ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সংগ্রামের শৈল্পিক চিত্র

নান্দনিক প্রযোজনা ‘সুখ চান্দের মোড়’

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২৮ জুন ২০১৫

নান্দনিক প্রযোজনা ‘সুখ চান্দের মোড়’

সাজু আহমেদ ॥ শিল্পের সমালোচনা হয় না। শিল্পবোদ্ধাদের এহেন ধারণার সত্যতা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে শিল্পের নান্দনিকতা তথা শিল্প তার অনিবার্য নন্দনতত্ত্বের গভীরতা কতটা স্পর্শ করল তার পরিমাপটা বোঝা যায় দর্শক ও শিল্পভোক্তাদের অভিব্যক্তিতে। শিল্পসমৃদ্ধ আমাদের এই দেশ। নানান ঐতিহ্য আর নান্দনিকতায় পরিপুষ্ট আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি। হাজার বছর বা তার অধিক সময় ধরে দেশীয় যাত্রা, কবিগান, সংযাত্রা, ধামাইল গান, জারিগান, পালাগান, গম্ভীরা, পুঁথিপাঠ প্রভৃতিরূপে চলমান আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারা। তবে একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সভ্যতার উন্মেষের ফল আধুনিকতার ছোঁয়া আকাশ সংস্কৃতির মহাতা-বে এসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনেকটাই ম্লান হয়েছে। এহেন সঙ্কটেও এই ঐতিহ্যগুলো তুলে ধরছেন থিয়েটারের কর্মীরা তাদের সৃজনশীল নাট্যচর্চার মাধ্যমে। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবগাহন কিছুটা হলেও লক্ষ্য করা যায় নাট্যশিল্পে। যদিও সেটার সংখ্যা খুবই কম এবং গতিও মুমূর্ষু। তদুপরি দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লালন করে এগিয়ে চলছে আমাদের নাট্যশিল্প। সাম্প্রতিককালে আকাশ সংস্কৃতির পাশাপাশি নাট্যশিল্পের অগ্রযাত্রায় যুক্ত হয়েছে নতুন প্রতিবন্ধকতা। সমকালীন এই প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে নাট্যকর্মীদের প্রাণান্ত চেষ্টা এবং তরুণদের বৈচিত্র্যময় চিন্তায় নাট্য নির্মাণের ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে নিয়তই সমৃদ্ধ হচ্ছে নাট্যশিল্প। বাড়ছে কলেবর। সাম্প্রতিককালের তারুণ্যনির্ভর মেধাবী ও নিরীক্ষক নাট্য নির্মাতাদের সংখ্যা বাড়ছে। এমনি এক তরুণ মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। সম্প্রতি এই তরুণ মঞ্চকর্মী এবং পরিচালকের প্রাণান্ত চেষ্টায় কিচ্ছা কাহিনীর প্রযোজনায় মঞ্চে এসেছে আসাদুজ্জামান আসাদ রচিত ‘সুখ চান্দের মোড়’ নামের একটি অনন্য প্রযোজনা। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন দেখে অনেকটা অভিভূত দর্শকরা। রমজান মাসে ঢাকার মঞ্চনাটকে দর্শক খরা থাকে। সেই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে কয়েকদিনের বর্ষার ঝর ঝর কান্না। এর মাঝেও ‘সুখ চান্দের মোড়’ নাট্য প্রদর্শনীতে প্রায় মিলনায়তনপূর্ণ দর্শকদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে নতুন নাট্য নির্মাণ উপভোগ করার আগ্রহ। বর্ষণসন্ধ্যায় নাট্য উপস্থাপনা দেখতে এসেছিলেন অনেকেই। দর্শক সারিতে ছিলেন আইটিআই সভাপতি রামেন্দু মজুমদার, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জামানসহ আরও অনেকেই। নাটক শুরুর আগে তাদের দেয়া উদ্বোধনী বচনে তুষ্ট হলেন নাটকের নিদের্শক এবং নতুন দলের কা-ারি মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। এরপরই শুরু হলো নাটক। লাইট অফ হওয়ার পর আবার যখন জ্বলে উঠল তখন দেখা গেল রঙ-বেরঙয়ের কাকতাড়ুয়াসহ অন্যান্য প্রপস উপর থেকে একটার পর একটা নেমে আসছে। যদিও নাটক শুরুর আগে থেকেই সেখানে একটি আলোকিত মুখোশ ঝোলানো ছিল। নাটক শুরুর আগে এ নাট্যরস উপস্থাপনা একটু ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। তবে সময় একটু বেশি নেয়া হলে বিরক্তিও চলে আসতে পারে। এ বিষয়টি মনে রাখা উচিত। প্রপস নামানো শেষ হলো সং সাজা একটি লোক প্রবেশ করে মঞ্চে। তারপর আরও একজন। এই দু’জনের কথোপকথন এবং সম্বোধন দেখে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরার কথা মনে হয়েছে দর্শকদের। কিন্তু না, একে একে নাটকের অন্য চরিত্রও এসে গেল। শুরু