ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফ্রান্স সংস্কারের পথে এলো দেরিতে

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ৩০ জুন ২০১৫

ফ্রান্স সংস্কারের পথে এলো দেরিতে

ফ্রান্সের স্থবির অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের জন্য সে দেশের সোশ্যালিস্ট প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভ্যালস পার্লামেন্টকে দিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রস্তাব পাসের উদ্যোগ নেন। গত ১৬ জুন পার্লামেন্টের নিম্ন পরিষদে তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত বিলটি তিনি ভোটাভুটি ছাড়াই ডিক্রীবলে পাস করাবেন। এতে করে পার্লামেন্টে হৈহট্টগোল সৃষ্টি হয়। বিরোধীদলীয় সদস্যরা ওয়াকআউট করেন। সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব তোলা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ভোটাভুটিতে অনাস্থা প্রস্তাবটি পাস হতে পারেনি এবং ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদের সরকারও এযাত্রা টিকে যায়। আস্থা ভোটে জিতে যাওয়ায় সংস্কার প্রস্তাব আপনা-আপনি পাস হয়ে গেল। ফ্রান্সের অর্থনীতির অবস্থা অতি নাজুক। গত বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছিল অতি সামান্য। বার্ষিক শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ হারে। বেকারত্ব যে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল, সেখান থেকে আর নেমে আসেনি। এই নাজুক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অর্থনীতিতে দরকার বেগ সৃষ্টি করা। সেজন্যই নেয়া হয়েছে অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ। সংস্কারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, ব্যবসায়িক কর্মকা-ে সময় বাড়ানো হবে। এতে করে দোকানপাট রোববারসহ আরও বেশি সময় খোলা থাকবে। দোকানপাট ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পারিশ্রমিক বাড়ানো হবে। দ্বিতীয়ত, অতি নিয়ন্ত্রিত আইন পেশায় প্রবেশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিথিল করা হবে। তরুণ পেশাজীবীদের পক্ষে তাদের পছন্দমতো জায়গায় দোকান খুলতে দেয়া এবং সেখানে ডিসকাউন্ট দেয়ার সুযোগ থাকবে। তৃতীয়ত, শিল্প ট্রাইব্যুনালগুলোর জটিল পদ্ধতি সহজতর করা হবে। বর্তমান পদ্ধতিতে শ্রম বিরোধগুলোর নিষ্পত্তিতে অনেক দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এতে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বিলে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কাজে বাধাদানকারী কর্মচারীদের কারাদ- দেয়ার ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয়েছে। চতুর্থত, স্টাফদের শেয়ার কিংবা অন্যান্য রূপের সঞ্চয়ের ব্যবস্থা নিয়ে পুরস্কৃত করার পদ্ধতি সহজতর করা হয়েছে। বাইরের অতি যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করার জন্য বিলে কর রেয়াত সম্প্রসারিত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পঞ্চমত, দূরপাল্লার বাস সার্ভিসগুলোকে আন্তঃনগরী ট্রেন সার্ভিসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ দেয়া এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া সহজতর করা হয়েছে। ষষ্ঠত, ফ্রান্সের ঋণের অঙ্ক কমানোর লক্ষ্যে নিস ও লিও বিমানবন্দর বিরাষ্ট্রীয়করণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ব্যবসাবান্ধর এই প্রস্তাবিত আইনগুলো অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর জন্য অত সাহসী ও অনুকূলে না হলেও, মন্দ নয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রবৃদ্ধি বাড়ানোই এর লক্ষ্য। এখন কতটুকু কাজ দেবে, সেটাই কথা। কারণ এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো স্বাগত জানানোর মতো হলেও খুবই অপ্রতুল। তাছাড়া প্রস্তাবগুলো আনতে ইতোমধ্যে অনেক বিলম্বও ঘটে গেছে। এদিকে বাম শিবিরের কোন কোন মহল সংস্কার প্রস্তাবের নিন্দা করে বলেছে, এর দ্বারা সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। মার্টিন অব্রে নামে এক বামপন্থী নেতা বলেন, রবিবারে দোকানে কেনাকাটার ব্যবস্থা করা ছাড়া এই সরকারের আমাদের জীবনকে সংগঠিত করার জন্য আর কি কিছুই করার নেই? প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিন বছর আগে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছিটেফোঁটা