ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবস্থাপনা দক্ষতার চেয়ে তারকাখ্যাতি মুখ্য

তামিলনাড়ু ॥ জয়ললিতায় মোহাবিষ্ট রাজ্য

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ৫ জুলাই ২০১৫

তামিলনাড়ু ॥ জয়ললিতায় মোহাবিষ্ট রাজ্য

মে মাসের ৮ তারিখের সন্ধ্যায় আমি (আইএনওয়াইটির প্রতিনিধি) দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর রাজধানী চেন্নাইর একটি হিন্দু মন্দিরের নৈবেদ্যদান কক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম। এক ঝাঁক উদ্বিগ্ন রাজনীতিবিদ তাদের প্রথামাফিক সাদা শার্ট ও ধুতি পরে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। একজন পুরোহিত সুর করে প্রার্থনা করছিলেন ‘প্রভু পেরুমল আমরা প্রার্থনা করছি ন্যায় বিচার জয়লাভ করুক। আমিলনাড়ু সমৃদ্ধির সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু অশুভ শক্তি একে স্থবির করে দিয়েছে। আম্মাকে আবার কাজ শুরু করতে দেয়া হোক। তাঁর প্রতিপক্ষরা শাস্তি পাক। যে অশুভ শক্তি তাঁকে কারাবন্দী করেছে তারা নরকে নিক্ষিপ্ত হোক। আমরা যখন প্রার্থনা অনুষ্ঠান শুরুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সে সময় রাজনীতিবিদরা আমাকে তাদের উলকি দেখাচ্ছিলেন। উচ্চশিক্ষার্থীর বাহুতে উৎকীর্ণ করা আছে একজন মহিলার গোলগাল মুখ। একজন জেলা সচিবের বাহুতে উলকি করা আম্মা দীর্ঘজীবী হোন। আম্মা অর্থ ‘মা’ এবং তামিলনাড়ুতে এটা জয়ললিতা জয়রাম নামের একজন অবিনাশী রাজনীতিবিদের আদর করে ডাকা নাম। তিনি একজন প্রাক্তন অভিনেত্রী ও বর্তমানে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল এআইডিএমকের সাধারণ সম্পাদক। ২৭ সেপ্টেম্বর যখন তাঁকে ৪ বছরের কারাদ- দেয়া হয়, তখন তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পদ। আদালত দেখতে পেয়েছে তাঁর সম্পদ তাঁর ৬৬ কোটি রুপির (প্রায় ১ কোটি ডলার) জ্ঞাত আয় ছাড়িয়ে গেছে। তাঁর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১০,৫০০ শাড়ি, ৭৫০ জোড়া জুতো এবং ৬৬ পাউন্ড সোনা পাওয়া গেছে। এটা উত্তর ভারতের সরকারী কর্মচারীদের জব্দ করা ১০০০ কোটি রুপি অবৈধ আয়ের তুলনায় নগণ্য। তা সত্ত্বেও তিনি হলেন ভারতের কোনও রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে যাকে অপসারণ করা হয়। রায় ঘোষণার পর রাজ্যজুড়ে তাঁর সমর্থকরা বাসে ইটপাটকের নিক্ষেপ করে ও আগুন ধরিয়ে দেয়। চেন্নাইমুখী মহাসড়কের পেরুংগালাথুর সংযোগস্থলে লোকরা রাস্তায় শুয়ে পড়ে বাসচালকদের তাদের শরীরের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। তারা চিৎকার করে বলতে থাকে, আমাদের ওপর দিয়ে চালাও! আমাদের ওপর দিয়ে চালাও! ‘আমাদের আম্মা যখন জেলে, তখন আমরা কেন বেঁচে থাকব?’ এআইএডিএমকে জানিয়েছে, তাঁকে দ-িত করার পর শত শত লোক আত্মহত্যা করে এবং ২০/৩০ জন আগুনে আত্মাহুতি দেয়। এই অতি নাটকীয়তাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? পার্শ্ববর্তী রাজ্য কেরালায় আপনি এমন কাউকে খুঁজে পাবেন না যারা বাসচালককে তাদের হত্যা করার জন্য কাকুতিমিনতি করছে। এর একটা ব্যাখ্যা হলো চলচ্চিত্র বাতিক। রাজনীতিতে আসার আগে জয়ললিতা ছিলেন তাঁর সময়ের তামিল ছবির সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তিনি শতাধিক ছবির নায়িকা ছিলেন। তিনি তাঁর গুরু ও সহ-তারকার মডেল অনুসরণ করেন। তিনি ছিলেন অভিনেতা-রাজনীতিবিদ মারুধুর গোপালাম রামচন্দ্রনে, আদ্যাক্ষর এমজিআর নামেই যিনি বেশি পরিচিত। তিনি ১১ বছর তামিলনাড়ু শাসন করেন এবং ১৯৮৭ তে তাঁর মৃত্যুর পর জয়ললিতা ও তাঁর চিরশত্রু, ধূর্ত ৯২ বছর বয়সী চিত্রনাট্যকার মুথুভেল করুনানিধি পালাক্রমে রাজ্য শাসন করেন। জয়ললিতার মুখের সর্বব্যাপিতা রাজ্যকে একটা কার্টুন এক নায়কের ভাবমূর্তি দিয়েছে। তবে তা তাঁর মোহময়তার প্রতি উদাসীন তামিলদের বিরক্তিও উৎপাদন করেছে। আপনি হয়তো ভাববেন এই ভাবাবেগের স্রোত তামিলনাড়ুকে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থায় ফেলেছে। মোটেই তা নয়। প্রকৃতপক্ষে এটা ভারতের সবচেয়ে সুশাসিত রাজ্যের একটি। জাঁ দ্রিহও অমর্ত্য সেন তাঁদের বই এ্যান আনসর্টেন গ্লোরিতে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পর্যালোচনা করতে গিয়ে তামিলনাড়ুকে ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রশাসনিক উদ্ভাবনার একটি পরাকাষ্ঠা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। জনসেবার মানের বিচারে তাঁরা তামিলনাড়ুকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। তবে ভোটারদের মধ্যে জয়লালিতার অব্যাহত সাফল্যের জন্য তাঁর ব্যবস্থাপনার চেয়ে তাঁর ব্র্যান্ডিং দক্ষতাকে বেশি কৃতিত্ব দিতে হবে। -ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক টাইমস।
×