ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলার জল রঙের ছোঁয়া

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৯ জুন ২০১৫

বাংলার জল রঙের ছোঁয়া

গৌতম পাণ্ডে ॥ শিল্পীর শিল্পানুসন্ধান ও নবসৃষ্টির মধ্যে ফারাক থাকলেও নির্যাস কিন্তু অনুসন্ধান থেকে। যা আপাত দৃষ্টিতে শুধু একটি ছবি বা মূর্তি মনে হলেও এর মধ্যে প্রকাশ পায় শিল্পবোধ ও সৃষ্টির মৌলিকত্ব। এমনই কিছু ছবির জন্ম দিলেছেন প্রতিভাবান তরুণ চিত্রশিল্পী ইসকিন্দার মির্জা। নিসর্গ, জনজীবন, মানুষ, পশু-পাখি এবং ফুল-লতাপাতায় সমৃদ্ধ প্রকৃতিই তাঁর শিল্পের উপজীব্য। রঙের বাহুল্য নেই কিন্তু দেখে মনে হয় ছবিগুলো জীবন্ত এক নবসত্তার ইঙ্গিত। যা আকর্ষণ করবে কলামুদে মানুষদের। যেমন ধরা যায় একটি ঘোড়ার মুখ। স্বচ্ছন্দ প্রক্রিয়ায় জল রং দিয়ে তিনি এঁকেছেন। স্বাভাবিকভাবে সবারই এই প্রাণী বিষয়ে কম-বেশি জানাশোনা। কিন্তু শিল্পী ইসকিন্দার মির্জা এটাকে স্বাভাবিক অর্থে বোঝাতে চাননি। তাঁর শিল্পীসত্তায় উঠে এসেছে প্রাণীটির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। কোন এক সময়ে রাজধানী ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ছিল বেশি। এমনকি জমিদার বা সম্ভ্রান্ত মানুষের বাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়িই ব্যবহার হতো। কালের স্রোতে ঘোড়ার গাড়ি এখন বিলুপ্তির পথে। যান্ত্রিক গাড়ির দাপটে রাজধানীর বায়ুদূষণ নৈমিত্তিক ব্যাপার। বিভিন্ন আঙ্গিকে শিল্পীর আঁকা ঘোড়ার মুখ ইঙ্গিত করে এমনই অপ্রত্যাশিত অধ্যায়। নিজের শিল্প সৃষ্টি প্রতিক্রিয়ায় শিল্পী ইসকিন্দার মির্জা বলেন, আমি জল রং নিয়ে বেশি কাজ করি। প্রদর্শনীতে ঘোড়া নিয়ে আমার বেশি কাজ করা হয়েছে। কেননা পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ঘোড়ার গাড়ি আজ বিলুপ্তির পথে। তাই আমি শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে চেয়েছি এই ঐতিহ্য আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারি টুতে চলছে চিত্রশিল্পী ইসকিন্দার মির্জার প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী। প্রদর্শনীর নাম ‘বাংলার জল রঙের ছোঁয়া’। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে এমএফএ সম্পন্ন করেছেন ইসকিন্দার। একাডেমিক শিক্ষা শেষে চিত্রকলায় পুরোপুরি নিজেকে মগ্ন রেখেছেন নবীন এ চিত্রশিল্পী। একজন শিল্পী সব সময়ই নিয়োজিত থাকেন সৃজনশীল প্রক্রিয়ার মধ্যে। এ শিল্পীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই। বেশ কিছু ফুলের ছবি এঁকেছেন শিল্পী। শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘ফ্লাওয়ার স্টাডি ও ফ্লাওয়ার কম্পোজিশন’। এতে রয়েছে রঙবেরঙের চন্দ্রমল্লিকা, নয়নতারা, অর্কিড, গোলাপ, অপরাজিতা, নীলকণ্ঠ জবাসহ দেশ-বিদেশের কিছু ফুলের ছবি। ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক। অস্থির সমাজে মানুষ যেন ফুলকে ভালবাসতে শেখে, তাহলেই সে মানুষকেও ভালবাসবে এমনই প্রত্যাশায় শিল্পী ফুলকে তুলে ধরেছেন তাঁর তুলির ছোঁয়ায়। ‘নেচার’ শিরোনামের একটি চিত্রকর্মে তিনি এঁকেছেন গ্রামের পরিত্যক্ত একটি বাড়ি। কাজের অন্বেষণে শহরে চলে আসা মানুষ ফেলে এসেছে তাঁর পৈত্রিক ভিটা ও বাড়ি। আগাছায় প্রকৃতিই যেন দখল করে নিয়েছে বাড়িটি। কৃষিসমৃদ্ধ দেশে কাজের খোঁজে শহরে আসছে মানুষ জীবিকার অন্বেষণে, শিল্পীর চোখে এ যেন অন্যরকম এক আবিষ্কার। সব ক্ষেত্রে শিল্পীর বিষয় নির্বাচন, উপস্থাপনা এবং রঙের ব্যবহার আকর্ষণীয়। প্রকৃতির সৌন্দর্যকে অপরূপ মহিমায় তুলে এনেছেন নিসর্গতায়। গ্রামের মেঠোপথ, পথের দুই পাশে গাছ ও লতাপাতায় আবিষ্ট। প্রকৃতিপ্রেমিক শিল্পী নিজ গ্রামের দৃশ্যকেও ফুটিয়ে তুলেছেন তুলির আঁচড়ে। ‘ডিপেন্ড’ শিরোনামের একটি চিত্রে উঠে এসেছে পরগাছার চিত্র। পরগাছা অন্যের ওপর জন্মিয়ে নিজেই যেন দখলদারিত্বে ব্যস্ত। যেমন দখল চলে আমাদের সামাজিক জীবনে। ‘হর্স অব ওল্ড ঢাকা’ নামের ছবিগুলোতে ঘোড়ার বিভিন্ন সময়ের মুভমেন্ট তুলে ধরা হয়েছে। এর কোনটাতে রয়েছে এই মাত্র গাড়ি টেনে ঘোড়া বিশ্রামে আছে, কখন গাড়ি টানবে অপেক্ষায় আছে অথবা চলমান আছে। প্রদর্শনীতে গরু ও মহিষের গাড়িকেও উপস্থাপন করা হয়েছে নান্দনিকভাবে। বাংলার নারীদের কিছু চিত্রও স্থান পেয়েছে। ‘মেমোরি অব টু উইমেন’ শিরোনামের ছবিতে গ্রামের দুই নারীর স্মৃতিময় দৃশ্য। কোন এক সময়ে তারা শাপলা তুলত এবং এগুলো দিয়ে কী করত এসব স্মৃতি মনে করছে। এর একটিতে নারীর কবিত্বকে চিত্রায়ন করা হয়েছে অপরূপ মহিমায়। ছবির ফ্রেমে শামসুর রাহমানের কবিতার চরণ যেন মিশে গেছে নারীর জীবনের অংশ হয়ে। নারীর সর্ব শরীরে তুলির ছোঁয়ার নান্দনিকতায় এর বহির্প্রকাশ ঘটেছে। কবিতার চরণে রয়েছে ‘জীবনের অনন্ত দিনে কিছু লেগে থাকে কিছু মরে যায়/ছবির ফ্রেমে বাঁধানো স্মৃতিগুলো থেকে যায়/এভাবে কি যায় দিন চিরদিন ভেবে ভেবে থাকি/স্থানাভাবে পথে পথে ঘুরি/আবার কখনও ভাবি স্মৃতিগুলি’। এটি শিল্পীর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হলেও প্রতিটি চিত্রকর্মে রয়েছে মুন্সীয়ানার পরিচয়। মূলত জল রং ওয়াশ পদ্ধতিতে চিত্রকর্ম করা হয়েছে এবং এটাকে কিছুটা ব্যতিক্রমভাবে তুলে ধরা হয়েছে কোন কোন চিত্রে। চিত্রকলায় রেখার দক্ষতা, রঙের প্রয়োগ কৌশল ও মেধার সমন্বয়ে নিজস্ব রীতির স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। তাঁর ব্যবহৃত রেখা রং এবং আলোছায়া প্রতিটি চিত্রকে জীবন্ত ও অর্থবহ করে তুলেছে। প্রদর্শনী উৎসর্গ করা হয়েছে শিল্পী ইসকিন্দার মির্জার মা, বাবা ও ফাহিমকে। প্রদর্শনী শেষ হবে আগামীকাল। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকবে।
×