হলো নাটক। নাটকের শুরুটা চমৎকার এটা নির্দিধায় বলেছেন দর্শকরা। তবে গল্প এগিয়ে যাওয়ার গতি খুবই শ্লথ বলে মনে হয়েছে তাদের কাছে। বিশেষ করে নাটকের গল্প ততটা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি না সংলাপে না গল্প বলার ঢংয়ে। তবে নাটকের শিল্পীদের বিশেষ ভঙ্গিমায় শরীর অঙ্কন এবং সংলাপের ক্ষেত্রে সংযাত্রার প্যাটার্নকে যুক্ত করায় হাস্যরসে পরিপূর্ণ নাটকের দর্শকরা মুহুর্মুহু হেসেছেন, করতালি দিয়েছেন। তবে কোন কোন সময় বিষয়টি ভাঁড়ামি হয়ে যাওয়া নাটকে গল্প থেকে সরে গেছে বলে মনে হয়েছে দর্শকদের কাছে। নাটকে একটি সময় এবং স্থানকে তুলে ধরা হয়েছে। সুখ চান্দের মোড় নামের একটি স্থান থেকে রাস্তা নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কামলা নামের শ্রমজীবী মানুষদের নিয়োগ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। সেখানে কামলা নিয়োগের ক্ষেত্রে দালালদের হাতে পড়তে হয় শ্রমিকদের। শেষমেশ তারা বুঝতে পারে মালিকরা তাদের মজুরি নিয়ে ঠকাচ্ছে। দালালরা তাদের শ্রম নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। তাদের জোর করে শ্রম নেয়া হচ্ছে। সে সময় তারা সে স্থান ত্যাগ করার পরিকল্পনা আঁটে। কিন্ত তাদের লিডার কাশেম গনি তাদের যে পথ দেখায় তাতে শ্রমিকদের উস্কে দেয়ার অভিযোগ মালিকদের হাতে মার খেতে হয়। কিন্ত তাকে মুক্ত করতে আসে শ্রমিকরা। নাটক যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার কথা তখনই কেমন যেন হঠাৎ নাটকটি শেষ হয়ে যায়। নাটকের গল্পে কোথায় যেন কমতি লক্ষ্য করা যায়। যদিও দর্শকদের চূড়ান্ত আগ্রহ তৈরির সময় নাটকের ইতি টানাকে নাট্য নির্মাণের একটি কৌশল হিসেবে ব্যাখ্যা দাঁড় করাবেন। তদুপরি একটি পরিপূর্ণ শিল্পের একটি নির্দিষ্ট চূড়ান্ত সীমারেখা থাকা উচিত বলে মনে করেন উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা। নাটক শেষ হয় দর্শকদের অপূর্ণতার মধ্যেই। তবে নাটকে শ্রমজীবী মানুষের একটি পরিপূর্ণ আখ্যান তারা অবগাহন করতে পারলেন এটাই বা কম কিসে- এমনটাই মনে করে দর্শকরা। উপস্থিত দর্শকরা মনে করছেন, ‘সুখ চান্দের মোড়’ নাটকের অন্যতম সমৃদ্ধি নাট্য আঙ্গিকে ঐতিহ্যবাহী সংযাত্রার উপস্থাপনাশৈলীকে যুক্ত করা। তবে নাট্য সংলাপে আরও সংযত হওয়া দরকার। আঞ্চলিক গালি যদিও সংযাত্রার অন্যতম বৈশিষ্ট্য তবে নাট্যশিল্প একটি সবর্জনীন শাশ্বত সুন্দর শিল্প। এর দর্শক রুচি এবং গ্রহণযোগ্যতাকে বিবেচনায় রেখে নাট্য নির্মাণ আবশ্যকীয়। সেদিক থেকে নাটকের ক্ষমাযোগ্য কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রথম প্রদর্শনী হিসেবে তা মেনে নেয়াও যায়। বিশেষ করে নাটকের শিল্পীদের বেশিরভাগই নতুন হওয়ায় কোন কোন সময় তারা সংলাপে আটকে গেছেন। তবে দুয়েকজন অভিনয়ে উতরে গেছেন। দু-তিনটি দৃশ্যে নাটক কিছুটা ঝুলে গেছে। সে বিষয়েও নির্দেশক ভাবতে পারেন। তবে নতুন দলের নতুন নাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনী হিসেবে এই প্রযোজনাটি অনেক ম্যাচিউরড এবং পরিপক্ব মনে হয়েছে। নাটকে নির্দেশকের নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট নাট্য প্রযোজনার শ্রীবৃদ্ধি করেছে। আমাদের উপমহাদেশের কিংবদন্তি নাট্য নির্দেশক রতন থিয়ামের মতে, নাটক করতে হলে মানুষের কাছে যেতে হয়। ‘সুখ চান্দের মোড়’ নাট্য প্রযোজনাটি মানুষের জন্য মানুষের কাছকাছি চলে আসার অন্যতম উদাহরণ। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রযোজনার প্রদর্শনীর সংখ্যা যত বাড়বে প্রযোজনাটি তত ঋদ্ধ হবে। প্রযোজনার কুশলীবরা ততটাই সাবলীল হবেন। সেই সম্ভাবনা যথেষ্ট রয়েছে। হাস্যরস নাটকের প্রাণ হলেও গল্প বলার ভঙ্গিও দর্শকদের তুষ্ট করেছে। সব মিলিয়ে কিচ্ছা কাহিনীর প্রথম প্রযোজনা ‘সুখ চান্দের মোড়’ নাটকটি ঢাকার মঞ্চে অন্যতম মাইলফলক একটি প্রযোজনা হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। জয় হোক কিচ্ছা কাহিনীর, জয় হোক ‘সুখ চান্দের মোড়’ নাটকের, সর্বোপরি জয় হোক নাট্যশিল্পের।
×