ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কামাল লোহানী

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ নূরজাহান আপা স্মরণে

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ নূরজাহান আপা স্মরণে

মহীয়সী সাহসী নারী নূরজাহান মুরশিদের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র দেখে যে কথাগুলো শুনলাম, সে কথার ভেতরে একটি জিনিস আমাকে ভীষণভাবে আক্রান্ত করেছে এবং যেটা আমরা সবাই উপলব্ধি করেছি, আমরা সবাই কম-বেশি আদর্শচ্যুত হয়েছি। আদর্শচ্যুত হলে মানুষের জীবনে সংস্কৃতি, শিক্ষা, রুচি সব কিছুরই পতন ঘটে এবং সেই জায়গায় তিনি আজ থেকে ১০/১২ বছর আগে যে উপলব্ধি ব্যক্ত করে গিয়েছিলেন, সেটি আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্যই এক সময় মাঠে নেমেছিলেন। রাজনীতিতে হাতেখড়ি নিয়েছিলেন তাঁর শ্বশুরের হাত ধরে। সেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং মানবতাবাদী মন-মানসিকতা নিয়ে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এবং সেই সময়ে রাজনীতি নয়, তার আগেই সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তাঁর যে পদচারণা অথবা বলতে পারি একটি ঐতিহাসিক পদচিহ্ন রেখেছিলেন, সেটি হলো ১৯৪৯ সালের একটি নাট্যাভিনয়ে মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে তিনি অভিনয় করেছিলেন এবং তিনি ছিলেন প্রথম মুসলিম মহিলা। আমার যতটুকু মনে আছে, ’৫০-এর দশকে এসে দু’একজন মহিলা হয়ত মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিলেন, কিন্তু তার আগে পুরুষরাই মহিলার ভূমিকায় অভিনয় করতেন এবং তিনিই প্রথম এই দুঃসাহসটি দেখাতে পেরেছিলেন। শুধু দুঃসাহস নয়, ’৪৯ সালে তাঁর বিয়ের মাত্র ১ বা দেড় বছর পরেই, সেই সময়ে মঞ্চে তিনি একজন মহিলা হয়ে অভিনয় করেছেন। এটা তখনকার মুসলিম সমাজে কল্পনা করা খুব দুষ্কর ছিল। আমরা জানি, ইতিহাসে পরবর্তীকালে দু’একজন ’৫০-এর দশকের দিকে এসেছেন। তখনকার দিনের সেই নাটকের ইতিহাস আজকে কত বিস্তৃত, কত সম্প্র্রসারিত হয়েছে, কত গ্রাহ্য হয়েছে, দর্শকনন্দিত হচ্ছে। আজকে কিন্তু আমরা সেই অতীতের কথাগুলো স্মরণ করি না। অনেক সময় আমরা ভুলে যাই যে, দুস্তর পারাবার পেরিয়ে আজকের এই রকম সংস্কৃতি অভিযাত্রায় আমরা একটি নন্দিত ময়দানে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি যে সাম্প্রদায়িকতার কথাটি বলছিলাম, সেই জায়গা থেকে ধরি, সেই সময় ১৯৪৬-এ গ্রেট ক্যালকাটার কিলিংয়ের সময় আমারও তখন বয়স খুব কম, কিন্তু তবুও আমার মনে আছে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মহাত্মা গান্ধী এক সঙ্গে শান্তি মিশন নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ানোর যে দৃশ্য ছোটবেলায় হাফ প্যান্ট পরে গেঞ্জি গায়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ডা. সুরেশ সরকার লেনে দেখতাম, কি অসাধারণ একটি মৈত্রীর বন্ধন রচনা করবার জন্য তখন ছাত্রছাত্রীরা, তারা ময়দানে নেমে গেছে এবং বিভিন্ন দলে যারা অসাম্প্রদায়িক ছিল, কমিউনিস্ট পার্টি ছিল, কংগ্রেস ছিল এবং মুসলিম লীগেরও কিছু কিছু অংশ, তাঁরা কাজগুলো করতেন অর্থাৎ সমাজে যাঁরা অন্ততপক্ষে অসাম্প্রদায়িক অংশ ছিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং তাঁর যে ভূমিকা তখন ছিল, সে অসাধারণ সাহসী ভূমিকা, সেই সঙ্গে তাঁর অভিযাত্রী হিসেবে নূরজাহান মুরশিদকে পেয়েছিলেন। পরে নূরজাহান মুরশিদের মতো আরও ছেলেমেয়েদের পেয়েছিলেন তিনি। আরেকটা জিনিস এই যে, মানবতাবিরোধী মানুষের যে ঘটনাবলী- ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তরকালে আমরা যে দেশটিকে লালন করবার জন্য প্রচুর রক্তক্ষরণে এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তাকে বিপন্ন করবার জন্য আবারও সেই সন্ত্রাসী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে আমরা শুধু চেষ্টা করছি তাই নয়, আমরা রক্ত দিয়ে যখন এই স্বাধীনতাকে কিনেছি তখন আমাদের মধ্যে এই দৃঢ় প্রত্যয়টি জন্মেছে যে, ওই ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত মানুষের বিপুল রক্তক্ষরণে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, একে কেউ ব্যাহত করতে পারবে না। এর ওপর আক্রমণ হয়ত আসবে সাময়িকভাবে। সেই আক্রমণকে রুখবার জন্য, প্রতিরোধ করবার, প্রতিহত করবার শক্তি আমাদের আছে। তা না হলে তো আমরা দেখেছি, ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের কোন অস্ত্র ছিল না। শত্রুর কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে আমরা লড়াই করে আমাদের দেশকে স্বাধীন করেছিলাম। সেই স্বাধীনতার যে সংস্কৃতি, সেটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আজকে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় যে ঘৃণা এবং আমাদের মনের মধ্যে যে প্রচ- রকমের ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে, তাকে