আকারে হলেও সেই সংস্কার কার্যক্রম আনতে তাঁর এতটা সময় লেগে গেল। এখন সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা কাজ করছে যে, ওঁলাদের সময় ফুরিয়ে যেতে বসেছে অথচ কাজের কাজ তাঁকে দিয়ে কিছুই হলো না। ওঁলাদ কি তাঁর এই সংস্কার কার্যক্রম দু’বছর পর ২০১৭ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনী প্রচারণার কাজে লাগাতে পারেন? তাঁর সাম্প্রতিক কিছু কিছু কর্মকা- থেকে তেমন মনে করার কারণ ঘটেছে। গত তিন বছরে ওঁলাদ তাঁর জনপ্রিয়তা যথেষ্ট হারিয়েছেন। তাঁর জনসমর্থন ১৯ শতাংশের প্রায় রেকর্ড মাত্রায় নেমে এসেছে। আগামী নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে জনসমর্থন পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে এই সংস্কার কার্যক্রম নিয়েছেন। প্রশ্ন হলো- পরবর্তী ছয় মাসে এই সরকার প্রকৃত কোন সংস্কার করতে পারবে কি-না। নির্বাচনের ব্যাপারটা যে ওঁলাদের মাথায় আছে, তা গত মে মাসে তাঁর কারকাসোন সফরের সময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেখানে তিনি একজন প্রার্থীর মতো আচরণ করেন, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের মতো নয়। সেখানে তিনি উপস্থিত জনম-লীকে ২০১২ সালে লা বুর্গেতে তাঁর প্রদত্ত এক বক্তৃতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ঐ বক্তৃতায় তিনি ধনী সম্প্রদায় ও ব্যাংকগুলোকে সঙ্কুচিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যেন সেই মুহূর্তটি এসেছে এমন একটা ভাব করে তিনি বলেন, সংস্কারের একটা অধ্যায়ের পর তিনি সম্পদ পুনর্বণ্টন করবেন বলে সে সময় কথা দিয়েছিলেন। ফ্রান্সে এখন সরকারী কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির কথা শোনা যাচ্ছে। এমনকি ২০১৭ সালে ফ্রান্সে উৎসে কর কর্তন ব্যবস্থা চালু করা গেলে আয়করবিহীন বছরের মতো ভোটারবান্ধব ধারণার কথাও শোনা যাচ্ছে। সংস্কারমূলক আরও দু-একটা বিলও আগমনের পথে আছে। একটা হলো শ্রম সংস্কার। অন্যটি ডিজিটাল বাজার। প্রথমটিতে কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী ভ্যালস ঘোষিত পদক্ষেপের বাড়তি কিছু ব্যবস্থা আছে। এতে নিয়োগকর্তাদের স্বল্পমেয়াদী চুক্তি এখনকার মতো শুধু একবার নয়, দু’বার নবায়ন করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনীতি যখন গতি সঞ্চার করছে অথচ আস্থার অবস্থাটা নাজুক, তখন কোম্পানিগুলোকে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা জুগিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উৎসাহ যোগানো। তারপরও শ্রম সংস্কার বিলের বাকি অংশ অতিমাত্রায় নমনীয় এবং তাতে ফ্রান্সের ৩৮০৯ পৃষ্ঠার শ্রমবিধি। যা বাইবেলের আকারের প্রায় দ্বিগুণÑ সেটা কাটছাঁট করার তেমন কোন চেষ্টাই করা হয়নি। ফ্রান্সের অর্থনীতি যে চাপমুক্ত হতে চলেছে, তেমনটা আশা করার অন্যান্য কারণও আছে। তেলের মূল্যহ্রাস, সুদের হার কমে যাওয়া এবং সেই সঙ্গে ইউরোও অপেক্ষাকৃত সস্তা হয়ে ওঠার ফলে অর্থনীতিতে খানিকটা আলোড়ন উঠেছে। তিন বছর প্রবৃদ্ধি প্রায় শূন্য থাকার পর এ বছর ১ দশমিক ১ শতাংশ এবং আগামী বছর ১ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়া উচিত। ওঁলাদ একদা অর্থনৈতিক চক্রের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিতেন। খারাপ অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে ভাল অবস্থায় ফিরে আসার ওপর তাঁর সুদৃঢ় আস্থা আছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে তিনি শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে থাকবেন এবং প্রবৃদ্ধিকেই তার হয়ে কাজটা করে যেতে দেবেন। সেই সঙ্গে আশা করবেন যে, বেকারত্ব কমে আসতে শুরু করবে, যা এই মুহূর্তে ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনীতির অন্য লক্ষণগুলোও খারাপ নয়। তথাপি ব্যবসাবান্ধব সংস্কার নিয়ে ওঁলাদের উদ্বিগ্ন বোধ করার কারণ আছে। কেননা এই সংস্কার তিনি বেশ দেরিতেই শুরু করেছেন। এতটা দেরিতে যে, তাঁর কার্যকালে কতটা সুফল পাওয়া যাবে, তা বলা মুশকিল। তাছাড়া পরস্পরবিরোধী সঙ্কেতও রয়েছে। ব্যবসাবান্ধব সংস্কার হলেও ব্যবসায়ী মহল সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে সন্দিহান। শেষ পর্যন্ত আগামী দু’বছর ফ্রান্সের অর্থনীতির হলো কী দাঁড়ায়, তাই দেখার বিষয়। সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট
×