ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কোকেন আমদানিকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৯ জুন ২০১৫

কোকেন আমদানিকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম বন্দরে কোকেন সন্দেহে আটক বিদেশ থেকে আমদানি করা সূর্যমুখী তেলের চালানের ঘটনা এখনও রহস্যঘেরা। গত ৮ জুন বন্দরে আমদানিকৃত ১০৭ ড্রামভর্তি সূর্যমুখী তেলের এ চালানের সঙ্গে একটিতে কোকেন রয়েছে বলে ঢাকায় দুটি ল্যাব টেস্টে নিশ্চিত হওয়ার পর শনিবার রাতে বন্দর থানায় এর আমদানিকারকসহ ২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান খাতুনগঞ্জের খানজাহান আলী লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক নুর মোহাম্মদ ও প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেলের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে পুলিশ এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। অবশ্য গত ৮ জুন সিএমপির গোয়েন্দা পুলিশ সোহেলকে আটক করে বন্দর পুলিশে হস্তান্তর করার পর তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হলে জেলহাজতে পাঠানো হয়। শনিবার বন্দর থানার এসআই ওসমান গনি বাদী হয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় খানজাহান আলীর মালিক নুর মোহাম্মদ ও প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেলকে আসামি করা হয়। মামলার পরপরই নুর মোহাম্মদ গা ঢাকা দিয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এদিকে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের চট্টগ্রাম অফিসের উপ-পরিচালক জাকির হোসেনের নেতৃত্বে এ ঘটনার ব্যাপারে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী দশ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। অপরদিকে শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘের সহায়তা চাওয়ার জন্য রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পত্র দেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বলে শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদফতর সূত্রে জানানো হয়েছে। এদিকে সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া থেকে সানফ্লাওয়ার (সূর্যমুখী) ব্র্যান্ডের ভোজ্যতেলের এ চালানটি এসেছে উরুগুয়ের মন্ট্রিভিডিও বন্দর থেকে। সিঙ্গাপুর হয়ে গত ১২ মে এ চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানানো হয়, ইন্টারপোলের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের এ চালানে কোকেন রয়েছে বলে তথ্যটি দেয়া হয় পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারিকে। তিনি তাৎক্ষণিক এ ঘটনার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সিএমপির তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বনজ কুমার মজুমদারকে নির্দেশনা প্রদান করেন। নির্দেশনা পেয়ে বনজ কুমার মজুমদার সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগকে তদন্তে নামার নির্দেশ দেন। কিন্তু বন্দরের যে স্থানে এ চালানটি নামানো হয়েছে সেটি বন্ডেড এরিয়া হওয়ায় গোয়েন্দা পুলিশ এতে হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। ফলে পুলিশের পক্ষ থেকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরকে বিষয়টি দেখার অনুরোধ জানানো হলে তদন্তে নামে সংস্থাটি। আমদানির ১০৭টি ড্রামের নমুনা সংগ্রহ করে এগুলো সিলগালা করা হয় এবং এর খালাস কাজ নিষিদ্ধ করা হয়। চট্টগ্রামে কাস্টমস ও নৌবাহিনীর দুটি পরীক্ষাগারে পৃথকভাবে নমুনা পরীক্ষা করার পর এতে কোকেনের কোন আলামত নেই বলে রিপোর্ট দেয়া হয়। কিন্তু পুলিশ ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের সন্দেহ কাটেনি। ফলে এ নমুনা পাঠানো হয় ঢাকায় বিএসআইআর এবং বাংলাদেশ ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে। পরীক্ষা শেষে গত শনিবার রিপোর্ট আসে যে, ১০৭টি ড্রামের মধ্যে ৯৬ নম্বর ড্রামে সূর্যমুখী তেলের সঙ্গে তরল কোকেন রয়েছে। এরপর শুরু হয় তোলপাড়। ওই রাতেই বন্দর থানা পুলিশ নিজে বাদী হয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা দায়ের করে। মামলার আসামি করা হয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান খানজাহান আলী লিমিটেডের মালিক নুর মোহাম্মদ ও প্রতিষ্ঠানটির আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেলকে। এদিকে খানজাহান আলী লিমিটেডের মালিক নুর মোহাম্মদ বক্তব্য দিয়েছেন, তার প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র ও সিল জালিয়াতি করে গোলাম মোস্তফা সোহেল এ কাজ করেছেন, যা তার অজ্ঞাতসারে হয়েছে। গোলাম মোস্তফা সোহেলও ইতোমধ্যে পুলিশকের কাছে বক্তব্য দিয়েছেন, নুর মোহাম্মদের অজ্ঞাতসারে তিনি ভুয়া কাগজপত্র ও ঋণপত্রের মাধ্যমে চালানটি এনেছেন। গোলাম মোস্তফা সোহেল ডিবি পুলিশকে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বলে গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তা এখন জানানো হচ্ছে না। ভোজ্যতেল আমদানির সঙ্গে জড়িত চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানানো হয়েছে, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ সুদূর বলিভিয়া থেকে ভোজ্যতেলের চালান আসার এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম। আর এত স্বল্প পরিমাণ চালান এনে তা বাজারজাত করতে গেলে লাভজনক হতে পারে না। এ ঘটনার নেপথ্যে রহস্যজনক কিছু রয়েছে বলে তাদের ধারণা। বন্দর ও কাস্টম সূত্রগুলোও বলছে, শতভাগ কোকেন কিনা তা এখনও নিশ্চিত না হলেও তরল কোকেন হিসেবে একটি ড্রামে কোকেন রয়েছে বলে প্রাথমিক দুটি ল্যাব টেস্টে ধরা পড়েছে। সঙ্গত কারণে এখন প্রশ্ন উঠেছে, এ চালান বাংলাদেশে কেন আনা হলো। এর উত্তরে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন সূত্রে রবিবার জানানো হয়েছে, এ চালানের মূল গন্তব্য বাংলাদেশ নয়। এটি পুনরায় রফতানি হয়ে চলে যেত উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপের যে কোন দেশে, যা তদন্তে হয়ত বেরিয়ে আসতে পারে। অপরদিকে, এ তরল কোকেনের মূল্য কত এবং এর ব্যবহার বাংলাদেশে রয়েছে কিনা, এর সকলই এখনও রহস্যঘেরা। আর এ কারণে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের পক্ষে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দলের মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করানোর জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে আসা এ তরল কোকেনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে দুই বাংলাদেশীকে আটক করার একটি খবরও নানাভাবে এসেছে। কিন্তু কাদের এবং সুনির্দিষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রে কোথায় তাদের গ্রেফতার করা হয়েছেÑ তা এখনও অজানা রয়ে গেছে। অপরদিকে, সূর্যমুখী তেলভর্তি একটি ড্রাম থেকে তরল কোকেনের আলামত পাওয়ার পর এখন পুরো চালানটির অর্থাৎ ১০৭ ড্রামভর্তি সূর্যমুখী তেলের নমুনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক ধারণাÑ এ ঘটনার নেপথ্যে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র জড়িত রয়েছে। এ চক্রের এজেন্ট রয়েছে ঢাকায়। এদের হাত এতই লম্বা যে এ চালানের ব্যাপারে ইন্টারপোল হস্তক্ষেপ না করলে হয়ত পুনঃরফতানি হয়ে যেত তরল এ কোকেন। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ থেকে হেরোইনের চালান পুনঃরফতানি হওয়ার পথে ধরা পড়ার ঘটনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বন্দর ও কাস্টমসের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, বিশাল এ বন্দরে প্রতিদিন যে পরিমাণে কন্টেনার বোঝাই ও বাল্ক আকারে পণ্য আমদানি হয়ে আসছে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষার কোন অবকাশ নেই। ফাঁকফোঁকরে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র পণ্য আমদানি ও রফতানির নামে নিষিদ্ধ ও মাদক চোরাচালান এমনকি অস্ত্র ও গোলাবারুদ আসা যাওয়ার অবকাশও থেকে যায়। বিশেষ করে কেমিক্যাল হিসেবে আমদানি পণ্যে কী আসছে তা সম্পূর্ণ রহস্যঘেরা। কাস্টমস ল্যাবে পরীক্ষার পর যে রিপোর্ট আসে তাই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করে