ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মানবপাচারের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি সরকারের

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ২৫ জুন ২০১৫

মানবপাচারের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি সরকারের

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা মানবপাচারের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, অবৈধভাবে মানবপাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছে। সাম্প্রতিককালে অবৈধভাবে মানবপাচার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। প্রতিরোধে ইতোমধ্যে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধ ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাচারকৃত বাংলাদেশী নাগরিকদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনাসহ মানবপাচার রোধে এই অঞ্চলের দেশগুলো যাতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারে, সেজন্যও আমাদের সর্বাত্মক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে টেবিলে উত্থাপিত প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী সরকারী ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের প্রশ্নের জবাবে লিখিতভাবে উত্তর দেন। গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পূর্ববর্তী সময় এবং চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি পরবর্তী সময়ে অবরোধ-হরতালের নামে বিএনপি-জামায়াতের ভয়াল নাশকতা, সহিংসতা ও মানুষ পুড়িয়ে হত্যার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার যে কোন সহিংসতার ঘটনা প্রতিরোধে বদ্ধপরিকর। জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান ও সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পেট্রোলবোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারাসহ নানা ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা- যারা ঘটিয়েছে কিংবা যারা এর হুকুমদাতা, তাদের সবার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। সরকারী দলের সংসদ সদস্য শরীফ আহমেদের মানবপাচার নিয়ে করা প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, মানবপাচার প্রতিরোধে জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে কাউন্টার ট্রাফিকিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনে ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন’ আইন করা হয়েছে। আইনে মানবপাচারের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- ও যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, মানবপাচার একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। মানবপাচারকারীরা আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে জড়িত। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আরও উন্নত ও অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদানে ‘জাতীয় পরিকল্পনা ২০১২-১৪’ প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়েছে। মানবপাচার প্রতিরোধে ‘জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৫-১৭’ এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে, যা শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবপাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত কমিটির সভা প্রতি মাসে অনুষ্ঠিত হয়। মানবপাচার বিশেষ করে নারী ও শিশু পাচার সংক্রান্ত বিচারাধীন মামলার অগ্রগতি মনিটর করার বিষয় কমিটিতে পর্যালোচনা হয়। তিনি বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে সমুদ্র পথে অবৈধভাবে মানবপাচার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় কোস্টগার্ডের কার্যক্রমও আরও বিস্তৃত হয়েছে। কোস্টগার্ডের টহল বাড়ানো হয়েছে। কোস্টগার্ডের একটি পেট্রোল ক্রাফট ও একটি অত্যাধুনিক হাইস্পিড মেটাল সার্ক বোট সর্বক্ষণিকভাবে চট্টগ্রাম ও গহিরা অঞ্চলে টহলে নিয়োজিত রয়েছে। এই টহল কার্যক্রম আরও বৃদ্ধির জন্য একটি করে হাইস্পিড মেটাল সার্ক বোট কুতুবদিয়া ও সাঙ্গু স্টেশনে মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া শাহপুরী, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন্স উপকূলীয় অঞ্চলে দুইটি অত্যাধুনিক হাইস্পিড মেটাল সার্ক বোট দিয়ে টহল দেয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড সমুদ্র পথে অবৈধভাবে বিদেশ গমনকালে আজ পর্যন্ত এক হাজার ৭৩৬ জন বিদেশগামী নাগরিককে সাগর থেকে আটক করেছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বিজিবির ঐকান্তিক তৎপরতায় ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের মে পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ নাগরিককে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে নারী এক হাজার ৯৪ জন ও শিশু ৪০৬ জন। এতে ২০১৪ সালে নারী উদ্ধার করা হয় ৮৫২ জন ও শিশু ৩১৭ জন। এছাড়া ২০১৫ সালে নারী উদ্ধার করা হয় ২৪২ জন ও শিশু উদ্ধার করা হয় ৪০৬ জন। এই সময়ে ২৭ জন পাচারকারীকে আটক করা হয়। একই সময় মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে ৪৪৮টি মামলা করা হয়েছে। