ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যেই শ্যামল বাহিনী তিন সপ্তাহ আগে কাস্টমস কর্মীদের মারধর করে ৫ কোটি টাকার পণ্য লুট করে

ধরা পড়েছে বিমানবন্দর কার্গো হাউসের পণ্য লুটের নায়ক শ্যামল

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ধরা পড়েছে বিমানবন্দর কার্গো হাউসের পণ্য লুটের নায়ক শ্যামল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কয়েক গজ দূরে র‌্যাব সদর দফতর। থানাও একই ভবনে। বাইরে ছিল গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। ছিল আর্মড ব্যাটালিয়ন পুলিশ ও আনসার। আরও ছিল বিমান ও কাস্টমসের নিজস্ব নিরাপত্তা সদস্য। এমন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝেই দিনদুপুরে শ্যামল বাহিনী হানা দিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদের মারধর করে ছিনিয়ে নিয়ে যায় ৫০ কোটি টাকার মালামাল। কয়েকটি কার্টনে রাখা এসব মাল নিয়ে পালানোর সময়েও কেউ বাধা দেয়নি। গত ১০ আগস্ট সোমবার দুপুরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে এমন দুর্ধর্ষ মাল ছিনতাইয়ের ঘটনার মূল নায়ক শ্যামল বাহিনীর প্রধান বদরুল আলম শ্যামল শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছে। বুধবার র‌্যাব-১ কার্যালয়ে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে যখন শ্যামল, তার ছোই ভাই ফখরুল আলম পাপন ও ক্যাডার আসিফুজ্জামান পাপনকে হাজির করা হয় তখন ঘুরে ফিরে এমনই সব প্রশ্ন উঠে আসে। এমন সংরক্ষিত কার্গো হাউসে কি করে সম্ভব এমন অপরাধ করা? জনকণ্ঠের এমন প্রশের জবাবে র‌্যাব-১ অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মাহমুদ বলেছেন, ঘটনা ঘটে যাবার খবর পেয়ে পরে র‌্যাব হাজির হয়েছে। সেখানে তো র‌্যাবের গোয়েন্দা মোতায়েন ছিলÑ তারা কেন খবর দেয়নি, র‌্যাব স্ট্র্রাইকিং ফোর্স পাঠিয়ে তো ঘটনার পরেও দুর্বৃত্তদের ধরতে পারত এমন সব প্রশ্নের কোন সন্তোষজনক জবাব মেলেনি। ঘটনার শেষ এখানেই নয়। তিন সপ্তাহ আগে কমান্ডো স্টাইলে হামলা চালিয়ে মাল ছিনিয়ে নেয়ার পরও বিমানবন্দর থানার পুলিশ তাকে আটক করেনি। লুণ্ঠিত ৫০ কোটি টাকার মালও উদ্ধার করা হয়নি। বরং তার প্রতিদ্বন্দ্বী অপর এক ব্যবসায়ী জসিম তপাদারকে আটক করে পুলিশ শ্যামলকে খুশি করার নীতি গ্রহণ করে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে থানায় একটি নিয়মিত মামলা দায়ের করলেও পুলিশ বদরুলকে না ধরে তার কয়েক চুনোপুঁটি সহযোগীকে আটক করে। অথচ ঘটনার পর থেকেই বদরুল ওই রাজধানীতেই প্রকাশ্যে ঘুরেছে, পুলিশ থানা কাস্টমস ও মিডিয়া ম্যানেজ করার জন্য যুবলীগের কয়েক প্রভাবশালী নেতার কাছে গিয়ে তদ্বির করেছে। কারণ হঠাৎ যুবদল ত্যাগ করে শুধু টাকার জোরে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিজের অবস্থান করতে সক্ষম হওয়া বদরুলকে ধরার কোন উদ্যোগ পুলিশেরও ছিল না। তবে এ ঘটনায় মিডিয়াতে তোলপাড় হওয়ায় র‌্যাবও তাকে আটকে তৎপর হয়। শেষ পর্যন্ত র‌্যাব গত মঙ্গলবার রাতে শ্যামল, তার ভাই প্রিন্স ও ক্যাডার পাপনকে আটক করে। বুধবার দুপুরে র‌্যাব সংবাদ সম্মেলন করে তেমনটিই দাবি করে। এ সময় র‌্যাব সে দিনের সে অবিশ্বাস্য হামলা ও মালামাল লুটের পুরো চিত্র করা একটি ফুটেজও প্রচার করে। তাতে দেখা যায়- বেলা