ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মৌসুমী বৃষ্টিপাতের চক্র ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে ;###;৫ বছরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি .৫%

উত্তরাঞ্চলে দ্রুত হচ্ছে মরুকরণ প্রক্রিয়া ॥ ২০ বছরে পানির স্তর দ্বিগুণ নেমে

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ২৫ জুন ২০১৫

উত্তরাঞ্চলে দ্রুত হচ্ছে মরুকরণ প্রক্রিয়া ॥ ২০ বছরে পানির স্তর দ্বিগুণ নেমে

শাহীন রহমান ॥ মরুকরণের পথে যাচ্ছে দেশ? এমনি আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে দিন দিন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই মরুকরণে প্রক্রিয়া দেশের উত্তরাঞ্চলে বেশি ত্বরান্বিত হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৯ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, স্বল্প সময়ের জন্য বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়লেও সার্বিক বিচারে দেখা গেছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমেই কমে আসছে। মৌসুমী বৃষ্টিপাতের চক্র দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে প্রকৃতিনির্ভর কৃষির ওপর। এছাড়া এ কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণেও সেচ চাষের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের যে ১৫টি দেশে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের হার সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশেষজ্ঞরা বলছে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষির ক্ষেত্রের বেশিরভাগই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর হওয়ার কারণে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য হারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বর্ষা মৌসুমে এখন সেচকাজের জন্য পর্যাপ্ত পানির অভাব দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব বেশি পড়ছে বাংলাদেশেসহ এ অঞ্চলের ওপর। ফলে মানুষের জীবন যাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। এছাড়া আন্তর্জাতিক সব নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেয়ায় সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের ওপর। ফলে দেশের নদ-নদী শুকিয়ে এখন শুষ্ক মৌসুমে প্রায় নদীর পানির পরিমাণ ৬ হাজার কিলোমিটারের নিচে নেমে আসছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রতিবছর অনাবৃষ্টি, খরা, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে ৯ থেকে ১০ মাসই দেশের সব নদী খাল বিল শুষ্ক থাকছে। কৃষি কাজের জন্য এ সময় পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। ভূগর্ভস্থরের পানিও দিন দিন নেমে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরের আবহাওয়ার রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রতি বছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসছে। আগে উত্তরাঞ্চলে গড়ে প্রতি বছর ১৫শ’ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টিপাত হলেও এখন তা ৯শ’ থেকে ১ হাজার মিলিমিটারের নিচে নেমে এসেছে। শুষ্ক মৌসুম ছাড়াও দেশের বেশিরভাগ নদ-নদীও শুকিয়ে খালে পরিণত হচ্ছে। এ কারণে প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ঠিকমতো রিচার্জ হচ্ছে না। প্রতি বছর পানির স্তর শুধু নামছেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বরেন্দ্র এলাকার কৃষি ভূগর্ভস্থ পানি নির্ভর। কিন্তু বৃষ্টিপাতের অভাবে সেখানেও প্রতিবছর পানির স্তর নেমে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। এক হিসেবে দেখা গেছে ২০১০ সালে এসব এলাকায় পানির স্তর নেমেছে ২২.৭৫ মিটার নিচে। অথচ ১৯৯৫ সালে এসব এলাকার পানির স্তর ছিল ১১.৯৫ মিটার নিচে। মাত্র ২০ বছরেই পানির স্তর দ্বিগুণ নেমে গেছে। অন্য এক রিপোর্টে বলা হয়েছে পানির অভাবে রাজশাহী এলাকার ৪৪ হাজার জলাশয়ের অর্ধেক বছরের বেশিরভাগ সময়ে পানিশূন্য থাকছে। এ এলাকায় ২০০৯ সালের জুন, জুলাই ও আগস্টে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫৫৪.৪ মিলিমিটার। ২০১০ সালেই এর পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৪১৮.৯ মিলিমিটারে। সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁও বিশ্ব মরুময়তা প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে পরিবেশ অধিদফতর আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলা হয় উচ্চ তাপমাত্রা ও অনাবৃষ্টির কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৮ হাজার ৭২০ বর্গকিলোমিটার এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। ওই অনুষ্ঠানের বক্তৃতাকালে অনুষ্ঠানে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মরুময়তাও বাড়ছে। ইতোমধ্যে দেশের এক-চতুর্থাংশ এলাকা মরুভূতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, দেশে ১ কোটি ৫ লাখ হেক্টর অর্থাৎ আড়াই কোটি একর জমি মরুভূমির কবলে পড়তে যাচ্ছে। আর এতে ৫০ লাখ হেক্টর জমি চাষের অনুপযোগী হয়েছে। দেশের ১৮ হাজার মাইল নদী শুকিয়ে ৮ হাজার মাইলে এসে ঠেকেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসময় বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বিগত কয়েক বছরের তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণ সেই পরিচিত ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ১৯৬০ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ৩০ মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় (রাজশাহীতে) ৪৫.১ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এরপর ১৯৯৫ সালে এসে রেকর্ড হয় ৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল ৪২.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস (যশোরে)। যা ছিল বিগত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন তাপমাত্রার এই রেকর্ডে যদিও মনে হচ্ছে তাপমাত্রা কমছে। কিন্তু অতীতে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রার পরিমাণ ছিল কম। বর্তমানে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রার পরিমাণ অনেক বেশি। ওয়াল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে শুধু ঢাকা শহরের মে মাসের গড় তাপমাত্রা ১৯৯৫ সালের তুলনায় বেড়েছে ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস। নবেম্বর মাসে এই তাপমাত্রা ১৪ বছর আগের তুলনায় বেড়েছে ০.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাবে দেখা গেছে গত ৫০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার শতকরা ০.৫। ধারণা করা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রার গড় ১.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং ২১শ’ সাল নাগাদ ২.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশে দিন দিন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। সময়মতো হচ্ছে না বন্যাও। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের গড় বৃষ্টিপাত ছিল ২৩শ’ মিলিমিটার। ওই সময়ে বরেন্দ্র এলাকায় গড় বৃষ্টিপাত হয়েছিল ১১৫০ মিলিমিটার। তাদের মতে, এ ধরনের স্বল্প বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গিয়ে খরায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলেই এর পরিমাণ বেশি। তাদের মতে অনাবৃষ্টি খরাসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের উদ্বাস্তুর সংখ্যা হবে প্রায় ৮০ লাখ। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেলের ২০০৯ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশসহ সমুদ্রতীরের কয়েকটি দেশে আগামীতে মিঠা পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দেবে। ২০২০ সাল নাগাদ এ সঙ্কট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পাওয়ায় অনেক এলাকায় ইতোমধ্যে দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির অভাব। দেশের উত্তরাঞ্চলে এই অভাব আরও বেশি প্রকট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন স্থানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পেয়ে দেখা দিচ্ছে স্থায়ী মরুকরণ। রাজশাহীর বরেন্দ্র এলাকায় বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। যদিও এর মধ্যে মানবসৃষ্ট কারণ বিশেষ করে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবও দায়ী। তবে অনাবৃষ্টির দরুণ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সুপেয় পানির অভাবে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায়ও ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যে শুধু বাংলদেশেরই কমছে তা নয়। এ প্রভার ভারতীয় উপমহাদেশে পড়ছে। ভারতের আবহাওয়া দফতরের হিসাব অনুযায়ী ১৯৫১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের ব্যাপ্তি, বর্ষা মৌসুমের ব্যাপ্তি ও বৃষ্টির পরিমাপ ইত্যাদি উপাত্ত যাচাই করে দেখা গেছে ভারতীয় উপমহাদেশে বৃষ্টিপাত কমছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে চারদিনের বেশি সময় ধরে কমপক্ষে ২.৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের ঘটনা কমে গেছে। এতে বলা হয় যদিও স্বল্প সময়ের জন্য বৃষ্টিপাত বেড়েছে। কিন্তু এতে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের চক্র দুর্বল হয়ে গেছে। পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক এ করণেই যে এই উপমহাদেশের কৃষিকাজ দীর্ঘমেয়াদি বৃষ্টির উপযোগী। গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে, ধানের ফুল আসার সময় থেকে বীজ বের হওয়ার মাঝখানের সময়টুকুতে প্রয়োজনের তুলনায় বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় টি-আমন জাতের ধানের উৎপাদন কমে আসছে। ভরা বর্ষায় জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় অনাবৃষ্টিতে আমন ধানের বিশাল ক্ষেত রোদে পুড়ছে। যেখানে আমন ধান রোপণের অন্তত ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত পানি ধরে রাখা নিশ্চিত করতে হয়। না হলে কুষি বাড়ে না। সেখানে পানির অভাবে জমিতে ফাটল দেখা দিচ্ছে। যা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে আগামীতে দেশের এক-চতুর্থাংশ এলাকায় মরুকরণের পথে রয়েছে। যার বেশিরভাগের শিকার দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো।
×