগরের মধ্যে একসঙ্গে তলিয়ে গেছে, মালয়েশিয়ার স্যাটেলাইট বিশেষজ্ঞ জাইম রেজা আবদুল রহমানের বক্তব্য উদ্ধৃতি দেশটির সরকারী গণমাধ্যমে সম্প্রতি একটি বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে। ভারত মহাসাগরের ওপর অবস্থানরত ব্রিটিশ যোগাযোগ উপগ্রহ ইমারস্যাট ছিল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর প্লেনটির অবস্থান নির্ণয়ে একমাত্র যোগসূত্র। উপগ্রহ থেকে পাওয়া উপাত্ত বিশ্লেষণকারীদের মধ্যে জাইমও ছিলেন। আমেরিকার ন্যাশনাল ট্র্যান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের সাবেক তদন্তকারী গ্রেগ ফেইথও তাই মনে করেন। ব্লুমবার্গ পত্রিকাকে তিনি বলেছেন, উদ্ধার হওয়া ডানার টুকরোটি দেখলে মনে হয় প্লেনটি মাঝ আকাশে বিস্ফোরিত হয়ে পানিতে ডুবে যায়নি। খুব কাছ থেকে এর পানিতে নিমজ্জনের সম্ভাবনাই বেশি। ফ্লাইট এমএইচ৩৭০ এর শেষ পরিণতি কি হয়েছিল সেটি জানা গেলেও কেন এমনটি হলো তা নিয়ে বিতর্ক যে সহসাই কাটছে না বিশেষজ্ঞদের অভিমতগুলো থেকে তা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়।
×