নিয়ে আজকে আমরা আবারও সেই স্বাধীনতা এবং সেই ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক যে সিদ্ধান্ত, সেই সিদ্ধান্তকে আমরা সংরক্ষণ করবার জন্য চেষ্টা করব, এটাই তো আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় হওয়ার কথা। আজকে নূরজাহান মুরশিদের দ্বাদশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে এই কথাটি আমার কাছে বার বার মনে হচ্ছে। আরেকটি কথা, ওই প্রামাণ্যচিত্রের ভেতরে দেখলাম, এই যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, শ্বশুরকে তিনি ভোট দেবেন কি দেবেন না, সেই নিয়ে যে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন এবং তিনি তাঁর নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থেকেছেন, অটল থেকেছেন, এইটা আমার কাছে অনুস্মরণীয় মনে হলো। ১৯৫৪-তে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েছেন এবং সেই নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হলেন। আমার মনে হয়, এই সময়ে বেগম শামসুন্নাহার মাহ্মুদ তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। বেগম শামসুন্নাহার মাহ্মুদ মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তাঁর ছেলে মুসলিম লীগ বিরোধী ছিলেন। তিনি যুক্তফ্রন্টের কর্মী ছিলেন। সে তাঁর মায়ের বিরুদ্ধে প্রচার কাজ করেছে। কথাটা আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল। নূরজাহান মুরশিদ এই দ্বিধায় পড়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে শ্বশুরকে ভোট দিলেন না। এই যে স্থির সিদ্ধান্ত, এগুলো কিছুটা সাহসিকতা, কিছুটা রাজনৈতিক প্রজ্ঞারও ব্যাপার। তিনি সাংবাদিকতা করেছেন, শিক্ষকতা করেছেন, রাজনীতিবিদ ছিলেন, মন্ত্রিত্ব করেছেন, যুক্তফ্রন্টের এত কাজ করেছেন এবং করে তিনি যে সাহস আমাদের মনের মধ্যে সঞ্চার করে দিয়েছেন, তা আমাদের সামনে এগোতে অনুপ্রাণিত করেছে। ‘নারীবাদী’ কথাটি বললে যে রূপ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তিনি সেরকম ছিলেন না। তাঁর স্নিগ্ধ, মার্জিত চেহারার দিকে তাকালে এবং বুদ্ধিদীপ্ত, যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে আমার মনে হতো, তিনি বোধহয় ঘরোয়া এবং পোশাকী এই দুইয়ের মিশ্রণের একটি অসাধারণ চেহারার অধিকারী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা ছিলেন। তিনি সর্বত্রই সমানভাবে মেলামেশা করতে পারতেন। এই যে সাহসটা তাঁর মধ্যে ছিল, দুরন্তপনা তাঁর মধ্যে ছিল, সেটি কিন্তু তাঁকে তাঁর জীবনপথে রাজনীতির ক্ষেত্রে, সাহসিকতার ভূমিকার ক্ষেত্রে একটা ভীষণ রকম অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে অন্তর থেকে সাহায্য করেছে। আজকে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই এবং একটা কথা বলে শেষ করি, নূরজাহান আপা আজকে যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে দেখে যেতেন, যে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আমরা সেদিন লড়াই করেছিলাম বিপুল রক্ত খরচে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে, আমরা আমাদের সাধের পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানী দস্যুদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে পরিণত করেছিলাম এবং সেই সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাকে পুনর্গঠনের জন্য আপনি যে হাত লাগিয়েছিলেন, সেই হাত এখন আরও অনেক শক্ত হয়েছে, সংখ্যায় বেড়েছে। আদর্শচ্যুত হয়েছি পুরোপুরি বলব না। আদর্শ ভুলে গিয়ে আবার সেই আদর্শে ফিরে আসবার জন্য কিন্তু আমরা জয় বাংলা সেøাগান নিয়ে শাহবাগ চত্বর দখল করে নিয়েছিলাম, সে জিনিসটি আপনি দেখতে পেলেন না। এটা আমার দুঃখ রইল এবং আজকের এই দিনে আপনাকে জানাতে চাই যে, আপনি যেখানেই থাকুন না কেন আপনি এই শাহ্বাগ চত্বরের দিকে তাকিয়ে দেখবেন। ২০১৩ সালে স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের যে ঢল নেমেছিল, সেই ঢলের বিরুদ্ধে ওই মৌলবাদী শক্তি অপপ্রচারের মিথ্যাচারের ঢল নামিয়েছিল, সেগুলো কিন্তু মানুষকে আগ্রহচ্যুত করতে পারেনি। এখনও আমরা সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমাদের যে স্বাধীনতা, আমাদের যে সার্বভৌমত্ব, যার স্বপ্ন আপনি দেখেছিলেন এবং পরবর্তীকালে সেই স্বপ্ন দেখাটাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন, একটা বৈরী পরিবেশের মধ্যে যখন পড়েছিলেন, তারপরেও আপনার সেই স্বপ্ন এখনও লালিত আমাদের চোখে এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও সেভাবেই দারুণ গতি নিয়ে এবং প্রচ- শক্তি নিয়ে তারা এগিয়ে আসছে। নূরজাহান আপা আপনি তাদের আশীর্বাদ করুন। আজকের এই মহান দিনে আপনাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমার লেখা এখানেই শেষ করছি। লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×