আড়াইটার দিকে কার্গো হাউসে হঠাৎ ঢুকে পড়ে বদরুল আলম শ্যামল, তার সহোদর ফখরে আলম প্রিন্স ও পাপনসহ ২০/২৫ জনের একটি বাহিনী। তারা এয়ারপোর্ট এলাকায় শ্যামল বাহিনী হিসেবেই পরিচিত। ভেতরে ঢুকেই তারা তা-বলীলা চালায়। শ্যামল বাহিনীর সদস্যরা দলবল নিয়ে কাস্টমস হাউস ঢাকার কার্গোর কুরিয়ার ইউনিটের ১৫টি কার্টন ভর্তি পণ্যের মালামাল বিল অব এ্যান্ট্রি না দিয়ে এবং মালামাল পরিদর্শন না করিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়। কুরিয়ার ইউনিটের কর্তব্যরত রাজস্ব কর্মকর্তাগণ শ্যামল ও তার দলবলকে মালামাল না নিতে অনুরোধ জানান এবং গেটের তালা লাগিয়ে দেন। তখন শ্যামল ও তার সহযোগীগণ তালার চাবি ছিনিয়ে নেয়। গেট খুলে ১২ কার্টন মালামাল জোরপূর্বক বের করে নিয়ে যায়। তারা এ সময় কাস্টমস কর্মকর্তাদের হুমকি প্রদর্শন এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। তাৎক্ষণিক দুষ্কৃতকারীদের মধ্যে শ্যামল, প্রিন্স, শহিদুর, আসাদ, হাদীস, ইয়াসিন, সুমন ও মোঃ আলমকে কাস্টমস কর্মকর্তারা চিহ্নিত করেন। তাদের ফেলে যাওয়া অবশিষ্ট ৩টি কার্টনে প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের ক্যামেরা, মোবাইল ও অন্যান্য মালামাল ছিল। তারা প্রকাশ্য দিবালোকে গাড়িতে করে মাল নিয়ে গেলেও কেউ প্রতিরোধ করেনি। অথচ সামনের প্রতিটি পয়েন্টেই টহলরত ছিল এপিবিএন সদস্যরা। তারা নির্বিঘেœ কোন প্রকার বাধা ছাড়াই চলে যেতে সক্ষম হয়। অথচ বিমানবন্দর থানা পুলিশ ও গোয়েন্দাদের তালিকায় শ্যামল চোরাচালানের দুর্ধর্ষ গডফাদার। তার বাহিনীর সবাই কুরিয়ার ও সিএনএফ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। শ্যামলের এসএমআই নামের একটি কুরিয়ার সার্ভিস রয়েছে। এই সূত্র ধরেই কুরিয়ার ও কার্গোর মতো সংরক্ষিত এলাকায় তার অবাধ যাতায়াত। শ্যামল ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে এ রকম লুটতরাজের অভিযোগ অসংখ্য। এ বাহিনীর অস্ত্রধারী ক্যাডাররা এর আগে ওই কার্গোতেই চালান আটক করায় এক সহকারী কমিশনারের ওপর হামলা চালায়। এ ছাড়া গত ২৮ জুলাই ঢাকা কাস্টম হাউসে ঢুকে এক সহকারী কমিশনার এর হাত কেটে ফেলার হুমকি দেয় শ্যামল। পুলিশ জানায়, যুবদলের এক সময়ের ক্যাডার শ্যামল বছরখানেক আগেও তাকে গ্রেফতার করে বিমানবন্দর থানার পুলিশ। পরে জেল থেকে বের হওয়ার পরই হঠাৎ বিমানবন্দর ও উত্তরা এলাকায় তার পোস্টারে ছেয়ে যায়। পোস্টারে দেখা যায়, সে আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাকে ঠাঁই দেয়ায় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, যুবলীগে যোগদানের পরই শ্যামল বিমানবন্দর এলাকায় ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। সে গোটা বিমানবন্দর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এমনকি সে নিজের ক্ষমতাবলে তৎকালীন ওসি শাহ আলমকেও বদলি করার জন্য মরিয়া ওঠে। কয়েকদিনের মধ্যেই ওসি শাহ আলম বদলি হয়ে যান। এরপর বিমানবন্দর থানায় যোগ দেন বর্তমান ওসি কামাল উদ্দিন। এ সময় শ্যামল প্রচার করতে থাকে, বর্তমান ওসিকে আমিই এনেছি। তিনি আমার এলাকারও। আমার মতোই চলবে। এ সম্পর্কে তৎকালীন ওসি শাহ আলম জনকণ্ঠকে জানান- শ্যামল কতটা প্রভাবশালী তা তো সে দেখিয়েছে, এমন ঘটনার পরও পুলিশ তাকে আটক করেনি।
×