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে বিএনপি-জামায়াত ॥ আওয়ামী লীগ ও ওয়ার্কার্স পার্টির চারজন সংসদ সদস্যের পৃথক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংসতায় ক্ষয়ক্ষতি এবং নিহতদের পরিবারসহ আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে সরকারী পদক্ষেপের বিবরণ তুলে ধরে বলেন, ইস্যুবিহীন আন্দোলন করে তারা কেবল দেশের সম্পদের ক্ষতিই করেনি, তাদের এসব কর্মকা-ে দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ অনেকাংশে নিরুৎসাহিত হয়েছে। এসব নাশকতামূলক কর্মকা- ও অরাজকতার বিরুদ্ধে সারাদেশে অসংখ্য মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরলস প্রচেষ্টা ও দৃঢ়তায় বিএনপি-জামায়াত জোটের সকল অপপ্রয়াস প্রতিহত করে জনজীবনে নিরাপত্তা ও স্বস্তি বজায় রাখতে আমরা সক্ষম হয়েছি। জনগণও আমাদের পাশে ছিল। তারা অনৈতিক অবরোধ ও হরতাল মানেনি। অপরাধীদের ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করে আমাদের সহায়তা করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট নেত্রী খালেদা জিয়ার হুকুমে এ বছরের ৫ জানুয়ারি হতে চলমান হরতাল ও অবরোধকালীন পেট্রোলবোমায় নিহতদের স্বজন ও আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদান করা হচ্ছে। নিহতদের নিকট-স্বজন ও আহতদের মধ্যে এ পর্যন্ত মোট ২২০ জনের অনুকূলে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ২০ কোটি ২৭ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া, আহত ৫ জন ও নিহত আরও ১৩ জনের নিকট-স্বজনের অনুকূলে ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকার চেক প্রস্তুত করা হয়েছে, যা শীঘ্রই বিতরণ করা হবে। সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ফজিলাতুন নেসা বাপ্পির প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। গণতন্ত্রের এই অগ্রযাত্রা আমরা অব্যাহত রাখব ইনশাল্লাহ। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ॥ সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খানের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বের প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন বহুমাত্রিক। বিশ্বে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশের এই অবস্থান আরও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাভিত্তিক কর্মকা- চলমান রয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরসহ বৈদেশিক সম্পর্কোন্নয়নে সরকারের সাফল্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন মাত্রা লাভ করেছে এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হলে অপেক্ষাকৃত স্বল্পোন্নত অঞ্চলের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধশালী অঞ্চলের অর্থনৈতিক একীভূতকরণ সম্ভব হবে। তিনি বলেন, বৈদেশিক সম্পর্কোন্নয়নে সরকার গৃহীত পদক্ষেপগুলোর কারণে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক, শান্তিপ্রিয়, প্রগতিশীল ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হয়েছে। এতে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ও অবস্থান যেমন উন্নত ও সুদৃঢ় হয়েছে, সেই সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও প্রভূত কল্যাণ সাধিত হচ্ছে। আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত নীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- অনুসরণ করে আমাদের ভবিষ্যত কূটনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখব। সরকারী দলের এম আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, আওয়ামী লীগ সরকার সব সময়ই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। কেবল রিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে নয়, দেশে যাতে ব্যক্তিখাতেও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায় তাও আমরা নিশ্চিত করেছি। তিনি বলেন, সরকারী ও বেসরকারী খাতে কাজের প্রকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা ভিন্ন বিধায় উভয়ক্ষেত্রে পারস্পরিক তুলনাযোগ্য নয়। তাই পেনশনের বিষয়টিও এর ব্যতিক্রম নয়। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে পেনশন প্রথা প্রচলনের কোন পরিকল্পনা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে। এ বিষয়ে সরকার সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এ বিষয়ে ‘জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র’-এর আওতায় একটি সমীক্ষা পরিচালনা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
×