তা শুল্কায়ন ও খালাস কাজ হয়ে থাকে, যা সম্পূর্ণভাবে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের এখতিয়ারভুক্ত। এতে বন্দর পরিচালনা কর্তৃপক্ষের কোন হস্তক্ষেপ থাকে না। অনুরূপভাবে এ চালানটিও প্রায় পার পেয়ে গিয়েছিল। উন্নততর পরীক্ষার জন্য ঢাকায় দুটি ল্যাব টেস্টে ধরা পড়ার পর এখন নিশ্চিতভাবে বলা হচ্ছে সূর্যমুখী তেলের সঙ্গে কোকেন আনা হয়েছে। এদিকে আরও রহস্য দেখা দিয়েছে আমদানির এ চালানটি নাকি ঋণপত্র খোলা ছাড়াই এসেছে। তাও আবার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভুয়া প্যাড-সিল জালিয়াতির মাধ্যমে। এ ঘটনা প্রমাণ করেছে এলসি ছাড়াই চালানটি এসেছে। অথচ ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি ছাড়া পণ্য আমদানি কিভাবে হয়ে আসে তা সম্পূর্ণ রহস্যঘেরা। রহস্য শুধু এখানেই নয়, খানজাহান আলীর সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রাইম হ্যাচারির একজন ব্যবস্থাপক এ চালান আমদানি করে এনেছে বলে বলা হলেও এর পেছনে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র যে জড়িত তা নিশ্চিত। প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপককে তারা সুকৌশলে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত করেছে মাত্র। এমনও হতে পারে মূলত সে নিজেও জানে না সূর্যমুখী ব্র্যান্ডের তেল আমদানির সঙ্গে তরল কোকেন আনা হচ্ছে। আবার এটাও হতে পারে তার জ্ঞাতসারে এ ঘটনার জন্ম। কেননা লোভের বশবর্তী না হলে ওই ব্যবস্থাপক তার মূল প্রতিষ্ঠান খানজাহান আলী লিমিটেডের ভুয়া প্যাড-সিল ব্যবহার করতে যাবে কেন। এদিকে বন্দর পুলিশ জানিয়েছে, বিষয়টি কোর্টের নির্দেশে যাবতীয় পদক্ষেপ চলছে। এক্ষেত্রে বন্দর পুলিশ কোর্টের অনুমতি নিয়ে পুনরায় আমদানির এ ১০৭ ড্রাম থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পুনরায় পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে কোর্টকে জানানোর পর নির্দেশ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। বন্দর পুলিশ জানিয়েছে, মামলার বাদী পুলিশ নিজে। সেহেতু পুলিশের নিজস্ব তদন্ত অনুযায়ী পরবর্তী যাবতীয় পদক্ষেপ গৃহীত হবে। পুলিশের বেশ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, এরইমধ্যে তারা প্রচ- চাপের মুখে রয়েছে। যদি সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ জানিয়েছে কোন চাপ নেই। এছাড়া বন্দর পুলিশ আরও জানিয়েছে, তারা এ মুহূর্তে খানজাহান আলী লিমিটেডের মালিক নুর মোহাম্মদকে গ্রেফতারের চেয়ে নমুনা পরীক্ষার দিকে বেশি তৎপর। কেননা, আদালতে সবকিছু মোকাবিলা করতে হবে পুলিশকেই। অপরদিকে, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মঈনুল খান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তারা নিশ্চিত সংগৃহীত নমুনা অনুযায়ী এ চালানে কোকেন রয়েছে। যে ড্রামে কোকেনের আলামত মিলেছে তাতে ১৮৫ কেজি ভোজ্যতেল রয়েছে। তেলের সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় রয়েছে তরল কোকেন। তেল থেকে কোকেনের পরিমাণ কত হবে তা এখনও অজানা। এছাড়া এ তরল কোকেন কোন ধরনের তাও অজানা। তাই তারা জাতিসংঘের অভিজ্ঞ দলের সহায়তা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতিসংঘের অধীনে তদন্ত দল পরীক্ষা নিরীক্ষা করলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। এদিকে কাস্টম সূত্রে জানানো হয়েছে, ভোজ্যতেলের সঙ্গে আসা এ কোকেন যে পরিমাণই হোক না কেন তা বাংলাদেশ বা এ অঞ্চলে ব্যবহারের জন্য নয়। এটা পার্শ¦বর্তী যে কোন দেশ হয়ে পুনরায় উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপের যে কোন দেশে পুনঃরফতানি হয়ে যেত ভিন্ন নামের পণ্যের ঘোষণা দিয়ে। সে হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের চোরাচালান ও মাদক পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। সঙ্গত কারণে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে এর নিরাপত্তা আরও জোরদার করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
×