ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একিউআইএসের প্রধানসহ ১২ জঙ্গী আটক

জেল ভেঙ্গে জঙ্গীদের ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৩ জুলাই ২০১৫

জেল ভেঙ্গে জঙ্গীদের ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা

শংকর কুমার দে ॥ কারাগার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য স্পর্শকাতর স্থান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ওপর হামলার মাধ্যমে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনার কথা ফাঁস করেছে উপমহাদেশের আল কায়েদা ও আইএস শাখা একিউআইএস। রাজধানীতে বিশেষ অভিযান চালিয়ে একিউআইএসের বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক ও সাবেক হুজি নেতা মুফতি মাইনুল ইসলাম এবং একিউআইএসের উপদেষ্টা মাওলানা জাফর আমিনসহ মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে র?্যাব। ঈদের পর বড় ধরনের নাশকতার তথ্য জানিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য বের হয়ে আসে। আটকদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় সালফার এসিড, গন্ধক, পটাশিয়াম এ্যামোনিয়াম নাইট্রেটসহ বিপুল বিস্ফোরক, বিস্ফোরক ডিভাইস, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, ছুরিসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র, জিহাদী বই, মোবাইল ফোনসেট ও ব্যাংকের চেক। আল কায়েদার প্রধানের ভিডিও বার্তা ও আইএস জঙ্গীদের কার্যক্রম দেখে তৎপর হওয়ার চেষ্টা করছিল তারা। সরকারের উচ্চপর্যায়ে থেকে আল কায়েদা ও আইএসসহ জঙ্গী তৎপরতার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল ইউনিটসহ গোয়েন্দা সংস্থাকে সতর্কতা অবলম্বন ও নজরদারি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাব সূত্র জানায়, এমন এক সময়ে বাংলাদেশে আল কায়েদা ও আইএস শাখার প্রধান সমন্বয়ক ও উপদেষ্টাসহ ১২ জঙ্গী গ্রেফতার হলো যখন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে খুব শীঘ্রই বড় ধরনের জঙ্গী হামলার জন্য তৈরি হচ্ছিল একিউআইএস। জঙ্গী হামলার নীলনক্সার কথা জানান ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। সিরিয়া ও ইরাকে সক্রিয় এই জঙ্গী সংগঠনটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং উপসাগরীয় এলাকায় ভয়ঙ্কর জঙ্গী তৎপরতায় যুক্ত। আল কায়েদা নেতৃত্ব আইএসের সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করে আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ছড়িয়ে পড়ার পর এখন ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে শিকড় গড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের ভয়ঙ্কর জঙ্গী তৎপরতার রেশ এখন বাংলাদেশের দিকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। একিউআইএসের বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী ও সাবেক হুজি নেতা মুফতি মাইনুল ইসলাম এবং একিউআইএসের উপদেষ্টা মাওলানা জাফর আমিনসহ মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, ঈদ-উল-ফিতরের পর রাজধানীতে বড় ধরনের পরিকল্পনা করেছে ভারতীয় উপমহাদেশের একিউআইএসের শাখার আল কায়েদা ও আইএস। তাদের পরিকল্পনায় ছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আসামি মাইনুদ্দিনসহ কারাবন্দী জেএমবি, হুজি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান ও বড় মাপের জঙ্গীদের ছাড়িয়ে আনতে জেলখানা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা করবে তারা। আদালতে হাজিরা দেয়ার জন্য কারাগারের ভেতর থেকে আনা নেয়ার সময়ে সুযোগ বুঝে তারা হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল। এ জন্য তাদের আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, গ্রেনেড-বোমা সরবরাহ করা হতো। সফল হতে পারলে তারা স্পর্শকাতর স্থানে হামলা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যা করার পদক্ষেপ নিত। এই ধরনের নীলনক্সা ছিল তাদের। এক সঙ্গে সারাদেশে হামলার পরিকল্পনাও ছিল এই জঙ্গীগোষ্ঠীর। রাজধানীতে বিশেষ অভিযান চালিয়ে একিউআইএসের বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী ও সাবেক হুজি নেতা মুফতি মাইনুল ইসলাম এবং একিউআইএসের উপদেষ্টা মাওলানা জাফর আমিনসহ মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করার পর র‌্যাব সদর দফতরে বৃহস্পতিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান, গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ, লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের উপ-পরিচালক মেজর রুম্মান মাহমুদ, সিনিয়র সহকারী পরিচালক মেজর মাকসুদুল আলম। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান এ সব তথ্য জানিয়ে বলেন, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের পর বেরিয়ে আসে এই জঙ্গী গোষ্ঠীটির বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা। ঈদের পর রাজধানীতে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর জন্য বেশকিছু জঙ্গী সদস্য ঢাকায় জড়ো হচ্ছিল। তারা রাজধানীর মিরপুরে একটি বাসা ভাড়া নেয়। সেই বাসায় বেশকিছু জঙ্গী সদস্য মিলিত হতে বরিশাল ও খুলনা থেকে রওনা দেয় বলে র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগে খবর আসে। যেভাবে গ্রেফতার হয় ॥ কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, গোপন তথ্যের প্রেক্ষিতে র‌্যাব-৪ বুধবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে রাজধানীর সদরঘাট থেকে একিউআইএসের বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী মাওলানা মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিম ওরফে নানা ওরফে বদিউল (৩৫), উপদেষ্টা মুফতি জাফর আমিন ওরফে সালমান (৩৪), সক্রিয় সদস্য মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম (২০), মোঃ মোশাররফ হোসেন (১৯) ও আব্দুল রহমান বেপারীকে (২৫) আটক করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সক্রিয় সদস্য আল আমিন ওরফে ইব্রাহিম (২৮), মোজাহিদুল ইসলাম (৩১), আশরাফুল ইসলাম (২০), রবিউল ইসলাম (২৮) ও মোঃ হাবিব উল্লাহকে (২৬) আটক করা হয় এবং মিরপুর-১-এর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ৬৮ নম্বর বর্ধনবাড়ির ভাড়া করা বাসায় অবস্থানরত মোঃ শহিদুল ইসলাম (১২) ও আলতাফ হোসেনকে (২৬) আটক করা হয়। উদ্ধারকৃত ধ্বংসাত্মক আলামত ॥ আটকদের কাছ থেকে এ সময় তাদের হেফাজত থেকে আড়াই লিটার সালফিউরিক এসিড, এক লিটার এসিটন, এক কেজি গন্ধক, এক কেজি সালফার, ৪শ’ গ্রাম পটাশিয়াম ক্লোরেট, নগদ ৪৯ হাজার ৪শ’ ৯৪ টাকা, ৫৫০টি মার্বেল, ২ লিটার গ্লিসারিন, ৫ কেজি সোডিয়াম-বাই কার্বনেট, ৫টি জার, ৫ কেজি এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, ১৫টি বিস্ফোরক ডিভাইসসহ বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য ও জিহাদী বই, বিস্ফোরক ডিভাইস, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, ছুরিসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র, জিহাদী বই, মোবাইল ফোনসেট ও ব্যাংকের চেক উদ্ধার করা হয়। তারা আল কায়েদার প্রধানের ভিডিও বার্তা ও আইএস জঙ্গীদের কার্যক্রম দেখে তৎপর হওয়ার চেষ্টা করছিল বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান র‌্যাবের কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান। কর্মী সংগ্রহের তিন ধাপ ॥ র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, আল কায়েদা ও আইএস শাখার (একিউআইএস) দাওয়াতি তবলীগ’-এ মূলত তিন ধাপে কর্মী সংগ্রহ হতো। ফেসবুকে উগ্রপন্থী ওয়েবসাইটে ‘লাইক’ দিলে তাদের বলা হতো ‘দ্বীন কায়েমের সাথী’। দ্বিতীয় ধাপ হলোÑ‘বায়াতে ফি ছাবিলিল্লাহ। যারা ‘আল্লাহর পথে দাওয়াতি কার্যক্রম’ চালাতে অঙ্গীকারাবদ্ধ, তারাই ওই নামে পরিচিত হতো। আর ওই সংগঠনের তৃতীয় ধাপ হলো ‘শহীদি কাফেলা’। যাদের ঈমান ‘শক্ত’ এবং জিহাদে ‘শহীদ’ হওয়ার জন্য প্রস্তুত, তারাই শহীদি কাফেলার অন্তর্ভুক্ত বলে আটকরা র‌্যাবকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় অনেকটা চাপে থাকায় নতুনভাবে কর্মী সংগ্রহ শুরু করেছিল আটক জঙ্গীরা। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ‘দাওয়াতি কার্যক্রম’ চালানোর পরিকল্পনায় ছিল তারা। দাওয়াতে তবলীগ ও ৩১৩ সৈনিক সংগঠন ॥ একিউআইএসের বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী ও সাবেক হুজি নেতা মুফতি মাইনুল ইসলাম ওরফে মাওলানা মুফতি মাইনুদ্দিন ওরফে আবুল জান্দাল ব্রিটিশ হাইকমিশনের ওপর হামলা মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি। তিনি জেলহাজতে থেকে মোবাইল ও চিঠির মাধ্যমে জেলের বাইরে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নতুন জঙ্গী সংগঠনটির নামকরণ করেন ‘দাওয়াতে তবলীগ’। তারপর ‘৩১৩ বদরের সৈনিক’ নামে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা চালায় সংগঠনটি। তিন স্তরে কাজও শুরু করেছে দাওয়াতে তবলীগ। তারা ঢাকার বাইরে ট্রেনিং ক্যাম্প গড়ে তোলার পরিকল্পনাও করে। এ জন্য বগুড়ায় একটি মাদ্রাসার মাঠও নির্ধারণ করেছিল। দাওয়াতে তবলীগ ও ৩১৩ বদরের সৈনিক সংগঠনটির অর্থদাতা সৌদি আরব ও দুবাই থেকে ফিদাই মাওলা নামে ফেসবুক ব্যবহারকারী রফিক নামে এক ব্যক্তি। জাফর আমিন এই টাকা সংগঠনের কাছে পৌঁছে দিত। আটকরা ‘৩১৩ বদরের সৈনিক’ নামে যে সংগঠন করার কথা ভেবেছিলেন, তার ২০ জনের একটি দল বগুড়ায় ২০ দিনের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন। সেই প্রশিক্ষণের বিভিন্ন ‘ট্রেনিং ম্যানুয়ালও’ উদ্ধার করা হয়েছে বলে র‌্যাবের ব্রিফিংয়ে জানানো হয়। বড় ধরনের নাশকতা থেকে রক্ষা ॥ র‌্যাব কর্মকর্তারা বলেন, একিউআইএসের বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী ও সাবেক হুজি নেতা মুফতি মাইনুল ইসলাম এবং একিউআইএসের উপদেষ্টা মাওলানা জাফর আমিনসহ মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করার পর তাদের বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ায় বড় ধরনের নাশকতা থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। একিউআইএস জঙ্গী গোষ্ঠীটির বাংলাদেশ শাখার যারা জড়িত আছে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের তালিকা তৈরি করে গ্রেফতার অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। লেখক অভিজিৎ রায় ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ খুন হওয়ার পর ওই জঙ্গী সংগঠনের পক্ষ থেকেই দায়িত্ব স্বীকার করে বার্তা দেয়া হয়েছিল।
×