ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনলাইনে কলেজে ভর্তি নিয়ে এবার নতুন বিতর্ক

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৯ জুন ২০১৫

অনলাইনে কলেজে ভর্তি নিয়ে এবার নতুন  বিতর্ক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দেশের সকল শিক্ষার্থীকে কলেজ ভর্তির জন্য অনলাইনের আওতায় আনার ঘটনা নিয়ে এবার নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা বোর্ডের সুপারিশ এমনকি খোদ শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করে সকল শিক্ষার্থীকে এবার বাধ্যতামূলকভাবে অনলাইন ও এসএমএসের আওতায় আনা হয়েছিল। তথ্য প্রযুক্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা না থাকার পরেও প্রথমবারেই এভাবে সারাদেশের সকল শিক্ষার্থীকে অনলাইনে যুক্ত করতে গিয়েই আজ ভর্তি ঘটেছে কেলেঙ্কারির ঘটনা। ভয়াবহ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে। নানা সীমাবন্ধতায় অনলাইনে আবেদনই করতে পারেনি আরও সোয়া এক লাখ এসএসসি পাস শিক্ষার্থী। এদিকে পুরো বিষয়টি যিনি দেখভাল করছেন সেই শিক্ষা সচিব কলেজ ভর্তিতে সৃষ্ট জটিলতার দায় স্বীকার করে নিয়েছেন শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান। টানা চারদিন ধরে দফায় দফায় ভর্তির তালিকা প্রকাশের ঘোষণা দিয়েও রবিবার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড ও এ কাজের জন্য বুয়েটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। যদিও শনিবারের বিকেলের ঘোষণা অনুসারে রবিবার তালিকা বা ফল প্রকাশ হওয়ার কথা। ফল প্রকাশ ও ভর্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো একাদশ শ্রেণীর ক্লাস শুরুর সময় একদিন বাড়ানো হয়েছে। ক্লাস শুরুর সময় ১ জুলাইয়ের পরিবর্তে ২ জুলাই নির্ধারণ করা হয়েছে। ফল প্রকাশ হলে ভর্তি কার্যক্রম চলবে আজ, আগামীকাল ও পরশু (২৯ জুন, ৩০ জুন ও ১ জুলাই)। ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা কে কোন কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছে তার তালিকা প্রকাশে দেরি হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। অনলাইনে ভর্তির কাজের সঙ্গে জড়িত বুয়েটের বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তথ্য প্রযুক্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা না থাকার পরও প্রথমবারেই এভাবে সকল শিক্ষার্থীকে অনলাইনে আনার চিন্তাই ছিল ভুল। অজ্ঞতার ফল দিতে হচ্ছে আজ। সমালোচনায় পড়তে হচ্ছে সরকারকে। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের ভর্তির নীতিমালার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ ছিল প্রথমবার অনলাইনের আওতায় আসবে কেবল ৩০০ আসন আছে এমন কলেজ। ভর্তি নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির কাছে মন্ত্রী এটা লিখিতও দিয়েছিলেন। শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকেও নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে অনলাইনের কাজ শুরুর সুপারিশ ছিল। কিন্তু আমলাতন্ত্রের কবলে পড়ে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকারকেই। জানা গেছে, সব কলেজে অনলাইন ও এসএসএমের মাধ্যমে ভর্তির আবেদন নিতে এবার ‘২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির নীতিমালা’ দুইবার জারি করা হয়েছে। একই বছরের জন্য জারিকৃত দুটি ভর্তি নীতিমালা এবং নীতিমালা চূড়ান্তের আগে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ সংক্রান্ত কার্যপত্রে যে নোট দিয়েছিলেন তার অনুলিপি জনকণ্ঠের হাতে এসেছে। গত ২৫ মে একাদশে ভর্তির মেধা তালিকা প্রকাশের কথা থাকলেও কারিগরি জটিলতায় রবিবারও তা প্রকাশ করতে পারেনি আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটি। কবে, কখন এই তালিকা প্রকাশ করা হবে তাও বলতে পারছে না কেউ। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে গত ১৬ মে বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোতে (ব্যানবেইজ) শিক্ষা সচিবের সভাপতিত্বে ভর্তি নীতিমালা নিয়ে সভা হয়। শিক্ষা সচিব ওই সভার কার্যপত্র ২৫ মে অনুমোদন দিয়ে ভর্তি নীতিমালা চূড়ান্ত করতে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করে অনুমোদন চাওয়া হয়। ভর্তি নীতিমালায় চূড়ান্ত অনুমোদন না দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নিজের হাতে নোট লেখেন, ‘যে সকল প্রতিষ্ঠান দুর্বল, পশ্চাদপদ এবং শিক্ষার্থী পায়নি তাদের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আগামীতে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। গত বছর ৫০০ আসনবিশিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই আওতায় (অনলাইন ও এসএমএসের মাধ্যমে ভর্তি) ছিল। এবার ৩০০ আসনবিশিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনলাইন বা এসএমএসের মাধ্যমে আবেদন প্রযোজ্য করা যায়।’ শিক্ষামন্ত্রীর এই নির্দেশনা আমলে নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গত ৩১ মে সচিবের কাছে নোট উপস্থাপন করেন। লিখেন ‘অনুচ্ছেদের ৫৯ এর আলোকে খসড়া অনুচ্ছেদ ৪ এর সংশোধন করা হয়েছে। সচিব মহোদয়ের সদয় স্বাক্ষরের জন্য উপস্থাপন করা হলো।’ শিক্ষা সচিবের স্বাক্ষরে ১ জুন ভর্তি নীতিমালা জারি করা হয়। ওই নীতিমালার ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ৩০০ জন শিক্ষার্থী আছে সেসব প্রতিষ্ঠানে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তিতে অনলাইন বা টেলিটক মোবাইল এসএসএমের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানে ৩০০ জনের কম শিক্ষার্থী আছে সেসব শিক্ষার প্রতিষ্ঠানও অনলাইনে ভর্তির কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারবে। গত ২ জুন পুনরায় ভর্তি নীতিমালা জারি করা হয়। নতুন করে জারিকৃত নীতিমালার ৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির জন্য অনলাইনে অথবা টেলিটকে মোবাইল এসএমএমের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে।’ অনলাইনে আবেদনের জন্য নতুন করে ওয়েবসাইটের ঠিকানাও নতুন ভর্তি নীতিমালায় তুলে দেয়া হয়। নতুন করে ভর্তি নীতিমালা জারি করার সব শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে অনলাইন বা এসএমএসে আবেদন করতে হয়েছে। আর ১২ লাখ শিক্ষার্থীর আবেদন সমন্বয় করতে গিয়েই তৈরি হয়েছে জটিলতা। বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১২ লাখ শিক্ষার্থীর ডাটা যুক্ত করে একসঙ্গে কাজ করা এক প্রকাশ অসম্ভব হয়ে গেছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থী কমপক্ষে ৫টি কলেজের নাম দিয়েছে। এতে ডাটা হয়েছে বিশাল। ঢাকা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা জানান, আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির প্রস্তাব ছিল যেসব কলেজে ৫০০ আসন রয়েছে তাদের বাধ্যতামূলকভাবে অনলাইনে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো। এছাড়া ৩০০ আসনের কলেজগুলোকে অনলাইনে ভর্তি করাতে তাদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়া। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আবু বক্কর জানান, এবার মোট ১১ লাখ ৫৬ হাজার শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির আবেদন করেছে। তবে একাধিক আবেদন করার সুযোগ থাকায় আবেদন জমা পড়েছে মোট ৩৩ লাখ। শুধু ৫০০ আসনের কলেজে অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম সারার বাধ্যবাধকতা রাখা হলে সার্ভারে জটিলতা কম হতো বলে মনে করেন আবু বক্কর। এরপরও কেন সব কলেজে অনলাইনে আবেদন করতে বাধ্য করা হলো- এমন প্রশ্নে চেয়ারম্যান বলেন, এটা এখন বলে কোন লাভ নেই, দেখা যাক। বুয়েটের আইআইসিটি বার বারই দায়িত্ব নিয়ে বলেছে আমরা পারব, পারবই। এদিকে ঘটনায় নিয়ে যখন বিতর্ক চরমে তখন রবিবার দুপুরে সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠান শেষে শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, সব কলেজকে অনলাইনের আওতায় আনতে আমার ভূমিকা ছিল। আমিই সব কিছুর জন্য দায়ী, আমার বিরুদ্ধে লিখেন কোন অসুবিধা নেই। বিদেশ থেকে সফটওয়্যার না কিনে বুয়েট থেকে সফটওয়্যার বানানো হয়েছে। এতে নিজেদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে। আর প্রথম এই কাজটা করা হচ্ছে। কখন ভর্তির ফল দেয়া হবে তা নিশ্চিত করে না জানিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, যন্ত্রপাতির ব্যাপার, অনুমান করে কথা বলতে হয়। প্রত্যেকটা কাজই রিক্সি।...আইটির বিষয় ভাল বুঝি না। আবেদন করেনি সোয়া এক লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী ॥ এসএসসিতে পাস করেও এ বছর কলেজের একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির আবেদন করেনি প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী। শিক্ষা বোর্ডগুলো এই শিক্ষার্থীদের কলেজে ভর্তি না হওয়ার কারণ খুঁজে দেখবে বলে জানিয়েছে। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোঃ আবু বক্কর ছিদ্দিক জানান, নির্ধারিত ১৬ দিনে অনলাইন ও এসএমএসের মাধ্যমে কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেছে প্রায় ১১ লাখ ৪৯ হাজার শিক্ষার্থী। তিনি জানান, ১ লাখের কিছু বেশি শিক্ষার্থী আবেদন করেনি। এই শিক্ষার্থীরা কেন আবেদন করেনি তা পরে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব। যারা আবেদন করেনি তারা সময় পাবে আবার আবেদনের।
×